%%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8_%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। দেশটির উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম সীমানায় ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায় মায়ানমার; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশ ও ভারতীয় অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ একত্রে একটি বাংলাভাষী অঞ্চল গঠন করেছে, যার ঐতিহাসিক নাম “বঙ্গ” বা “বাংলা”। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের সময় পাকিস্তানের পূর্ব অংশ (পূর্ব পাকিস্তান) হিসেবে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারিত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল প্রায় ১৬০০ কিমি (১০০০ মাইল)। দুই পাকিস্তানের লোকের ধর্ম (ইসলাম) এক হলেও তাদের মধ্যে জাতিগত ও ভাষাগত ব্যাপারে ছিল বিরাট অমিল। আর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত সরকারের অনীহায় এই অমিল প্রকটতর রূপ পায়, যার চূড়ান্ত পরিণতিতে ১৯৭১ সালে ভারতের সমর্থন নিয়ে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরগুলো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ; এ সময় দেশটিতে তেরোবার রাষ্ট্রপরিচালনার রদবদল হয়, আর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে কমপক্ষে চারবার। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। কিন্তু আয়তনের হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৩তম, ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ, যদিও বাংলাদেশের মুসলমানেরা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের চেয়ে সংখ্যায় কম হন। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের উর্বর অববাহিকায় অবস্থিত এই দেশটিতে প্রতিবছর মৌসুমী বন্যা হয়, আর ঘূর্ণিঝড়ও খুব সাধারণ ঘটনা। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক ও বিম্‌সটেক-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এছাড়া দেশটি ওআইসি ও ডি-৮ এরও সদস্য। (বাকি অংশ পড়ুন...) ...পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী আমাজনের উৎপত্তি হয়েছে পেরুতে অবস্থিত আন্দিজ পর্বতমালার নেভাদো মিসমি পর্বতশৃঙ্গ থেকে? ...বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহযোগিতার উদ্দেশ্যে উদ্দেশ্যে আয়োজিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশ কনসার্ট ও অন্যান্য অনুসঙ্গ হতে প্রাপ্ত অর্থ সাহায্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৪৩,৪১৮.৫১ মার্কিন ডলার? ...বাংলাদেশী নাট্যব্যক্তিত্ব সাঈদ আহমদ ১৯৯৩ সালে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মানজনক "লিঁজিও দো অনার" পুরস্কার লাভ করেন? যমুনাপাড়ে অবস্থিত তাজমহল ...গঙ্গার মতো ভারতের যমুনা নদীও হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র নদী? ...বোতাম সংক্রান্ত মানসিকভীতি ‘কোউমপোউনোফোবিয়া’ নামে পরিচিত? সংগ্রহশালা • নতুন নিবন্ধ তৈরি করুন ভালো নিবন্ধ ১৯৮৮ সালের আর্সেনাল দল আর্সেনাল ফুটবল ক্লাব, যা আর্সেনাল বা গানার্স নামেও পরিচিত, একটি ইংরেজ পেশাদার ফুটবল ক্লাব। ইংরেজ ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সফল ক্লাব। আর্সেনাল মোট তের বার প্রথম বিভাগ এবং ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা, দশ বার এফএ কাপ এবং ২০০৫-০৬ মৌসুমে লন্ডনের প্রথম ক্লাব হিসাবে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্‌স লীগের ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। এছাড়াও ইউরোপীয় ফুটবলের সেরা ক্লাবদের সংঘ জি-১৪-এর গুরুত্বপুর্ণ সদস্য। আর্সেনালের প্রতিষ্ঠা ১৮৮৬ সালে দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের ওউলিচে। ১৯১৩ সালে হাইবারিতে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে স্থাপিত হয় আর্সেনাল স্টেডিয়াম। যদিও ক্লাবটির প্রতিষ্ঠা ১৮৮৬ সালে, আর্সেনালের সাফল্যের সূচনা ১৯৩০ সালে প্রথমবারের মতো লীগ চ্যাম্পিয়ন শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯৭০-৭১ মৌসুমে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দল হিসাবে আর্সেনাল যুগ্ম শিরোপা জয় করে। শেষের বিশটি বছর ছিল ক্লাবটির স্বর্ণ যুগ। এসময় তারা দ্বিতীয় বারের মতো আবার ২০০৩-০৪ মৌসুমে যুগ্ম শিরোপা জয় করে। এই মৌসুমেই তারা অপরাজিত থেকে লীগ শিরোপা জয় করে। ২০০৫-০৬ সালে তারা লন্ডনের প্রথম ক্লাব হিসাবে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্‌স লীগের ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। প্রথাগতভাবে আর্সেনালের রঙ লাল ও সাদা। তবে ইতিহাসে বেশ কয়েকবার তারা তা পরিবর্তন করেছে। একইসাথে পরিবর্তিত হয়েছে ক্লাবটির অবস্থান। বর্তমানে তারা আছেলন্ডনের হলোওয়ের এমিরেট্‌স স্টেডিয়ামে। (বাকি অংশ পড়ুন...) %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%89%E0%A6%87%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%A1%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE:%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%A4%E0%A6%AE,_%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%A4 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 আপনি কি পাঠক? আপনি বিভিন্ন উপায়ে উইকিপিডিয়া ঘুরে দেখতে পারেন। নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে অনুসন্ধান নির্দিষ্ট কোন শব্দ বা বাক্যাংশ সম্পর্কিত নিবন্ধ খুঁজতে চাইলে উইকিপিডিয়ার যেকোন পাতার উপরের অনুসন্ধান বক্সটিতে তা লিখে অনুসন্ধান বোতামে ক্লিক করুন। মনে রাখবেন, মাঝে মাঝে সার্ভারের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়লে উইকিপিডিয়ার নিজস্ব অনুসন্ধান প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে বন্ধ করে রাখা হয়। সেক্ষেত্রে আপনাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুগলের (Google) অনুসন্ধান পাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। আপনার যদি কোন বিশেষ নিবন্ধের নাম নিশ্চিতভাবে জানা থাকে, তবে অনুসন্ধান বক্সে নামটি লিখে অনুসন্ধান বোতামে ক্লিক করলে উইকিপিডিয়া আপনাকে নিবন্ধটিতে নিয়ে যাবে। অনির্দিষ্ট যেকোনো নিবন্ধ Alt-x চাপলে বা প্রতিটি পৃষ্ঠার বামপাশের কলামের অজানা যেকোনো পৃষ্ঠা লিন্কটিতে ক্লিক করলে উইকিপিডিয়া আপনাকে দৈবচয়নে অজানা যেকোন একটি নিবন্ধে নিয়ে যাবে। বিষয় বা বিভাগ অনুযায়ী অনুসন্ধান বিষয় বা বিভাগ অনুযায়ী উইকিপিডিয়া ঘুরে দেখতে চাইলে প্রধান বিষয়তালিকা বা প্রধান বিষয়শ্রেণী পাতা থেকে শুরু করতে পারেন। মন্তব্য করার জন্য আপনি সবসময় আমন্ত্রিত উইকিপিডিয়ার কোন নিবন্ধ পড়ে আপনার যদি খুব ভাল লাগে, তবে আপনার প্রতিক্রিয়া সেই নিবন্ধটির আলোচনা পাতায় লিখে জানাতে পারেন। আলোচনা পাতায় যাওয়ার জন্য প্রথমে নিবন্ধটির ওপরে অবস্থিত আলোচনা ট্যাবটিতে ক্লিক করুন, তারপর সম্পাদনা-তে ক্লিক করে আপনার মন্তব্যটি আলাপ পাতায় যোগ করুন। উইকিপিডিয়া সবসময়ই ব্যবহারকারিদের কাছ থেকে গঠনমূলক মন্তব্য আশা করে। যদি মনে করেন নিবন্ধটিতে কোন ভুল তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, কিংবা নিবন্ধটি অন্য কোন ভাবে উন্নত করা যেতে পারে, সেক্ষেত্রেও নিবন্ধটির আলোচনা পাতায় মন্তব্য রাখতে পারেন। আপনি কি অবদানকারী? প্রধান নীতিগুলো উইকিপিডিয়া অবদানকারীদের জন্য উন্মুক্ত। তবে অবদানকারীদেরকে কিছু নীতিমালা ও নির্দেশাবলী মেনে চলতে হয়। একজন অবদানকারীর প্রথমেই জানা দরকার উইকিপিডিয়া কী নয়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি মূলনীতি অনুসারে উইকিপিডিয়ার নিবন্ধগুলো পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারবে না, এবং যেকোনো নিবন্ধে তার বিষয়বস্তু সংক্রান্ত বিভিন্ন মতামতের উপযুক্ত প্রতিফলন ঘটবে। উইকিপিডিয়া-তে অবদানকৃত সবকিছু জি.এফ.ডি.এল. (GNU Free Documentation License)-এর আওতায় প্রকাশিত হবে, যা নিশ্চিত করে যে এই উইকিপিডিয়া অনন্তকাল বিনামূল্যে ছড়িয়ে দেয়া যাবে। এ সম্পর্কে আরও দেখুন কপিরাইট-এ। উইকিপিডিয়া একটি সহযোগিতামূলক প্রকল্প, তাই উইকিপিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত সবাইকে সবসময় পারষ্পরিক শ্রদ্ধা, সাধারণ ভদ্রতা ও মার্জিত রুচি প্রদর্শন করতে হবে। কারও সাথে মতানৈক্য হলে দয়া করে আস্থা রাখুন, মাথা ঠান্ডা রাখুন আর ভদ্রভাবে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করুন| যখনই কোন সম্পাদনা করবেন, আপনার সম্পাদনার একটি সারাংশ যোগ করার চেষ্টা করুন, যাতে অন্যরা সহজেই আপনার সম্পাদনা/সংযোজনটির উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন ও গ্রহণ করতে পারেন| যদি দেখতে পান যে আপনার সম্পাদনা/সংযোজনটি মুছে গেছে বা পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সাথে সাথে আবার সম্পাদনা করবেন না। একটু অপেক্ষা করুন। আগে পৃষ্ঠাটির ইতিহাস, পৃষ্ঠাটির আলাপ পাতা, বা আপনার নিজস্ব ব্যবহারকারী পৃষ্ঠার আলাপ পাতায় দেখুন কেউ কোনো কারণ দর্শিয়েছে কি না, তারপর সেই অনুসারে আলোচনা করুন। এছাড়া উইকিশিষ্টাচার নিবন্ধটি-ও পড়ে দেখুন। নিরাশ হবেন না প্রথম প্রথম সম্পাদনা করতে গিয়ে আপনি অন্যদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু নিরাশ হবেন না। এরকম সহযোগিতামূলক প্রকল্পে সংঘাত থাকবেই। লেখকদের যোগাযোগের নিয়মকানুন নিবন্ধটি পড়ে দেখুন; এছাড়া বিভিন্ন সহায়িকারও সাহায্য নিতে পারেন। এগুলোর মাধ্যমে সমস্যা-সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করুন এবং কী ভাবে একজন সক্রিয় ও সৃষ্টিশীল অবদানকারী হতে পারেন, তা শিখুন। আর কোনো কিছু একেবারেই বুঝতে না পারলে - সেটা সামাজিক বা খুঁটিনাটি যা-ই হোক না কেন - এবং কোথায় জিনিষটার উত্তর খুঁজবেন তা বুঝতে না পারলে সাহায্যকেন্দ্র-তে গিয়ে আপনার প্রশ্নটি জমা দিন, সেখানে কোনো ওয়াকিবহাল ব্যক্তি আপনার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবেন। যোগ দিতে চান? উইকিপিডিয়া যে কেউ সম্পাদনা করতে পারেন, কিন্তু উইকিপিডিয়ায় যদি নিয়মিত অবদান রাখতে চান, তবে আপনার একটি নিজস্ব একাউন্ট রাখার কিছু সুবিধা রয়েছে। তাই যোগ দিতে চাইলে একটি নতুন একাউন্ট খুলুন, তারপর নতুন ব্যবহারকারী তালিকা-তে নিজের একটা ছোট ভূমিকা দিয়ে আমাদের এই উইকি-সম্প্রদায়ে আত্মপ্রকাশ করুন। আরও দেখুন সাধারণ তথ্যাবলী, নির্দেশাবলী ও সহায়িকাসমুহ উইকিপিডিয়ার বৃত্তান্ত সহায়িকা পৃষ্ঠাসমূহ - সম্পাদনা, নতুন নিবন্ধ শুরু ও আরো অনেক কিছু প্রায়শ জিজ্ঞাসিত প্রশ্নসমূহ - প্রায়ই জিজ্ঞাসা করা হয়, এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর শব্দকোষ - উইকিপিডিয়ায় প্রায়শ ব্যবহৃত কিছু শব্দের ব্যাখ্যা উইকিপিডিয়া কী উইকিপিডিয়া কী নয় অবদানকারীদের জন্য নীতিমালা ও নির্দেশাবলী ব্যবহারবিধি উইকিপিডিয়া আচরণ সহায়িকাসমূহ উইকিশিষ্টাচার নিরপেক্ষতা লেখকদের যোগাযোগের নিয়মকানুন - সংঘাত নিরসনের জন্য কিভাবে অতিসাধারণ ভুল এড়াবেন সর্বপ্রধান নীতিসমূহ ভদ্রতা কী ভাবে অবদান রাখবেন নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি পঞ্চস্তম্ভ উইকিপিডিয়া সম্প্রদায় যোগাযোগ করুন উইকিপিডিয়াচারীবৃন্দ উইকিমজা সম্প্রদায় প্রবেশদ্বার - উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়ের চলতি উদ্যোগ, কার্যতালিকা ও দলগত প্রচেষ্টার প্রকল্পসমূহের বিবরণ। বিষয়শ্রেণী: উইকিপিডিয়া বিষয়ক সাধারণ তথ্যাবলী %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4 %%%% cs671: "ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। দেশটির সরকারি নাম ভারতীয় প্রজাতন্ত্র। ভৌগোলিক আয়তনের বিচারে এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র। অন্যদিকে জনসংখ্যার বিচারে এই দেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল তথা বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান[১৪] উত্তর-পূর্বে চীন, নেপাল, ও ভূটান এবং পূর্বে বাংলাদেশ, মায়ানমার ও মালয়েশিয়া অবস্থিত। এছাড়া ভারত মহাসাগরে অবস্থিত শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া ভারতের নিকটবর্তী কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্র। দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর ও পূর্বে বঙ্গোপসাগর দ্বারা বেষ্টিত ভারতের উপকূলরেখার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৭,৫১৭ কিলোমিটার (৪,৬৭১ মাইল)।[১৫] সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য সুপরিচিত। ঐতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতা এই অঞ্চলেই গড়ে উঠেছিল। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এখানেই স্থাপিত হয়েছিল বিশালাকার একাধিক সাম্রাজ্য। নানা ইতিহাস-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যপথ এই অঞ্চলের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রক্ষা করত। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ—বিশ্বের এই চার ধর্মের উৎসভূমি ভারত। খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে জরথুষ্ট্রীয় ধর্ম (পারসি ধর্ম), ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলাম এদেশে প্রবেশ করে, ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে ভারতীয় ভূখণ্ডের অধিকাংশ অঞ্চল নিজেদের শাসনাধীনে আনতে সক্ষম হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই দেশ পুরোদস্তুর একটি ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। অতঃপর এক সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালে ভারত একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৫০ সালে সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে ভারত একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। বর্তমানে ভারত ২৯টি রাজ্য ও সাতটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বিশিষ্ট একটি সংসদীয় সাধারণতন্ত্র। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা বাজারি বিনিময় হারের বিচারে বিশ্বে দ্বাদশ ও ক্রয়ক্ষমতা সমতার বিচারে বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম। ১৯৯১ সালে ভারত সরকার গৃহীত আর্থিক সংস্কার নীতির ফলশ্রুতিতে আজ আর্থিক বৃদ্ধিহারের বিচারে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলির মধ্যে দ্বিতীয়।[১৬] তবে অতিমাত্রায় দারিদ্র্য[১৭], নিরক্ষরতা ও অপুষ্টি এখনও ভারতের অন্যতম প্রধান সমস্যা। সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারত একটি বহুধর্মীয়, বহুভাষিক, ও বহুজাতিক রাষ্ট্র। আবার বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের নানা বৈচিত্রও এদেশে পরিলক্ষিত হয়। পরিচ্ছেদসমূহ [আড়ালে রাখো] ১ ব্যুৎপত্তি ২ ইতিহাস ৩ সরকার ৪ রাজনীতি ৫ বৈদেশিক সম্পর্ক ও সামরিক বাহিনী ৬ রাজনৈতিক বিভাগ ৭ ভূগোল ৭.১ জলবায়ু ৮ জৈব বৈচিত্র্য ৯ অর্থনীতি ১০ জনপরিসংখ্যান ১১ সংস্কৃতি ১২ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ১৩ খেলাধূলা ১৪ গ্রন্থপঞ্জি ১৫ পাদটীকা ১৬ বহিঃসংযোগ ব্যুৎপত্তি আরও দেখুন : ভারতের নামসমূহ ভারত নামটির উৎপত্তি চন্দ্রবংশীয় পৌরাণিক রাজা ভরতের নামানুসারে। কথিত আছে এই বর্ষ বা অঞ্চলটি রাজা ভরতকে দান করা হয়েছিল বলে এর নাম ভারতবর্ষ। ইংরেজি ইন্ডিয়া (India) শব্দটি এসেছে সিন্ধু নদের আদি ফার্সি নাম হিন্দু থেকে।[১৮] এছাড়াও প্রাচীন গ্রিকরা ভারতীয়দের ইন্দোই (Ινδοί; অর্থাৎ, ইন্দাস (সিন্ধু) নদী অববাহিকার অধিবাসী) নামে অভিহিত করতেন।[১৯] স্বাধীনতার পর ভারতের সংবিধানে ও লোকমুখে ভারত নামটিই প্রচলিত হয়।[২০] এছাড়া মধ্যযুগে উত্তর ভারত অর্থে ফার্সি হিন্দুস্তান (বা হিন্দুস্থান; অর্থাৎ, ‘হিন্দুদের দেশ’) শব্দটিও ব্যবহৃত হত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই শব্দটি সমগ্র ভারত অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।[২১] ইতিহাস মূল নিবন্ধগুলি: ভারতের ইতিহাস এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ভীমবেটকা প্রস্তর ক্ষেত্র ভারতে মানববসতির প্রাচীনতম নিদর্শন। এক লক্ষ বছর আগেও এখানে মানুষের বসবাস ছিল।[২২][২৩] প্রায় ৯০০০ বছর আগে এদেশে স্থায়ী মানববসতি গড়ে উঠে; যা কালক্রমে পশ্চিম ভারতের ইতিহাস-প্রসিদ্ধ সিন্ধু সভ্যতার রূপ ধারণ করে।[২৪] এই সভ্যতার আনুমানিক সময়কাল ৩৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এরপর ভারতে বৈদিক যুগের সূত্রপাত হয়। এই যুগেই হিন্দুধর্ম তথা প্রাচীন ভারতীয় সমাজের অন্যান্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলির আবির্ভাব ঘটে। বৈদিক যুগের সমাপ্তিকাল আনুমানিক ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। আনুমানিক ৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয় মহাজনপদ নামে অনেকগুলি স্বাধীন রাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজ্য।[২৫] খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রতিষ্ঠিত ও মহামতি অশোকের শাসিত মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে দক্ষিণ এশিয়ার সিংহভাগ অঞ্চল একত্রিত হয়।[২৬] খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে গুপ্ত সম্রাটদের শাসনকাল প্রাচীন ভারতের সুবর্ণ যুগ নামে আখ্যাত হয়।[২৭] এছাড়া পূর্ব ভারতে পাল এবং দাক্ষিণাত্যে চালুক্য, চোল ও বিজয়নগর প্রভৃতি সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। এই সকল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পকলা, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শন সমৃদ্ধি লাভ করে। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে। এর ফলে সমগ্র উত্তর ভারত প্রথমে সুলতানি ও পরে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। মহামতি আকবরের রাজত্বকালে দেশে একাধারে যেমন সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচনা হয়, তেমনই প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় সম্প্রীতি।[২৮][২৯] ক্রমে ক্রমে মুঘল সম্রাটগণ উপমহাদেশের এক বৃহৎ অংশে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপনে সক্ষম হন। যদিও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রাধান্যকারী অসমের অহোম রাজশক্তি এবং আরও কয়েকটি রাজ্য মুঘল আগ্রাসন সফলভাবে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। ষোড়শ শতক থেকে পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপীয় শক্তিগুলি ভারতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করতে শুরু করে। পরবর্তীকালে দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোলযোগের সুযোগ নিয়ে তারা ভারতে উপনিবেশ স্থাপন করতেও সক্ষম হয়। ১৮৫৬ সালের মধ্যেই ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়েছিল।[৩০] এর এক বছর পরেই ঘটে ভারতীয় সিপাহি ও দেশীয় রাজ্যগুলির সম্মিলিত এক জাতীয় গণ-অভ্যুত্থান। ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বা সিপাহি বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও তা দেশে কোম্পানির শাসনের দুর্বলতার দিকগুলি উন্মোচিত করে দেয়। তাই ভারতকে আনা হয় ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে। বিংশ শতকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলি দেশজুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। ভারতীয় নেতা মহাত্মা গান্ধী লক্ষাধিক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অহিংস গণ-আইন অমান্য জাতীয় আন্দোলন শুরু করেন।[৩১] স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষলগ্নে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৫ অগস্ট, ১৯৪৭ তারিখে, ভারত ব্রিটিশ শাসনজাল থেকে মুক্তিলাভ করে। একই সঙ্গে দেশের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের মুসলমান-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি বিভক্ত হয়ে গঠন করে পাকিস্তান রাষ্ট্র।[৩২] ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি নতুন সংবিধান প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে ভারতে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়।[৩৩] স্বাধীনতার পরে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, জাতপাত, নকশালবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভুত্থান দেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ১৯৯০-এর দশক থেকে ভারতের শহরাঞ্চলগুলি এই হানাহানির শিকার হতে থাকে। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের ফলে চীনের সঙ্গে এবং ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত নিয়ে বিরোধ তীব্র হয়। ভারত রাষ্ট্রসংঘ (ব্রিটিশ ভারত হিসাবে) ও জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৭৪ সালে একটি ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষণ[৩৪] ও ১৯৯৮ সালে আরও পাঁচটি পরমাণু পরীক্ষা চালিয়ে ভারত নিজেদের একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রকাশ করে।[৩৪] ১৯৯১ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে[৩৫] বর্তমানে পৃথিবীর অতিদ্রুত-বর্ধনশীল এক অর্থব্যবস্থা হিসাবে ভারত সারা বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতেও সক্ষম হয়েছে। ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ তারিখে প্রবর্তিত ভারতীয় সংবিধান বিশ্বের বৃহত্তম ও সর্বাধিক বিস্তারিত ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ সংবিধান।[৩৬] সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রূপে বর্ণিত হয়েছে।[৩৭] ভারতে প্রচলিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ওয়েস্টমিনিস্টার-ধাঁচের একটি সংসদ ব্যবস্থা। এদেশের সরকার প্রথাগতভাবে ‘আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয়’ সরকার ব্যবস্থা হিসাবে বর্ণিত হয়; যার বৈশিষ্ট্য হল একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল একাধিক রাজ্য সরকারের সহাবস্থান।[৩৮] যদিও ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগ থেকে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সংস্কার ও পরিবর্তনের ফলে রাজ্য সরকারগুলির ক্ষমতার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি দেশকে চালিত করছে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দিকে।[৩৯] ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি।[৪০] তিনি পরোক্ষভাবে একটি নির্বাচক মণ্ডলী কর্তৃক পাঁচ বছরের সময়কালের ব্যবধানে[৪১][৪২] নির্বাচিত হন।[৪৩] অন্যদিকে ভারতের সরকার প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। অধিকাংশ শাসনক্ষমতা ন্যস্ত থাকে তাঁর হাতেই।[৪০] রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত[৪৪] প্রধানমন্ত্রীকে প্রথাগতভাবে সংসদের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ট আসনপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দল বা জোটের সমর্থন লাভ করতে হয়[৪০]। রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রী পরিষদ (যার কার্যনির্বাহী সমিতি হল ক্যাবিনেট)—এই নিয়ে গঠিত ভারতের শাসনবিভাগ। দপ্তরযুক্ত মন্ত্রীদের সকলকেই সংসদের কোনও না কোনও কক্ষের সদস্য হতে হয়। ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় শাসনবিভাগ আইনবিভাগের অধস্তন। সেই কারণে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রী পরিষদকে সংসদের নিম্নকক্ষের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। ভারতের আইনবিভাগ হল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ। এটি গঠিত হয়েছে রাজ্যসভা নামক একটি উচ্চকক্ষ ও লোকসভা নামক একটি নিম্নকক্ষ নিয়ে।[৪৬] রাজ্যসভার সদস্যসংখ্যা ২৪৫; এঁদের দপ্তরকাল ছয় বছর।[৪৭] এঁদের অধিকাংশই রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির বিধানসভা থেকে রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হয়ে আসেন।[৪৭] অন্যদিকে লোকসভার ৫৪৫ জন সদস্যের মধ্যে ৫৪৩ জন পাঁচ বছরের মেয়াদে নিজ নিজ নির্বাচন কেন্দ্র থেকে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন।[৪৭] এছাড়া রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে সংসদে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের যথেষ্ট সংখ্যক প্রতিনিধি নেই, তবে তিনি দুই জন সদস্যকে উক্ত সম্প্রদায় থেকে সাংসদ মনোনীত করতে পারেন।[৪৭] ভারতে এককেন্দ্রিক ত্রি-স্তর বিচারব্যবস্থা প্রচলিত। এই বিচারব্যবস্থা প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট, ২১টি হাইকোর্ট ও অসংখ্য বিচারবিভাগীয় আদালতের সমন্বয়ে গঠিত।[৪৮] মৌলিক অধিকার, কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে বিবাদ ও হাইকোর্টের আপিল বিচার এলাকা সংক্রান্ত মামলাগুলির ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের মূল বিচার এলাকার অন্তর্গত।[৪৯] এই বিচারব্যবস্থা স্বতন্ত্র[৪৮] এবং আইন ঘোষণা এবং সংবিধান-বিরোধী কেন্দ্রীয় বা রাজ্য আইন প্রতিহত করার ক্ষমতাযুক্ত।[৫০] সংবিধানের অভিভাবকত্ব ও ব্যাখ্যাদান সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অন্তর্গত।[ ভারতীয় প্রজাতন্ত্র বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।[৫২][৫৩] স্বাধীনোত্তর কালে অধিকাংশ সময় জুড়েই এদেশের শাসনকর্তৃত্ব ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আওতাধীন।[৫৪] অন্যদিকে ভারতের রাজ্য-রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) (সিপিআই(এম)) প্রভৃতি জাতীয় দল ও একাধিক আঞ্চলিক পার্টি। দুটি সংক্ষিপ্ত পর্যায় বাদে ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল অবধি জাতীয় কংগ্রেস সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা ভোগ করেছে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষিত জরুরি অবস্থা-জনিত গণঅসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে জনতা পার্টি সরকার গঠন করে। ১৯৮৯ সালে জনতা দলের নেতৃত্বে জাতীয় ফ্রন্ট বামফ্রন্টের সহযোগিতায় নির্বাচনে জয়লাভ করে দু-বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে।[৫৫] ১৯৯১ সালে কোনও পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ না করতে পারায় কংগ্রেস পি ভি নরসিমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে একটি সংখ্যালঘু সরকার গঠন করে। এই সরকার অবশ্য পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সক্ষম হয়। [৫৬] ১৯৯৬-১৯৯৮ সালটি কেন্দ্রীয় সরকারের অস্থিরতার যুগ। এই সময় একাধিক স্বল্পকালীন জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালে সংক্ষিপ্ত সময়কালের জন্য বিজেপি সরকার গঠন করে। তারপর কংগ্রেস ও বিজেপি-বিরোধী যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৮ সালে বিজেপির নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) ক্ষমতা দখল করে। এই সরকারই ভারতের প্রথম পূর্ণ সময়কালের অকংগ্রেসি সরকার।[৫৭] ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট (ইউপিএ) লোকসভায় বিপুল সংখ্যক আসনে জয়লাভ করে এবং বিজেপি-বিরোধী বাম সাংসদদের সহায়তায় সরকার গঠন করে। ইউপিএ ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতায় আসে। তবে বামদলগুলি আর এই জোটের সমর্থক নয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আন্তরিক। ১৯৫০-এর দশকে ভারত আফ্রিকা ও এশিয়ার ইউরোপীয় উপনিবেশগুলির স্বাধীনতার স্বপক্ষে সওয়াল করে।[৫৯] শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ ও মালদ্বীপে অপারেশন ক্যাকটাস—এই দুই ক্ষেত্রে ভারত তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রে সামরিক মধ্যস্থতায় অংশ নেয়। কমনওয়েলথের এক সদস্য ভারত, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।[৬০] ভারত-চীন যুদ্ধ ও ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আন্তরিক হয়ে ওঠে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত সেই সম্পর্ক একই রকম থাকে। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের তিনটি যুদ্ধ হয়। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের সহায়ক হয়।[৬১] এছাড়াও ১৯৮৪ সালে সিয়াচেন হিমবাহ ও ১৯৯৯ সালে কার্গিলকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। ভারতের প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ করমর্দনরত, মার্চ ২০০৬। সাম্প্রতিককালে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। বর্তমানকালে, ভারত যে সকল প্রতিষ্ঠানে নিজ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে সেগুলি হল অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) [৬২], সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওন্যাল কো-অপারেশন (সার্ক) ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)।[৬৩] ভারত চারটি মহাদেশে রাষ্ট্রসংঘের ৩৫টি শান্তিরক্ষা অভিযানে প্রায় ৫৫,০০০ সেনা ও পুলিশ প্রেরণ করেছে।[১৩] ব্যাপক সমালোচনা ও সামরিক অনুমোদন সত্ত্বেও পরমাণু কর্মসূচির উপর সার্বভৌমত্ব রক্ষার খাতিরে ভারত কম্প্রিহেনসিভ নিউক্লিয়ার-টেস্ট-ব্যান ট্রিটি (সিটিবিটি) ও নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি (এনপিটি)-তে সই করতে উপর্যুপরি অস্বীকার করছে। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টার ফলে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলির সঙ্গেও ভারত সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। পাঁচটি রাষ্ট্রের নৌবহর, মালাবার ২০০৭, ভারত আয়োজিত বিশ্বের বৃহত্তম যুদ্ধক্রীড়া।[৬৪] স্থলসেনা, বায়ুসেনা ও নৌসেনা নিয়ে গঠিত ভারতের সামরিক বাহিনী বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম সামরিক বাহিনী।[৩৩] এই সামরিক বাহিনীর সমান্তরালে কাজ করে থাকে একাধিক সহকারী বাহিনী; যথা: আধাসামরিক বাহিনী, উপকূলরক্ষী বাহিনী ও স্ট্রাটেজিক ফোর্সেস কম্যান্ড । রাষ্ট্রপতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইসরায়েল ভারতের প্রধান অস্ত্রসরবরাহকারী রাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা সহকারী দেশ। প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংগঠন (ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গ্যানাইজেশন বা ডিআরডিও) ব্যালিস্টিক মিসাইল, যুদ্ধবিমান, যুদ্ধট্যাঙ্ক সহ দেশজ অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের কাজ তত্ত্ববধান করে, যাতে সামরিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে ভারতকে অধিক মাত্রায় বিদেশি আমদানির উপর নির্ভর করতে না হয়। ১৯৭৪ সালে স্মাইলিং বুদ্ধ ও ১৯৯৮ সালে পোখরান-২ নামে মোট ছয়টি প্রাথমিক পরমাণু পরীক্ষণের মাধ্যমে ভারত পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। যদিও ভারতের ঘোষিত পরমাণু নীতি হল “প্রথম প্রয়োগ নয়”।[৬৫] ১০ অক্টোবর, ২০০৮ তারিখে ভারত-মার্কিন বেসামরিক পরমাণু চুক্তি সাক্ষরিত হয়। তার পূর্বেই আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা ও নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ারস গ্রুপ ভারতের উপর থেকে পরমাণু প্রযুক্তি ক্রয়বিক্রয়ের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ফলে ভারত কার্যত পরিণত হয় বিশ্বের ষষ্ঠ পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে। ভারত ২৮টি রাজ্য ও সাতটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলবিশিষ্ট একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সাধারণতন্ত্র। ভারতে প্রত্যেক রাজ্যে নির্বাচিত রাজ্য সরকার অধিষ্ঠিত রয়েছে; নির্বাচিত সরকার রয়েছে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচেরি ও দিল্লিতেও। অপর পাঁচটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রাষ্ট্রপতির প্রত্যক্ষ শাসনাধীন; এই অঞ্চলগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রশাসক নিয়োগ করে থাকেন। ১৯৫৬ সালে রাজ্য পুনর্গঠন আইন বলে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলি স্থাপিত হয়।[৬৭] তারপর থেকে এই কাঠামোটি মোটামুটি অপরিবর্তিত রয়েছে। তৃণমূল স্তরে শাসন ও প্রশাসন পরিচালনার লক্ষ্যে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি মোট ৬১০টি জেলায় বিভক্ত।[৬৮] জেলাগুলি আবার মহকুমা বা তহসিলে এবং গ্রামে বিভক্ত। ভারতীয় উপমহাদেশের সিংহভাগ নিয়ে গঠিত ভারতীয় ভূখণ্ডটি ভারতীয় টেকটোনিক পাত ও ইন্দো-অস্ট্রেলীয় পাতের মধ্যস্থিত একটি গৌণ পাতের উপর অবস্থিত।[৬৯] এই ভূখণ্ড গঠনের প্রধান ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াটি শুরু হয় আজ থেকে ৭৫ কোটি বছর পূর্বে, যখন দক্ষিণের অতিমহাদেশ গন্ডোয়ানার অংশ হিসাবে ভারতীয় উপমহাদেশ উত্তর-পূর্ব দিকে সরতে শুরু করে। তৎকালীন অসংগঠিত ভারত মহাসাগরব্যাপী এই সরণ স্থায়ী হয় ৫০ কোটি বছর।[৬৯] এর পরে উপমহাদেশটির সঙ্গে ইউরেশীয় পাতের সংঘর্ষ ঘটে এবং উপমহাদেশের পাতটি ইউরেশীয় পাতের তলায় অবনমিত হয়ে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতমালা হিমালয়ের উত্থান ঘটায়। এই পর্বতমালা বর্তমানে ভারতের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিক বেষ্টন করে আছে।[৬৯] উত্থানশীল হিমালয়ের দক্ষিণ পাদদেশে অবস্থিত সমুদ্রে পাতসঞ্চরণের ফলে একটি বৃহৎ খাত সৃষ্টি হয়, এবং কালক্রমে নদীর পলি জমে[৭০] এই খাতটি গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে পরিণত হয়।[৭১] এই সমভূমির পশ্চিমে আরাবল্লী পর্বতশ্রেণী কর্তৃক বিচ্ছিন্ন হয়ে অবস্থান করছে থর মরুভূমি।[৭২] মূল ভারতীয় পাতটি আজ ভারতীয় উপদ্বীপ রূপে অবস্থান করছে। এটিই ভারতের প্রাচীনতম ও ভৌগোলিকভাবে সর্বাপেক্ষা দৃঢ় অংশ। উত্তরদিকে মধ্য ভারতে অবস্থিত সাতপুরা ও বিন্ধ্য পর্বতমালা পর্যন্ত এই উপদ্বীপ বিস্তৃত। এই সমান্তরাল পর্বতমালাদুটি পশ্চিমে গুজরাটের আরব সাগর উপকূল থেকে পূর্বে ঝাড়খণ্ডের কয়লা-সমৃদ্ধ ছোটনাগপুর মালভূমি পর্যন্ত ব্যাপ্ত।[৭৩] দক্ষিণে উপদ্বীপীয় ভূখণ্ডে দাক্ষিণাত্য মালভূমি বামে ও ডানে যথাক্রমে পশ্চিমঘাট ও পূর্বঘাট পর্বতমালাদ্বয় দ্বারা উপকূলীয় সমভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন।[৭৪] এই মালভূমিতেই ভারতের প্রাচীনতম প্রস্তরগঠনটি পরিলক্ষিত হয়; যার কিয়দংশের বয়স ১০০ কোটি বছরেরও বেশি। এইভাবে ভারত বিষুবরেখার উত্তরে ৬°৪৪' ও ৩৫°৩০' উত্তর অক্ষাংশ[৭৫] ও ৬৮°৭' ও ৯৭°২৫' পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।[ ভারতীয় উপকূলরেখার দৈর্ঘ্য ৭,৫১৭ কিলোমিটার (৪,৬৭১ মাইল)। এর মধ্যে ৫,৪২৩ কিলোমিটার (৩,৩৭০ মাইল) ভারতীয় উপদ্বীপের এবং ২,০৯৪ কিলোমিটার (১,৩০১ মাইল) আন্দামান, নিকোবর ও লাক্ষাদ্বীপের অন্তর্গত।[১৫] ভারতীয় নৌবাহিনীর হাইড্রোগ্রাফিক চার্ট অনুসারে মূল অঞ্চলের উপকূলভূমি ৪৩% বালুকাময় সৈকত, ১১% পাথুরে উপকূল ও ভৃগু (উঁচু খাড়া পাড় বা ক্লিফ), ৪৬% জলাজমিপূর্ণ উপকূল দ্বারা গঠিত। হিমালয় থেকে উৎপন্ন নদনদীগুলির মধ্যে প্রধান গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র। উভয়েই বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।[৭৭] গঙ্গার প্রধান উপনদীগুলি হল যমুনা ও কোশী নদী। কোশী নদীতে নাব্যতা অত্যন্ত কম থাকায় প্রতি বছর ভয়াল বন্যা দেখা দেয়। উপদ্বীপের প্রধান নদীগুলি হল গোদাবরী, মহানদী, কৃষ্ণা, ও কাবেরী। এই নদীগুলির খাত অত্যন্ত নাব্য হওয়ায় বন্যা কম হয়ে থাকে। এই নদীগুলিও বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।[৭৮] অন্যদিকে নর্মদা ও তাপ্তি পতিত হয়েছে আরব সাগরে।[৭৯] ভারতীয় উপকূলভূমির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল পশ্চিম ভারতে কচ্ছের রাণ ও পূর্বভারতে সুন্দরবনের পলিগঠিত বদ্বীপ অঞ্চল, যা ভারত ও বাংলাদেশে বিস্তৃত।[৮০] ভারতে দুটি দ্বীপপুঞ্জ দেখা যায়: ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলভাগের নিকটে প্রবালদ্বীপ লাক্ষাদ্বীপ এবং আন্দামান সাগরের আগ্নেয় দ্বীপমালা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ভারতের বৈচিত্র্যময় ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক উপাদানগুলি দেশের জলবায়ুকে অনেকাংশেই প্রভাবিত করে। কর্কটক্রান্তি রেখা ভারতের মাঝবরাবর প্রসারিত। কিন্তু দেশের উত্তর সীমান্ত বরাবর অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালা মধ্য এশিয়া থেকে আগত ক্যাটাবেটিক বায়ুপ্রবাহকে প্রতিরোধ করে দেশে ক্রান্তীয় জলবায়ু বজায় রাখতে সহায়তা করে।[৮২][৮৩] হিমালয় পর্বতমালা ও থর মরুভূমি দেশে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহকেও নিয়ন্ত্রণ করে।[৮৪] থর মরুভূমি গ্রীষ্মকালীন আর্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ুকে আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। জুন থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যবর্তী সময়ে আগত এই বায়ুপ্রবাহই ভারতে বর্ষার মূল কারণ।[৮৪] ভারতে চারটি প্রধান ঋতু দেখা যায়: শীত (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি), গ্রীষ্ম (মার্চ থেকে মে), বর্ষা (জুন থেকে সেপ্টেম্বর), এবং শরৎ ও হেমন্ত (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর)। ক্রান্তীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য অনুসারে বর্ষা ও অন্যান্য আবহাওয়াগত পরিস্থিতি দেশে খরা, বন্যা, সাইক্লোন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এর ফলে প্রতি বছর দেশটি লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ও সম্পত্তিহানির কারণ হয়। বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণায়ণের ফলে ভারতের জলবায়ুতে নানাপ্রকার অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। ইন্দোমালয় পরিবেশক্ষেত্রে অবস্থিত ভারত জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। ১৮টি মহাবৈচিত্র্যপূর্ণ রাষ্ট্রের একটি এই দেশ পৃথিবীর ৭.৬% স্তন্যপায়ী, ১২.৬% পাখি, ৬.২% সরীসৃপ, ৪.৪% উভচর, ১১.৭% মাছ ও ৬.০% সপুষ্পক উদ্ভিদের বাসস্থান।[৮৫] পশ্চিমঘাট পর্বতমালার শোলা বর্ষণারণ্যের মতো ভারতের অনেক অঞ্চলেই স্বাভাবিক উদ্ভিদের প্রাচুর্য দেখা যায়। ৩৩% ভারতীয় বৃক্ষপ্রজাতি স্বাভাবিক উদ্ভিদশ্রেণীর অন্তর্গত।[৮৬][৮৭] ভারতের প্রধান অরণ্যক্ষেত্রগুলি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিষুবীয় বর্ষণারণ্য থেকে হিমালয়ের চিরহরিৎ অরণ্যক্ষেত্র পর্যন্ত বিস্তৃত। এছাড়া পূর্ব ভারতের শাল-অধ্যুষিত, মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের টিক-অধ্যুষিত ও মধ্য দাক্ষিণাত্য ও গাঙ্গেয় সমভূমির বাবুল অধ্যুষিত বনাঞ্চলও উল্লেখযোগ্য।[৮৮] গ্রামীণ ভারতে নিম গাছ ঔষধি রূপে ব্যবহৃত হয়। পিপল গাছ মহেঞ্জোদাড়োর প্রতীকচিহ্নে দেখা গাছে। এই গাছের তলাতেই গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। বহু ভারতীয় প্রজাতি গন্ডোয়ানায় জাত টেক্সা থেকে উদ্ভুত। উপদ্বীপীয় ভারতের ক্রমসরণ ও ইউরেশীয় ভূমিভাগের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে প্রজাতিগুলির মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়। যদিও অগ্ন্যুৎপাত ও অন্যান্য জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে বিগত ২ কোটি বছরে বহু দেশজ প্রজাতিই অবলুপ্ত হয়ে যায়।[৮৯] এর ঠিক পরেই দুটি প্রাণীভৌগোলিক পথে উত্থানশীল হিমালয়ের দুই পাশ দিয়ে ভারতে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা প্রবেশ করে।[৮৮] প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের মোট স্তন্যপায়ী ও পাখিদের যথাক্রমে মাত্র ১২.৬% ও ৪.৫% দেশজ; যেখানে দেশের সরীসৃপ ও উভচরদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৪৫.৮% ও ৫৫.৮%।[৮৫] উল্লেখযোগ্য দেশীয় প্রাণী হল নীলগিরি লেঙ্গুর, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বাদামি ও গাঢ় লাল রঙের বেডোমি ব্যাঙ। ভারত ১৭২টি (২.৯%) আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ-গণিত লুপ্তপ্রায় প্রাণীর আবাসস্থল।[৯০] এর মধ্যে রয়েছে এশীয় সিংহ, বাংলা বাঘ, ভারতীয় শ্বেতপৃষ্ঠ শকুন (বর্তমানে প্রায় অবলুপ্ত)। বিগত দশকগুলিতে মানুষের অরণ্য আগ্রাসন বন্যপ্রাণী অবলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ১৯৩৫ সালে চালু হওয়া জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত স্থানের ব্যবস্থাটিকে ব্যাপ্ত করা হয়। ১৯৭২ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন[৯১] ও বাঘ সংরক্ষণের জন্য ব্যাঘ্র প্রকল্প চালু হয়। এর সঙ্গে ১৯৮০ সালে প্রবর্তিত হয় অরণ্য সংরক্ষণ আইন[৯২] ভারতে অভয়ারণ্যের সংখ্যা পাঁচশোর অধিক। সঙ্গে দেশে ১৩টি জৈবক্ষেত্র সংরক্ষণও করা হয়।[৯৩] এর মধ্যে চারটি বিশ্ব জৈবক্ষেত্র সংরক্ষণ নেটওয়ার্কের অন্তর্গত। রামসর কনভেনশন অনুসারে ভারতে পঁচিশটি জলাভূমি আছে; যার একটি কলকাতা মহানগরীর পূর্বভাগে অবস্থিত। ১৯৫০-এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত ভারত সমাজতান্ত্রিক-ধাঁচের অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করে চলে। স্বাধীনতা-উত্তর যুগের অধিকাংশ সময় জুড়ে ভারতে যে আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তাতে বেসরকারি উদ্যোগ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ওপর কঠোর সরকারি বিধিনিষেধ আরোপিত থাকত। ১৯৯১ সালে অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে ভারত তার বাজার উন্মুক্ত করে দেয়। বিদেশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উপর সরকারি কর্তৃত্ব শিথিল করা হয়।[৩৫] এর ধনাত্মক প্রভাবে মার্চ ১৯৯১ সালে ৫.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় ৪ জুলাই, ২০০৮ তারিখে বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।[৯৫] ঘাটতি কমে আসে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বাজেটগুলিতে।[৯৬] যদিও সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ এবং কোনও কোনও সরকারি খাত বেসরকারি ও বৈদেশিক অংশীদারদের নিকট মুক্ত করে দেওয়ায় রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়।[৯৭][৯৮] ভারতের মোট স্থুল আভ্যন্তরীক উৎপাদন বা জিডিপি ১.২৪৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার[১১] যা ক্রয়ক্ষমতা সমতার (পিপিপি) পরিমাপে ৪.৭২৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতূল্য। জিডিপি'র মানদণ্ডে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। চলতি মূল্যে ভারতের মাথাপিছু আয় ৯৭৭ মার্কিন ডলার (বিশ্বে ১২৮তম) যা ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) ভিত্তিক পরিমাপে ২,৭০০ মার্কিন ডলারের সমতূল্য (বিশ্বে ১১৮তম)। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে কৃষি প্রধান দেশ হিসাবে পরিচিত ভারতের বর্তমান জিডিপিতে পরিষেবা খাতের অবদান ৫৪ শতাংশ ; ইতিমধ্যে কৃষিখাতের অবদান হ্রাস পেয়ে ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং শিল্পখাতের অবদান মাত্র ১৮ শতাংশ। বিগত দুই দশকে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি ভারতের গড় বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৭ শতাংশ।[ ৫১৬.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমশক্তির দেশ। এই শক্তির ৬০ শতাংশ নিয়োজিত কৃষিখাতে ও কৃষিসংক্রান্ত শিল্পগুলিতে, ২৮ শতাংশ পরিষেবা ও পরিষেবা-সংক্রান্ত শিল্পে এবং ১২ শতাংশ নিযুক্ত শিল্পখাতে।[৩৩] প্রধান কৃষিজ ফসলগুলি হল ধান, গম, তৈলবীজ, তুলা, পাট, চা, আখ ও আলু। প্রধান শিল্পগুলি হল অটোমোবাইল, সিমেন্ট, রাসায়নিক, বৈদ্যুতিন ভোগ্যপণ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, যন্ত্রশিল্প, খনি, পেট্রোলিয়াম, ভেষজ, ইস্পাত, পরিবহণ উপকরণ ও বস্ত্রশিল্প। ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদগুলি হল আবাদি জমি, বক্সাইট, ক্রোমাইট, কয়লা, হিরে, আকরিক লৌহ, চুনাপাথর, ম্যাঙ্গানিজ, অভ্র, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও আকরিক টাইটানিয়াম।[৫৪] ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শক্তির চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, ভারত পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের ষষ্ঠ বৃহত্তম ও কয়লার তৃতীয় বৃহত্তম ভোক্তা।[১০০] বিগত দুই দশকের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ভারত বিশ্বের সর্বাপেক্ষা দারিদ্র্যপীড়িত রাষ্ট্র। শিশু-অপুষ্টির হারও বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় ভারতে সর্বাধিক: ২০০৭ সালের হিসেব অনুযায়ী ৪৬ শতাংশ) ।[১০১][১০২] তবে বিশ্বব্যাঙ্ক নির্ধারিত দৈনিক ১.২৫ মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখার (২০০৪ সালের হিসেব অনুযায়ী, ক্রয়ক্ষমতা সমতা নামমাত্র হিসেবে নগরাঞ্চলে দৈনিক ২১.৬ টাকা ও গ্রামাঞ্চলে দৈনিক ১৪.৩ টাকা) নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১৯৮১ সালে ৬০ শতাংশ থেকে ২০০৫ সালে ৪২ শতাংশে নেমে এসেছে। [১০৩] সাম্প্রতিক দশকগুলিতে ভারত মন্বন্তর প্রতিরোধ করতে পারলেও, দেশের অর্ধেক শিশু ওজন ঘাটতিতে ভুগছে। এই হার সারা বিশ্বের নিরিখে কেবল উচ্চই নয়, এমনকী সাব-সাহারান আফ্রিকার হারের প্রায় দ্বিগুণ।[১০৪] সাম্প্রতিককালে, ভারতের বহুসংখ্যক শিক্ষিত ইংরেজি-পটু প্রশিক্ষিত পেশাদারগণ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা, মেডিক্যাল ট্যুরিজমে ও আউটসোর্সিং-এর কাজে নিযুক্ত হয়েছেন।[১০৫] বর্তমানে ভারত সফটওয়্যার ও অর্থসংক্রান্ত, গবেষণাসংক্রান্ত ও প্রকৌশলগত পরিষেবার এক বৃহৎ রপ্তানিকারক। ২০০৭ সালে রপ্তানি ও আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ২১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।[১০৬] বস্ত্র, রত্ন, ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদি ও সফটওয়্যার ভারতের প্রধান রপ্তানি পণ্য। প্রধান প্রধান আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে অপরিশোধিত তেল, যন্ত্রপাতি, সার ও রাসায়নিক দ্রব্য। ভারতের প্রধানতম বাণিজ্য সহযোগী হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের সদর দপ্তর দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী নামে খ্যাত মুম্বই মহানগরীতে অবস্থিত। ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল রাষ্ট্র। ২০০৯ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশটির আনুমানিক জনসংখ্যা প্রায় ১১৬ কোটি।[৩৩] যদিও সাম্প্রতিক দশকগুলিতে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতে শহরাঞ্চলীয় জনসংখ্যা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, তথাপি ৭০ শতাংশ ভারতবাসী গ্রামাঞ্চলে বাস করেন। ভারতের বৃহত্তম মহানগরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মুম্বাই (পূর্বনাম বম্বে বা বোম্বাই), নতুন দিল্লি, বেঙ্গালুরু (পূর্বনাম ব্যাঙ্গালোর), কলকাতা, হায়দ্রাবাদ ও আহমদাবাদ।[৫৪] আফ্রিকা মহাদেশের পরেই ভারত সংস্কৃতি, ভাষা ও জাতিগতভাবে বিশ্বে সর্বাধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল।[৫৪] ভারতের দু’টি প্রধান ভাষাগোষ্ঠী হল ইন্দো-আর্য (মোট জনসংখ্যার ৭৪%) ও দ্রাবিড় (মোট জনসংখ্যার ২৪%)। অপরাপর ভাষাগোষ্ঠীগুলি হল অস্ট্রো-এশিয়াটিক ও টিবেটো-বার্মান ভাষাগোষ্ঠী। ভারতের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীয় ভাষা হিন্দি[১০৭] যা কি-না কেন্দ্রীয় সরকারের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে নির্ধারিত।[১০৮] “সহকারী দাপ্তরিক ভাষা” ইংরেজি প্রশাসন ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত।[১০৯] উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ইংরেজির প্রাধান্য প্রশ্নাতীত। ভারতের সংবিধান বাংলা-সহ ২১টি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছে। এগুলি হয় প্রচলিত, নয় ধ্রুপদি ভাষা। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে ধ্রুপদি ভাষার মর্যাদা পেয়ে আসা তামিল ও সংস্কৃত[১১০] এবং কন্নড় ও তেলুগু ভাষাকে ভারত সরকার নিজস্ব একটি যোগ্যতাসূচকবলে ধ্রুপদি ভাষার মর্যাদা দান করেছেন।[১১১] ভারতে উপ-ভাষার সংখ্যা ১,৬৫২টি।[১১২] ৮০ কোটিরও বেশি (৮০.৫%) ভারতবাসী হিন্দু। অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়গুলির মধ্যে রয়েছে মুসলমান (১৩.৪%), খ্রিস্টান (২.৩%), শিখ (১.৯%), বৌদ্ধ (০.৮%), জৈন (০.৪%), ইহুদি, পারসি ও বাহাই ধর্মাবলম্বী মানুষ।[১১৩] উল্লেখ্য, ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা সমগ্র বিশ্বের নিরিখে তৃতীয় বৃহত্তম এবং অ-মুসলমান প্রধান দেশগুলির মধ্যে বৃহত্তম। দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা ৮.১%।[১১৪] ভারতে সাক্ষরতার হার ৬৪.৮% (৫৩.৭% মহিলা ও ৭৫.৩% পুরুষ)।[৩৩] সাক্ষরতার হার সর্বাধিক কেরল রাজ্যে (৯১%);[১১৫] সর্বনিম্ন বিহারে (৪৭%)।[১১৬] জাতীয় পর্যায়ে লিঙ্গানুপাত প্রতি হাজার পুরুষের বিপরীতে ৯৪৪ জন মহিলা। গড় মধ্যবয়স ২৪.৯ বৎসর। বাৎসরিক জন্মহার প্রতি হাজার জনে ২২.১ জন। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৮%।[ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের[১১৮] মধ্যে ঐক্য[১১৯] ভারতীয় সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই সংস্কৃতি স্বকীয় ঐতিহ্যরক্ষার পাশাপাশি বৈদেশিক আক্রমণকারী ও বহিরাগত জাতিগুলির থেকে গ্রহণ করা রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও ধারণা অঙ্গীভূত করে এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের সংস্কৃতির উপরর নিজ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতীয় স্থাপত্য এমন একটি বিষয় যার মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির এই বৈচিত্র্যময় রূপটি ধরা পড়ে। তাজমহল ও অন্যান্য মুঘল স্থাপত্য নিদর্শন তথা দ্রাবিড় স্থাপত্য নিদর্শনগুলির মধ্যে ভারত ও বহির্ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাচীন ও স্থানীয় ঐতিহ্যের সম্মিলন লক্ষিত হয়। ভারতের স্থানীয় স্থাপত্যশৈলীগুলিও দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক স্থাপত্য-বৈচিত্র্যের সাক্ষী। ভারতীয় সঙ্গীতের জগৎটি গঠিত হয়েছে ধ্রুপদি ও আঞ্চলিক সংগীতধারার সংমিশ্রণে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত দুটি ধারায় বিভক্ত – উত্তর ভারতের হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটিক সংগীত। এই দুই প্রধান সংগীতধারা থেকে আবার উৎসারিত হয়েছে অনেক উপধারা। আঞ্চলিক জনপ্রিয় সঙ্গীতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রসংগীত, হিন্দি ফিল্মি গান ও ইন্ডি-পপ এবং বাউল ও অন্যান্য বিভিন্ন প্রকার লোকসংগীত। ভারতীয় নৃত্যকলাও “লোক” ও “ধ্রুপদী”—এই দুই প্রধান ভাগে বিভক্ত। ভারতের বিখ্যাত লোকনৃত্যগুলি হল পাঞ্জাবের ভাংড়া, অসমের বিহু নৃত্য, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার ছৌ নাচ এবং রাজস্থানের ঘুমার। ভারতের সঙ্গীত নাটক অকাদেমী দেশের আটটি নৃত্যকলাকে ধ্রুপদি ভারতীয় নৃত্য আখ্যা দিয়েছে। এগুলি হল তামিলনাড়ুর ভরতনট্যম, উত্তর প্রদেশের কত্থক, কেরলের কথাকলি ও মোহিনীঅট্টম, অন্ধ্রপ্রদেশের কুচিপুডি, মণিপুরের মণিপুরি, ওড়িশার ওড়িশি এবং অসমের সত্রিয় নাচ।[১২০] এই নৃত্যশৈলীগুলি বর্ণনাত্মক ও পৌরাণিক ঘটনাকেন্দ্রিক। ভারতীয় নাটকের বৈশিষ্ট্য হল সংগীত, নৃত্য ও তাৎক্ষণিক বা লিখিত সংলাপের যুগলবন্দী।[১২৬] এর বিষয়বস্তু কখনও পুরাণ থেকে, কখনও মধ্যযুগীয় প্রেমকাহিনিগুলি থেকে, কখনও আবার একালের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি থেকে গৃহীত। ভারতের লোকনাট্যের মধ্যে গুজরাটের ভাবাই, পশ্চিমবঙ্গের যাত্রা, উত্তর ভারতের নৌটঙ্কি ও রামলীলা, মহারাষ্ট্রের তামাশা, অন্ধ্রপ্রদেশের বুরাকথা, তামিলনাড়ুর তেরুককুত্তু ও কর্ণাটকের যক্ষগণ উল্লেখযোগ্য।[১২৭] ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্প সমগ্র বিশ্বের বৃহত্তম চলচ্চিত্র শিল্প।[১২৮] বাণিজ্যিক হিন্দি সিনেমা প্রস্তুতকারক বলিউড বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি।[১২৯] এছাড়াও বাংলা, কন্নড়, মালয়ালম, মারাঠি, তামিল ও তেলুগু ভাষায় ঐতিহ্যবাহী চলচ্চিত্র শিল্পের আছে।[১৩০] ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্য প্রথমে মৌখিকভাবে ও পরে লিখিত আকারে প্রচলিত হয়।[১৩১] এই রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেদ, ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত, নাটক অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ ইত্যাদি সংস্কৃত সাহিত্যের ধ্রুপদী কীর্তিসমূহ[১৩২] এবং তামিলে রচিত সঙ্গম সাহিত্য।[১৩৩] আধুনিক কালের ভারতীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য হলেন ১৯১৩ সালে দেশের প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়াও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যরচনার জন্য ভারতীয় অথবা ভারতীয় বংশোদ্ভুত যেসকল লেখকগণ সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁরা হলেন অমিতাভ ঘোষ, মার্কিন-প্রবাসী বাঙালি সাহিত্যিক ঝুম্পা লাহিড়ী, নোবেলজয়ী ব্রিটিশ-ভারতীয় সাহিত্যিক ভি এস নাইপল প্রমুখ। ভারতীয় রন্ধনশৈলীর বিশেষত্ব হল বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ আঞ্চলিক রন্ধনপ্রণালী এবং ভেষজ ও মশলার অভিজাত প্রয়োগ। দেশের প্রধান খাদ্য ভাত (পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে) ও রুটি (মূলত উত্তর ভারতে)।[১৩৪] ভারতে পোষাকের ঐতিহ্য রং, ধরন ও জলবায়ুর মতো বিভিন্ন কারণে অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন। থানকাপড়ের পোষাক হিসাবে মহিলাদের ক্ষেত্রে শাড়ি ও পুরুষদের ক্ষেত্রে ধুতি বা লুঙ্গি বিশেষ জনপ্রিয়। এছাড়া সেলাই-করা পোষাকের মধ্যে মহিলাদের সালোয়ার-কামিজ ও পুরুষদের কুর্তা-পাজামা বা ইউরোপীয়-ধাঁচে ট্রাউজার্স ও শার্ট বিশেষভাবে প্রচলিত। ভারতে উৎসব প্রকৃতিগতভাবে ধর্মীয়। যদিও অনেক ধর্ম ও জাতি নিরপেক্ষ উৎসবও পালিত হয়ে থাকে। দীপাবলি, গণেশ চতুর্থী, উগাদি, পোঙ্গল, দোলযাত্রা, ওনাম, দশেরা, দুর্গাপূজা, ঈদুল ফিত্‌র, ঈদুল আজহা, বড়দিন, বুদ্ধজয়ন্তী, বৈশাখী প্রভৃতি কয়েকটি জনপ্রিয় উৎসব।[১৩৫] ভারতে তিনটি জাতীয় উৎসব পালিত হয়; এগুলি হল স্বাধীনতা দিবস, সাধারণতন্ত্র দিবস ও গান্ধী জয়ন্তী। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক উৎসবও যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। ধর্মাচরণও দৈনন্দিন ও গণজীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে গণ্য হয়। ভারতে সনাতন পারিবারিক মূল্য বিশেষ সম্মানের অধিকারী। একাধিক প্রজন্মের মিলনক্ষেত্র পিতৃতান্ত্রিক যৌথ পরিবারগুলিই ভারতীয় পরিবারতন্ত্রের আদর্শ বলে বিবেচিত হয়। যদিও আজকাল নগরাঞ্চলগুলিতে ছোটো ছোটো নিউক্লিয়ার পরিবারের উদ্ভব ঘটতে দেখা যায়।[১৩৬] ভারতে বিবাহ আয়োজিত হয় পাত্র ও পাত্রীর পিতামাতা ও অন্যান্য গুরুজনস্থানীয় আত্মীয়বর্গের সম্মতিক্রমে। আয়োজিত বিবাহ ভারতে এক অতিমাত্রায় লক্ষিত বিবাহরীতি।[১৩৭] বিবাহবন্ধন সারাজীবনের বন্ধন বলে বিবেচিত হয়।[১৩৭] তাই এদেশে বিবাহবিচ্ছেদের হারও অত্যন্ত কম।[১৩৮] ভারতে বাল্যবিবাহ প্রথা আজও প্রচলিত। দেশের অর্ধেকেরও বেশি নারী বিবাহের আইনসম্মত বয়স আঠারো বছরে পা রাখার পূর্বেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে অতি প্রাচীন কাল থেকেই ভারত তার নিজস্ব স্বাক্ষর রেখে এসেছে। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে ভারতীয় ধাতুবিদগণ দিল্লির লৌহস্তম্ভটি নির্মাণ করেন। বেদাঙ্গ জ্যোতিষ গ্রন্থে সেযুগের মহাকাশ পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিকতাবাদ প্রস্তাবনার ১০০০ বছর আগেই ভারতীয় গণিতবিদ তথা জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট প্রাচীন বিশ্বধারণার ভ্রান্ততা প্রমাণ করেছিলেন। প্রাচীন বিশ্বে একমাত্র ভারতেই গড়ে উঠেছিল হীরের খনি। ভারতীয় গণিতজ্ঞ শ্রীনিবাস রামানুজন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের অন্যতম বলে বিবেচিত হন। ১৯২৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ভারতীয় পদার্থবিদ চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন। বেঙ্গালুরুতে ইনফোসিস গণমাধ্যম কেন্দ্র স্বাধীনোত্তর ভারতকে একটি দরিদ্র রাষ্ট্র বলে বিবেচনা করা হলেও, স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ দশকের মধ্যেই এই দেশ প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার এক মহাশক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সাক্ষরতার হার ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নগরকেন্দ্রের উদ্ভব ভারতের এই প্রযুক্তিগত উত্থানের কারণ। ১৯৭৫ সালে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ আর্যভট্টের উৎক্ষেপন, তার পূর্ববর্তী বছরে স্মাইলিং বুদ্ধ নামে এক ভূগর্ভস্থ পারমানবিক পরীক্ষণ, দূরসংযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পারমানবিক চুল্লি ও হোমি জাহাঙ্গির ভাবা পরিচালিত বিএআরসি-এর মতো গবেষণাকেন্দ্রের বিকাশ ভারতের উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক সাফল্য বলে বিবেচিত হয়।[১৪১] লো-আর্থ, মেরু ও জিওস্টেশনারি কক্ষপথে উপগ্রহ উৎক্ষেপনের এক দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে ভারত। এএসএলভি, পিএসএলভি, জিএসএলভি ও সর্বোপরি ইনস্যাট কৃত্রিম উপগ্রহ সিরিজগুলি ভারতের সফল মহাকাশ-কর্মসূচির স্বাক্ষর। ২০০৮ সালে চাঁদের মাটিতে অবতীর্ণ হয় প্রথম ভারতীয় মহাকাশযান চন্দ্রযান-১। দেশীয় বিমানশক্তির ক্ষেত্রে বৈকল্পিক শক্তি হিসেবে অ্যাডভান্সড লাইট হেলিকপ্টার ও এলসিএ তেজস-এর নাম করা যায়। লারসেন অ্যান্ড টাব্রো, ডিএফএল-এর মতো কোম্পানিগুলির সাহায্যে আবাসন ও পরিকাঠামো শিল্পেও ভারত আজ উল্লেখযোগ্যভাবে অগ্রসর। ২০০৩ সালে সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অফ অ্যাডভান্সড কম্পিউটিং তৈরি করে ভারতের প্রথম সুপারকম্পিউটার পরম পদ্ম। এটি পৃথিবীর দ্রুততম সুপারকম্পিউটারগুলির অন্যতম।[১৪২] ১৯৯০-এর দশকে অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং তথ্য প্রযুক্তি বিপ্লব তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় এক অগ্রণী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে বিশ্বের মঞ্চে উপস্থাপিত করে। বর্তমানে আই বি এম, মাইক্রোসফট, সিসকো সিস্টেমস, ইনফোসিস, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিস, উইপ্রো ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলি ভারতের বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই প্রভৃতি শহরে তাদের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেছে। ভারতের জাতীয় খেলা ফিল্ড হকি। ইন্ডিয়ান হকি ফেডারেশনের উপর এদেশের হকি পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত। ভারতীয় হকি দল ১৯৭৫ সালের পুরুষদের হকি বিশ্বকাপ ও একাধিক অলিম্পিক মেডেল বিজয়ী। যদিও ভারতে সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলা হল ক্রিকেট। ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দল ১৯৮৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ২০০৭ সালের আইসিসি বিশ্ব টোয়েন্টি-২০ এবং ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ বিজয়ী ।এছাড়াও ২০০৩ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ ও ২০১৪ সালে আইসিসি বিশ্ব টোয়েন্টি-২০ তে ফাইনালে পরাজিত হয় । ভারতে ক্রিকেট পরিচালিত হয় বোর্ড অফ কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) কর্তৃক। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট প্রতিযোগিতাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য রনজি ট্রফি, দলীপ ট্রফি, দেওধর ট্রফি, ইরানি ট্রফি ও চ্যালেঞ্জার সিরিজ। ভারতের জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা দেশে প্রভূত জনপ্রিয়তা ও নানাবিধ বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী। ভারতীয় দলের ডেভিস কাপ বিজয়ের পর থেকে ভারতে টেনিসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে ফুটবল পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর-পূর্ব ভারত, গোয়া ও কেরলে বেশ জনপ্রিয়।[১৪৩] ভারত জাতীয় ফুটবল দল বহুবার সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন কাপ জিতেছে। ভারত ১৯৫১ ও ১৯৮২ সালে এশিয়ান গেমস আয়োজন করেছিল। এছাড়াও ভারত ছিল ১৯৮৭ ও ১৯৯৬ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক দেশ ছিল; ভারত ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক দেশ। দাবা খেলার উদ্ভবও হয়েছিল ভারতে। দেশে গ্রান্ডমাস্টার দাবাড়ুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আজ দাবা ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় একটি খেলা।[১৪৪] এছাড়াও দেশের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় খেলা হল কাবাডি, খো খো, ও গুলি ডান্ডা ইত্যাদি। ভারতে প্রাচীন যোগব্যায়াম এবং বিভিন্ন ভারতীয় মার্শাল আর্ট, কালারিপ্পায়াত্তু, বার্মা কলাই ইত্যাদি আজও জনপ্রিয়। ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক ক্রীড়া পুরস্কার হল রাজীব গান্ধী খেলরত্ন ও অর্জুন পুরস্কার (খেলোয়াড়দের জন্য) এব দ্রোণাচার্য পুরস্কার (কোচিং-এর জন্য)। %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A5_%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B0 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১)[১] (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ - ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)[১] ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক।[২] তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়।[৩] রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়।[৪] রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ,[৫] ৩৮টি নাটক,[৬] ১৩টি উপন্যাস[৭] ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন[৮] তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প[৯] ও ১৯১৫টি গান[১০] যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে।[১১] রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত।[১২] এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন।[১৩] রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।[১৪] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[১৫][১৬][১৭][১৮] বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি; গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।[১৯] আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন।ক[›][২০] ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তাঁর "অভিলাষ" কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা।[২১] ১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান।[২২] ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।[২২] ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন।[২২] ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন।[২৩] ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়।[২৩] ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।[২৩] ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন।[২৩] কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন।[২৪] ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।[২৫] ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়।[২৬] দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন।[২৫] ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মৃত্যু হয়।[২৭] রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা।[২৮] রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক।[২৯] ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।[৩০] কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন।[৩১] সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন।[৩২] এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।[৩৩] রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে; রবীন্দ্রনাথ দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন।[৩৪] সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন।[৩৫] রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি।[৩৬] তাঁর রচিত আমার সোনার বাংলা ও জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে গানদুটি যথাক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫)[৩৮] এবং মাতা ছিলেন সারদাসুন্দরী দেবী (১৮২৬–১৮৭৫)।[৩৯] রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান।খ[›][৪০] জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের প্রবক্তা।[৪১][৪২] রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষেরা খুলনা জেলার রূপসা উপজেলা পিঠাভোগে বাস করতেন।[৪৩] ১৮৭৫ সালে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের মাতৃবিয়োগ ঘটে।[২২] পিতা দেবেন্দ্রনাথ দেশভ্রমণের নেশায় বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে অতিবাহিত করতেন। তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে।[৪৪][৪৫] শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন।[৪৬] কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।[৪৭] ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করতেন রবীন্দ্রনাথ।[৪৮][৪৯] ১৮৭৩ সালে এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।[২১] এরপর তিনি কয়েক মাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন।[২১] প্রথমে তাঁরা আসেন শান্তিনিকেতনে।[৫০] এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল কাটিয়ে শিখদের উপাসনা পদ্ধতি পরিদর্শন করেন।[৫০] শেষে পুত্রকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যান পাঞ্জাবেরই (অধুনা ভারতের হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত) ডালহৌসি শৈলশহরের নিকট বক্রোটায়।[৫০] এখানকার বক্রোটা বাংলোয় বসে রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন।[৫০] দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জীবনী, কালিদাস রচিত ধ্রুপদি সংস্কৃত কাব্য ও নাটক এবং উপনিষদ্‌ পাঠেও উৎসাহিত করতেন।[৫১][৫২] ১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকায় তরুণ রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এগুলি হল মাইকেল মধুসূদনের "মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা", ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী এবং "ভিখারিণী" ও "করুণা" নামে দুটি গল্প। এর মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কবিতাগুলি রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলির অনুকরণে "ভানুসিংহ" ভণিতায় রচিত।[৫৩] রবীন্দ্রনাথের "ভিখারিণী" গল্পটি (১৮৭৭) বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটগল্প।[৫৪][৫৫] ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ তথা প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ কবিকাহিনী।[৫৬] এছাড়া এই পর্বে তিনি রচনা করেছিলেন সন্ধ্যাসংগীত (১৮৮২) কাব্যগ্রন্থটি। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ" এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান রবীন্দ্রনাথ।[৫৮] প্রথমে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।[৫৮] ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি।[৫৮] ইংল্যান্ডে থাকাকালীন শেকসপিয়র ও অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। এই সময় তিনি বিশেষ মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন রিলিজিও মেদিচি, কোরিওলেনাস এবং অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা।[৫৯] এই সময় তাঁর ইংল্যান্ডবাসের অভিজ্ঞতার কথা ভারতী পত্রিকায় পত্রাকারে পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথ। উক্ত পত্রিকায় এই লেখাগুলি জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমালোচনাসহ[৫৮] প্রকাশিত হত য়ুরোপযাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্রধারা নামে।[২২] ১৮৮১ সালে সেই পত্রাবলি য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র নামে গ্রন্থাকারে ছাপা হয়। এটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা প্রথম চলিত ভাষায় লেখা গ্রন্থ।[৫৮] অবশেষে ১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে এবং ব্যারিস্টারি পড়া শুরু না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।[৫৮] ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়।[৬০] বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী (১৮৭৩–১৯০২ )।[৬০] রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর সন্তান ছিলেন পাঁচ জন: মাধুরীলতা (১৮৮৬–১৯১৮), রথীন্দ্রনাথ (১৮৮৮–১৯৬১), রেণুকা (১৮৯১–১৯০৩), মীরা (১৮৯৪–১৯৬৯) এবং শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬–১৯০৭)।[৬০] এঁদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে।[৬১] শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, বর্তমান চিত্র ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া (নদিয়ার উক্ত অংশটি অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা), পাবনা ও রাজশাহী জেলা এবং উড়িষ্যার জমিদারিগুলির তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ।[৬২] কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। জমিদার রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে "পদ্মা" নামে একটি বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় চড়ে প্রজাবর্গের কাছে খাজনা আদায় ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে যেতেন। গ্রামবাসীরাও তাঁর সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করত।[৬৩] ১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথের অপর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ মানসী প্রকাশিত হয়। কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে তাঁর আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ও গীতিসংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলি হলো প্রভাতসংগীত, শৈশবসঙ্গীত, রবিচ্ছায়া, কড়ি ও কোমল ইত্যাদি।[৬৪] ১৮৯১ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত নিজের সম্পাদিত সাধনা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু উৎকৃষ্ট রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর সাহিত্যজীবনের এই পর্যায়টি তাই "সাধনা পর্যায়" নামে পরিচিত।[৪৪] রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ গ্রন্থের প্রথম চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই এই পর্যায়ের রচনা।[৫৪] এই ছোটগল্পগুলিতে তিনি বাংলার গ্রামীণ জনজীবনের এক আবেগময় ও শ্লেষাত্মক চিত্র এঁকেছিলেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহ ছেড়ে চলে আসেন বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে।[৬৬] এখানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৮ সালে একটি আশ্রম ও ১৮৯১ সালে একটি ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[৬৭] আশ্রমের আম্রকুঞ্জ উদ্যানে একটি গ্রন্থাগার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালু করলেন "ব্রহ্মবিদ্যালয়" বা "ব্রহ্মচর্যাশ্র" নামে একটি পরীক্ষামূলক স্কুল।[৬৮] ১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মারা যান।[৬৯] এরপর ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কন্যা রেণুকা,[৭০] ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর[৭১] ও ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।[৭১] এসবের মধ্যেই ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন।[৭২] ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান আধুনিক কৃষি ও গোপালন বিদ্যা শেখার জন্য।[৭৩] ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[৭৪] এই সময় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে অর্থসংকট তীব্র হয়ে ওঠে। পাশাপাশি পুত্র ও জামাতার বিদেশে পড়াশোনার ব্যয়ভারও রবীন্দ্রনাথকে বহন করতে হয়।[৭৪] এমতাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর গয়না ও পুরীর বসতবাড়িটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।[৭৫] ইতোমধ্যেই অবশ্য বাংলা ও বহির্বঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯০১ সালে নৈবেদ্য ও ১৯০৬ সালে খেয়া কাব্যগ্রন্থের পর ১৯১০ সালে তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়।[৫][৭৬] ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি (ইংরেজি অনুবাদ, ১৯১২) কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে।গ[›][৭৭] ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'স্যার' উপাধি (নাইটহুড) দেয়।[৭৮] ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুল গ্রামে মার্কিন কৃষি-অর্থনীতিবিদ লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতনের আরও কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের সহায়তায় রবীন্দ্রনাথ "পল্লীসংগঠন কেন্দ্র" নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।[৭৯] এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতিসাধন, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ নিবারণ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপন, চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং সাধারণ গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি করা।[৭৯] ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ এই সংস্থার নাম পরিবর্তন করে রাখেন "শ্রীনিকেতন"।[৮০] শ্রীনিকেতন ছিল মহাত্মা গান্ধীর প্রতীক ও প্রতিবাদসর্বস্ব স্বরাজ আন্দোলনের একটি বিকল্প ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীর আন্দোলনের পন্থা-বিরোধী ছিলেন।[৮১] পরবর্তীকালে দেশ ও বিদেশের একাধিক বিশেষজ্ঞ, দাতা ও অন্যান্য পদাধিকারীরা শ্রীনিকেতনের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য পাঠিয়েছিলেন।[৮২][৮৩] ১৯৩০-এর দশকের প্রথম ভাগে একাধিক বক্তৃতা, গান ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথা ও অস্পৃশ্যতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। জীবনের শেষ দশকে (১৯৩২-১৯৪১) রবীন্দ্রনাথের মোট পঞ্চাশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।[৮৬] তাঁর এই সময়কার কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫), শ্যামলী ও পত্রপুট (১৯৩৬) – এই গদ্যকবিতা সংকলন তিনটি।[৫] জীবনের এই পর্বে সাহিত্যের নানা শাখায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল হলো তাঁর একাধিক গদ্যগীতিকা ও নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬; চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২) কাব্যনাট্যের নৃত্যাভিনয়-উপযোগী রূপ) [৮৭], শ্যামা (১৯৩৯) ও চণ্ডালিকা (১৯৩৯) নৃত্যনাট্যত্রয়ী।[৮৮] এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ তিনটি উপন্যাসও (দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪)) এই পর্বে রচনা করেছিলেন।[৭] তাঁর অধিকাংশ ছবি জীবনের এই পর্বেই আঁকা।[১৩] এর সঙ্গে সঙ্গে জীবনের শেষ বছরগুলিতে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন বিশ্বপরিচয়।[৮৯] এই গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তগুলি সরল বাংলা গদ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।[৮৯] পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তাঁর কাব্যেও।[৯০] সে (১৯৩৭), তিন সঙ্গী (১৯৪০) ও গল্পসল্প (১৯৪১) গল্পসংকলন তিনটিতে তাঁর বিজ্ঞানী চরিত্র-কেন্দ্রিক একাধিক গল্প সংকলিত হয়েছে।[৯১] জীবনের এই পর্বে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্রতম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ বিহার প্রদেশে ভূমিকম্পে শতাধিক মানুষের মৃত্যুকে গান্ধীজি "ঈশ্বরের রোষ" বলে অভিহিত করলে, রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির এহেন বক্তব্যকে অবৈজ্ঞানিক বলে চিহ্নিত করেন এবং প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করেন।[৯২] কলকাতার সাধারণ মানুষের আর্থিক দুরবস্থা ও ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের দ্রুত আর্থসামাজিক অবক্ষয় তাঁকে বিশেষভাবে বিচলিত করে তুলেছিল। গদ্যছন্দে রচিত একটি শত-পংক্তির কবিতায় তিনি এই ঘটনা চিত্রায়িতও করেছিলেন।[৯৩][৯৪] জীবনের শেষ চার বছর ছিল তাঁর ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতার সময়।[৯৫] এই সময়ের মধ্যে দুইবার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল তাঁকে।[৯৫] ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল কবির।[৯৫] সেবার সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সেরে উঠতে পারেননি।[৯৫] এই সময়পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি ছিল মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজিত কিছু অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা।[৯৫][৯৬] মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল ছিলেন।[২৭] দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট বারো বার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন।[৯৯] ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন।[১০০] প্রথম জীবনে দুই বার (১৮৭৮ ও ১৮৯০ সালে) তিনি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন।[৯৯] ১৯১২ সালে ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গিয়ে ইয়েটস প্রমুখ কয়েকজন ইংরেজ কবি ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে সদ্যরচিত গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শোনান।[৯৯] কবিতাগুলি শুনে তাঁরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন।[৯৯] ইয়েটস স্বয়ং উক্ত কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকাটি লিখে দিয়েছিলেন।[১০১] এই ভ্রমণের সময়েই "দীনবন্ধু" চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে।[১০২] ১৯১৩ সালে সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করে।[৯৯] ১৯১৬-১৭ সালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কতকগুলি বক্তৃতা দেন।[১০৩][১০৪][১০৫] এই বক্তৃতাগুলি সংকলিত হয় তাঁর ন্যাশনালিজম (১৯১৭) গ্রন্থে।[৯৯][১০৬] তবে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিরূপ মতামত উক্ত দুই দেশে সেই সফরকালে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।[৯৯] ১৯২০-২১ সাল নাগাদ আবার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান কবি।[৯৯] এই সফরের সময় পাশ্চাত্য দেশগুলিতে তিনি সংবর্ধিত হয়েছিলেন।[৯৯] ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যান চীন সফরে।[৯৯] এরপর চীন থেকে জাপানে গিয়ে সেখানেও জাতীয়তাবাদবিরোধী বক্তৃতা দেন কবি।[৯৯] ১৯২৪ সালের শেষের দিকে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে যাওয়ার পথে আর্জেন্টিনায় অসুস্থ হয়ে কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্যে তিন মাস কাটান।[১০৭] স্বাস্থ্যের কারণে পেরু ভ্রমণ তিনি স্থগিত করে দেন।[১০৮] পরে পেরু ও মেক্সিকো উভয় দেশের সরকারই বিশ্বভারতীকে ১,০০,০০০ মার্কিন ডলার অর্থসাহায্য প্রদান করেছিল।[১০৯] ১৯২৬ সালে বেনিতো মুসোলিনির আমন্ত্রণে ইতালি সফরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[১১০] প্রথমে মুসোলিনির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলেও, পরে লোকমুখে তাঁর স্বৈরাচারের কথা জানতে পেরে, মুসোলিনির কাজকর্মের সমালোচনা করেন কবি। এর ফলে উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ছেদ পড়ে।[১১১] এরপর রবীন্দ্রনাথ গ্রিস, তুরস্ক ও মিশর ভ্রমণ করে ভারতে ফিরে আসেন। ১৯২৭ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ চার সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরে। এই সময় তিনি ভ্রমণ করেন বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর।[১১৩] ১৯৩০ সালে কবি শেষবার ইংল্যান্ডে যান অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দেওয়ার জন্য।[৯৯] এরপর তিনি ভ্রমণ করেন ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।[১১৪][১১৫][১১৬] ১৯৩২ সালে ইরাক ও পারস্য ভ্রমণে গিয়েছিলেন কবি।[৯৯] এরপর ১৯৩৪ সালে সিংহলে যান রবীন্দ্রনাথ। এটিই ছিল তাঁর সর্বশেষ বিদেশ সফর।[১১৭][১১৮] রবীন্দ্রনাথ যেসকল বইতে তাঁর বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখেন সেগুলি হল: য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র (১৮৮১), য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি (১৮৯১, ১৮৯৩), জাপান-যাত্রী (১৯১৯), যাত্রী (পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি ও জাভা-যাত্রীর পত্র, ১৯২৯), রাশিয়ার চিঠি (১৯৩১), পারস্যে (১৯৩৬) ও পথের সঞ্চয় (১৯৩৯)।[৯৯] ব্যাপক বিশ্বভ্রমণের ফলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমসাময়িক অরিঁ বের্গসঁ, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, রোম্যাঁ রোলাঁ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন।[১১৯][১২০] জীবনের একেবারে শেষপর্বে পারস্য, ইরাক ও সিংহল ভ্রমণের সময় মানুষের পারস্পরিক ভেদাভেদ ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর বিতৃষ্ণা আরও তীব্র হয়েছিল মাত্র।[১২১] অন্যদিকে বিশ্বপরিক্রমার ফলে ভারতের বাইরে নিজের রচনাকে পরিচিত করে তোলার এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিনিময়ের সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মূলত এক কবি। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কাব্যরচনা শুরু করেন। তাঁর প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২। তবে বাঙালি সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রধানত সংগীতস্রষ্টা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ প্রায় দুই হাজার গান লিখেছিলেন। কবিতা ও গান ছাড়াও তিনি ১৩টি উপন্যাস, ৯৫টি ছোটগল্প, ৩৬টি প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ এবং ৩৮টি নাটক রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনা রবীন্দ্র রচনাবলী নামে ৩২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর সামগ্রিক চিঠিপত্র উনিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রবর্তিত নৃত্যশৈলী "রবীন্দ্রনৃত্য" নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জীবনে ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তীর (১৮৩৫-১৮৯৪) অনুসারী কবি।[১২৩] তাঁর কবিকাহিনী, বনফুল ও ভগ্নহৃদয় কাব্য তিনটিতে বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট।[১২৪] সন্ধ্যাসংগীত কাব্যগ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে শুরু করেন।[১২৪] এই পর্বের সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান ও কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ছিল মানব হৃদয়ের বিষণ্ণতা, আনন্দ, মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রেম।[১২৪] ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী এবং তার পর প্রকাশিত সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬), চৈতালি (১৮৯৬), কল্পনা (১৯০০) ও ক্ষণিকা (১৯০০) কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোম্যান্টিক ভাবনা।[১২৪] ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য লক্ষিত হয়। এই চিন্তা ধরা পড়েছে নৈবেদ্য (১৯০১), খেয়া (১৯০৬), গীতাঞ্জলি (১৯১০), গীতিমাল্য (১৯১৪) ও গীতালি (১৯১৪) কাব্যগ্রন্থে।[১২৪] ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটলে বলাকা (১৯১৬) কাব্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার পরিবর্তে আবার মর্ত্যজীবন সম্পর্কে আগ্রহ ফুটে ওঠে।[১২৪] পলাতকা (১৯১৮) কাব্যে গল্প-কবিতার আকারে তিনি নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন।[১২৪] পূরবী (১৯২৫) ও মহুয়া (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ আবার প্রেমকে উপজীব্য করেন।[১২৪] এরপর পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫), পত্রপুট (১৯৩৬) ও শ্যামলী (১৯৩৬) নামে চারটি গদ্যকাব্য প্রকাশিত হয়।[১২৪] জীবনের শেষ দশকে কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকটি নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[১২৪] এই সময়কার রোগশয্যায় (১৯৪০), আরোগ্য (১৯৪১), জন্মদিনে (১৯৪১) ও শেষ লেখা (১৯৪১, মরণোত্তর প্রকাশিত) কাব্যে মৃত্যু ও মর্ত্যপ্রীতিকে একটি নতুন আঙ্গিকে পরিস্ফুট করেছিলেন তিনি।[১২৪] শেষ কবিতা "তোমার সৃষ্টির পথ" মৃত্যুর আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[১২৪] রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলি, উপনিষদ্‌, কবীরের দোঁহাবলি, লালনের বাউল গান ও রামপ্রসাদ সেনের শাক্ত পদাবলি সাহিত্যের প্রভাব লক্ষিত হয়।[১২৫][১২৬][১২৭] তবে প্রাচীন সাহিত্যের দুরূহতার পরিবর্তে তিনি এক সহজ ও সরস কাব্যরচনার আঙ্গিক গ্রহণ করেছিলেন। আবার ১৯৩০-এর দশকে কিছু পরীক্ষামূলক লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা ও বাস্তবতাবোধের প্রাথমিক আবির্ভাব প্রসঙ্গে নিজ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছিলেন কবি।[১২৮] বহির্বিশ্বে তাঁর সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত কাব্যগ্রন্থটি হল গীতাঞ্জলি। এ বইটির জন্যই তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।[১২৯] নোবেল ফাউন্ডেশন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটিকে বর্ণনা করেছিল একটি "গভীরভাবে সংবেদনশীল, উজ্জ্বল ও সুন্দর কাব্যগ্রন্থ" রূপে।[১৩০] ছোটগল্প চিত্র:The Hero Illustration.jpg ১৯১৩ সালে ম্যাকমিলান প্রকাশিত দ্য ক্রেসেন্ট মুন (শিশু ভোলানাথ) অনুবাদগ্রন্থের দ্য হিরো (বীরপুরুষ) আখ্যানকবিতার নন্দলাল বসুকৃত অলংকরণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার।[১৩১][১৩২] মূলত হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতে তিনি তাঁর ছোটগল্পগুলি রচনা করেছিলেন।[১৩৩] এই গল্পগুলির উচ্চ সাহিত্যমূল্য-সম্পন্ন।[১৩৩] রবীন্দ্রনাথের জীবনের "সাধনা" পর্বটি (১৮৯১–৯৫) ছিল সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল পর্যায়। তাঁর গল্পগুচ্ছ গল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে।[৫৪] গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্য গল্পগুলির অনেকগুলিই রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনের সবুজ পত্র পর্বে (১৯১৪–১৭; প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নামানুসারে) [৫৪] তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল "কঙ্কাল", "নিশীথে", "মণিহারা", "ক্ষুধিত পাষাণ", "স্ত্রীর পত্র", "নষ্টনীড়", "কাবুলিওয়ালা", "হৈমন্তী", "দেনাপাওনা", "মুসলমানীর গল্প" ইত্যাদি।[১৩৩] শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ লিপিকা, সে ও তিনসঙ্গী গল্পগ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে গল্পরচনা করেছিলেন।[১৩৪] রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি বা আধুনিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতেন। কখনও তিনি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বৌদ্ধিক বিশ্লেষণকেই গল্পে বেশি প্রাধান্য দিতেন।[১৩৫] রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র, নাটক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। তাঁর গল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রায়ণ হল সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তিন কন্যা ("মনিহারা", "পোস্টমাস্টার" ও "সমাপ্তি" অবলম্বনে)[১৩৬] ও চারুলতা ("নষ্টনীড়" অবলম্বনে) [১৩৭], তপন সিংহ পরিচালিত অতিথি, কাবুলিওয়ালা ও ক্ষুধিত পাষাণ[১৩৮], পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত স্ত্রীর পত্র[১৩৯] ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন।[১৩৩] এগুলি হল: বৌ-ঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩), রাজর্ষি (১৮৮৭), চোখের বালি (১৯০৩), নৌকাডুবি (১৯০৬), প্রজাপতির নির্বন্ধ (১৯০৮), গোরা (১৯১০), ঘরে বাইরে (১৯১৬), চতুরঙ্গ (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯), দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪)।[১৩৩] বৌ-ঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এদুটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা।[১৩৩] এরপর থেকে ছোটগল্পের মতো তাঁর উপন্যাসগুলিও মাসিকপত্রের চাহিদা অনুযায়ী নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, প্রবাসী, সবুজ পত্র, বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।[১৩৩] চোখের বালি উপন্যাসে দেখানো হয়েছে সমসাময়িককালে বিধবাদের জীবনের নানা সমস্যা।[১৩৩] নৌকাডুবি উপন্যাসটি আবার লেখা হয়েছে জটিল পারিবারিক সমস্যাগুলিকে কেন্দ্র করে।[১৩৩] গোরা রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।[১৩৩] এই উপন্যাসে দেখানো হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজের সংঘাত ও ভারতের তদানীন্তন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলি।[১৩৩] ঘরে বাইরে উপন্যাসের বিষয়বস্তু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা।[১৪১][১৪২][১৪৩] স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতা আরও সূক্ষ্মভাবে উঠে এসেছে তাঁর পরবর্তী যোগাযোগ উপন্যাসেও।[১৩৩] চতুরঙ্গ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের “ছোটগল্পধর্মী উপন্যাস”।[১৩৩] স্ত্রীর অসুস্থতার সুযোগে স্বামীর অন্য স্ত্রীলোকের প্রতি আসক্তি – এই বিষয়টিকে উপজীব্য করে রবীন্দ্রনাথ দুই বোন ও মালঞ্চ উপন্যাসদুটি লেখেন।[১৩৩] এর মধ্যে প্রথম উপন্যাসটি মিলনান্তক ও দ্বিতীয়টি বিয়োগান্তক।[১৩৩] রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস চার অধ্যায় সমসাময়িক বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটি বিয়োগান্তক প্রেমের উপন্যাস।[১৩৩] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে)[১৪৪] ও ঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালি। প্রবন্ধ ও পত্রসাহিত্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। [৩১] এইসব প্রবন্ধে তিনি সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, সংগীত ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন।[৩১] রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তামূলক প্রবন্ধগুলি সমাজ (১৯০৮) সংকলনে সংকলিত হয়েছে।[৩১] রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ে লেখা রাজনীতি-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি সংকলিত হয়েছে কালান্তর (১৯৩৭) সংকলনে।[৩১] রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও আধ্যাত্মিক অভিভাষণগুলি সংকলিত হয়েছে ধর্ম (১৯০৯) ও শান্তিনিকেতন (১৯০৯-১৬) অভিভাষণমালায়।[৩১] রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি স্থান পেয়েছে ভারতবর্ষ (১৯০৬), ইতিহাস (১৯৫৫) ইত্যাদি গ্রন্থে।[৩১] সাহিত্য (১৯০৭), সাহিত্যের পথে (১৯৩৬) ও সাহিত্যের স্বরূপ (১৯৪৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন।[৩১] রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদি ভারতীয় সাহিত্য ও আধুনিক সাহিত্যের সমালোচনা করেছেন যথাক্রমে প্রাচীন সাহিত্য (১৯০৭) ও আধুনিক সাহিত্য (১৯০৭) গ্রন্থদুটিতে।[৩১] লোকসাহিত্য (১৯০৭) প্রবন্ধমালায় তিনি আলোচনা করেছেন বাংলা লোকসাহিত্যের প্রকৃতি।[৩১] ভাষাতত্ত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ রয়েছে শব্দতত্ত্ব (১৯০৯), বাংলা ভাষা পরিচয় (১৯৩৮) ইত্যাদি গ্রন্থে।[৩১] ছন্দ ও সংগীত নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন যথাক্রমে ছন্দ (১৯৩৬) ও সংগীতচিন্তা (১৯৬৬) গ্রন্থে।[৩১] বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা-সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার কথা প্রকাশ করেছেন শিক্ষা (১৯০৮) প্রবন্ধমালায়।[৩১] ন্যাশনালিজম (ইংরেজি: Nationalism, ১৯১৭) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণ করে তার বিরোধিতা করেছেন।[৩১] অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শন বিষয়ে যে বিখ্যাত বক্তৃতাগুলি দিয়েছিলেন সেগুলি রিলিজিয়ন অফ ম্যান (ইংরেজি: Religion of Man, ১৯৩০; বাংলা অনুবাদ মানুষের ধর্ম, ১৯৩৩) নামে সংকলিত হয়।[৩১] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা জন্মদিনের অভিভাষণ সভ্যতার সংকট (১৯৪১) তাঁর সর্বশেষ প্রবন্ধগ্রন্থ।[৩১] জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপরিচয় (১৯৩৭) নামে একটি তথ্যমূলক প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছিলেন।[৩১] জীবনস্মৃতি (১৯১২), ছেলেবেলা (১৯৪০) ও আত্মপরিচয় (১৯৪৩) তাঁর আত্মকথামূলক গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে ছিলেন নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা।[১৪৫] জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক নাট্যমঞ্চে মাত্র ষোলো বছর বয়সে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত হঠাৎ নবাব নাটকে (মলিয়ের লা বুর্জোয়া জাঁতিরোম অবলম্বনে রচিত) [১৪৬] ও পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরই অলীকবাবু নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[১৪৫] ১৮৮১ সালে তাঁর প্রথম গীতিনাট্য বাল্মীকি-প্রতিভা মঞ্চস্থ হয়।[১৪৫][১৪৭] এই নাটকে তিনি ঋষি বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।[১৪৫][১৪৭] ১৮৮২ সালে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে কালমৃগয়া নামে আরও একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন।[১৪৫][১৪৭] এই নাটক মঞ্চায়নের সময় তিনি অন্ধমুনির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।[১৪৫][১৪৭] গীতিনাট্য রচনার পর রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি কাব্যনাট্য রচনা করেন।[১৪৫][১৪৭] শেকসপিয়রীয় পঞ্চাঙ্ক রীতিতে রচিত তাঁর রাজা ও রাণী (১৮৮৯)[১৪৮] ও বিসর্জন (১৮৯০)[১৪৯] বহুবার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয় এবং তিনি নিজে এই নাটকগুলিতে অভিনয়ও করেন।[১৪৫] ১৮৮৯ সালে রাজা ও রাণী নাটকে বিক্রমদেবের ভূমিকায় অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ।[১৪৫] বিসর্জন নাটকটি দুটি ভিন্ন সময়ে মঞ্চায়িত করেছিলেন তিনি।[১৪৫] ১৮৯০ সালের মঞ্চায়নের সময় যুবক রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ রঘুপতির ভূমিকায় এবং ১৯২৩ সালের মঞ্চায়নের সময় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ যুবক জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।[১৪৫] কাব্যনাট্য পর্বে রবীন্দ্রনাথের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২)[১৫০] ও মালিনী (১৮৯৬)।[১৪৫][১৫১] কাব্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ প্রহসন রচনায় মনোনিবেশ করেন।[১৪৫] এই পর্বে প্রকাশিত হয় গোড়ায় গলদ (১৮৯২), বৈকুণ্ঠের খাতা (১৮৯৭), হাস্যকৌতুক (১৯০৭) ও ব্যঙ্গকৌতুক (১৯০৭)।[১৪৫] বৈকুণ্ঠের খাতা নাটকে রবীন্দ্রনাথ কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।[১৪৫] ১৯২৬ সালে তিনি প্রজাপতির নির্বন্ধ উপন্যাসটিকেও চিরকুমার সভা নামে একটি প্রহসনমূলক নাটকের রূপ দেন। ৯০৮ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ রূপক-সাংকেতিক তত্ত্বধর্মী নাট্যরচনা শুরু করেন।[১৪৫] ইতিপূর্বে প্রকৃতির প্রতিশোধ (১৮৮৪) নাটকে তিনি কিছুটা রূপক-সাংকেতিক আঙ্গিক ব্যবহার করেছিলেন।[১৪৫] কিন্তু ১৯০৮ সালের পর থেকে একের পর এক নাটক তিনি এই আঙ্গিকে লিখতে শুরু করেন।[১৪৫] এই নাটকগুলি হল: শারদোৎসব (১৯০৮), রাজা (১৯১০), ডাকঘর (১৯১২), অচলায়তন (১৯১২), ফাল্গুনী (১৯১৬), মুক্তধারা (১৯২২), রক্তকরবী (১৯২৬), তাসের দেশ (১৯৩৩), কালের যাত্রা (১৯৩২) ইত্যাদি।[১৪৫] এই সময় রবীন্দ্রনাথ প্রধানত শান্তিনিকেতনে মঞ্চ তৈরি করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অভিনয়ের দল গড়ে মঞ্চস্থ করতেন।[১৪৫] কখনও কখনও কলকাতায় গিয়েও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতেন তিনি।[১৪৫] এই সব নাটকেও একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ।[১৪৫] তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ১৯১১ সালে শারদোৎসব নাটকে সন্ন্যাসী এবং রাজা নাটকে রাজা ও ঠাকুরদাদার যুগ্ম ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৪ সালে অচলায়তন নাটকে অদীনপুণ্যের ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৫ সালে ফাল্গুনী নাটকে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৭ সালে ডাকঘর নাটকে ঠাকুরদা, প্রহরী ও বাউলের ভূমিকায় অভিনয়।[১৪৫] নাট্যরচনার পাশাপাশি এই পর্বে ছাত্রছাত্রীদের অভিনয়ের প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ পুরোন নাটকগুলি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ করে নতুন নামে প্রকাশ করেন।[১৪৫] শারদোৎসব নাটকটি হয় ঋণশোধ (১৯২১), রাজা হয় অরূপরতন (১৯২০), অচলায়তন হয় গুরু (১৯১৮), গোড়ায় গলদ হয় শেষরক্ষা (১৯২৮), রাজা ও রাণী হয় তপতী (১৯২৯) এবং প্রায়শ্চিত্ত হয় পরিত্রাণ (১৯২৯)।[১৪৫] ১৯২৬ সালে নটীর পূজা নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নাচ ও গানের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।[১৪৫] এই ধারাটিই তাঁর জীবনের শেষ পর্বে “নৃত্যনাট্য” নামে পূর্ণ বিকাশ লাভ করে।[১৪৫] নটীর পূজা নৃত্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ একে একে রচনা করেন শাপমোচন (১৯৩১), তাসের দেশ (১৯৩৩), নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬), নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা (১৯৩৮) ও শ্যামা (১৯৩৯)।[১৪৫] এগুলিও শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরাই প্রথম মঞ্চস্থ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৫টি গান রচনা করেছিলেন।[১০] ধ্রুপদি ভারতীয় সংগীত, বাংলা লোকসংগীত ও ইউরোপীয় সংগীতের ধারা তিনটিকে আত্মস্থ করে তিনি একটি স্বকীয় সুরশৈলীর জন্ম দেন।[১৫৪] রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করেছিলেন।[১৫৫] রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ সুকুমার সেন রবীন্দ্রসংগীত রচনার ইতিহাসে চারটি পর্ব নির্দেশ করেছেন।[১৫৬] প্রথম পর্বে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট গীতের অনুসরণে গান রচনা শুরু করেছিলেন।[১৫৬] দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৮৮৪-১৯০০) পল্লীগীতি ও কীর্তনের অনুসরণে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব সুরে গান রচনা শুরু করেন।[১৫৬] এই পর্বের রবীন্দ্রসংগীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সংগীতস্রষ্টা মধুকান, রামনিধি গুপ্ত, শ্রীধর কথক প্রমুখের প্রভাবও সুস্পষ্ট।[১৫৬] এই সময় থেকেই তিনি স্বরচিত কবিতায় সুর দিয়ে গান রচনাও শুরু করেছিলেন।[১৫৬] ১৯০০ সালে শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করার পর থেকে রবীন্দ্রসংগীত রচনার তৃতীয় পর্বের সূচনা ঘটে।[১৫৬] এই সময় রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের সুর ও ভাব তাঁর নিজের গানের অঙ্গীভূত করেন।[১৫৬] প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথের গান রচনার চতুর্থ পর্বের সূচনা হয়।[১৫৬] কবির এই সময়কার গানের বৈশিষ্ট্য ছিল নতুন নতুন ঠাটের প্রয়োগ এবং বিচিত্র ও দুরূহ সুরসৃষ্টি।[১৫৬] তাঁর রচিত সকল গান সংকলিত হয়েছে গীতবিতান গ্রন্থে।[৩৬] এই গ্রন্থের "পূজা", "প্রেম", "প্রকৃতি", "স্বদেশ", "আনুষ্ঠানিক" ও "বিচিত্র" পর্যায়ে মোট দেড় হাজার গান সংকলিত হয়।[৩৬] পরে গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, নাটক, কাব্যগ্রন্থ ও অন্যান্য সংকলন গ্রন্থ থেকে বহু গান এই বইতে সংকলিত হয়েছিল।[৩৬] ইউরোপীয় অপেরার আদর্শে বাল্মীকি-প্রতিভা, কালমৃগয়া গীতিনাট্য এবং চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, ও শ্যামা সম্পূর্ণ গানের আকারে লেখা।[৩৬] রবীন্দ্রনাথের সময় বাংলার শিক্ষিত পরিবারে নৃত্যের চর্চা নিষিদ্ধ ছিল।[১২২] কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর পাঠক্রমে সংগীত ও চিত্রকলার সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যকেও অন্তর্ভুক্ত করেন।[১২২] ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোকনৃত্য ও ধ্রুপদি নৃত্যশৈলীগুলির সংমিশ্রণে তিনি এক নতুন শৈলীর প্রবর্তন করেন।[১২২] এই শৈলীটি "রবীন্দ্রনৃত্য" নামে পরিচিত।[১২২] রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যগুলিতে গানের পাশাপাশি নাচও অপরিহার্য।[১২২] বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর যে আধুনিক ভারতীয় নৃত্যধারার প্রবর্তন করেছিলেন, তার পিছনেও রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন প্রায় সত্তর বছর বয়সে।[১৩] চিত্রাঙ্কনে কোনো প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না।[১৩] প্রথমদিকে তিনি লেখার হিজিবিজি কাটাকুটিগুলিকে একটি চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করতেন।[১৩] এই প্রচেষ্টা থেকেই তাঁর ছবি আঁকার সূত্রপাত ঘটে।[১৩] ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ কালপরিধিতে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের ওপর, যার ১৫৭৪টি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে।[১৫৭] দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে।[১৫৮] এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।[১৩] ছবিতে রং ও রেখার সাহায্যে রবীন্দ্রনাথ সংকেতের ব্যবহার করতেন।[১৩] রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য চিত্রকলার পুনরুত্থানে আগ্রহী হলেও, তাঁর নিজের ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে। মূলত কালি-কলমে আঁকা স্কেচ, জলরং ও দেশজ রঙের ব্যবহার করে তিনি ছবি আঁকতেন।[১৩] তাঁর ছবিতে দেখা যায় মানুষের মুখের স্কেচ, অনির্ণেয় প্রাণীর আদল, নিসর্গদৃশ্য, ফুল, পাখি ইত্যাদি। তিনি নিজের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন।[১৩] নন্দনতাত্ত্বিক ও বর্ণ পরিকল্পনার দিক থেকে তাঁর চিত্রকলা বেশ অদ্ভুত ধরণেরই বলে মনে হয়।[১৩] তবে তিনি একাধিক অঙ্কনশৈলী রপ্ত করেছিলেন।[১৩] তন্মধ্যে, কয়েকটি শৈলী হল- নিউ আয়ারল্যান্ডের হস্তশিল্প, কানাডার (ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশ) পশ্চিম উপকূলের "হাইদা" খোদাইশিল্প ও ম্যাক্স পেকস্টাইনের কাঠখোদাই শিল্প। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত জটিল। তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করতেন।[১৫৯][১৬০][১৬১] ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়।[১৬২] হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং উক্ত ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন।[১৬৩] আবার ১৯২৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে "চরকা-সংস্কৃতি" বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন।[১৬৪] ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁর চোখে ছিল "আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ"। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে দৃঢ় ও প্রগতিশীল শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের মতাদর্শ অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রান্সিসকোয় একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল চরমপন্থী বিপ্লবী রবীন্দ্রনাথকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ উপস্থিত হওয়ায় তাঁদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল।[১৬৭] ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন।[১৬৮] নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।" রবীন্দ্রনাথের "চিত্ত যেথা ভয়শূন্য" ও "একলা চলো রে" রাজনৈতিক রচনা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। "একলা চলো রে" গানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল।[১৬৯] যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। হিন্দু নিম্নবর্ণীয় জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি ও আম্বেডকরের যে মতবিরোধের সূত্রপাত হয়, তা নিরসনেও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তাঁর অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।[১৭০][১৭১] রবীন্দ্রনাথ তাঁর "তোতা-কাহিনী" গল্পে বিদ্যালয়ের মুখস্ত-সর্বস্ব শিক্ষাকে প্রতি তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন, দেশের ছাত্রসমাজকে খাঁচাবদ্ধ পাখিটির মতো শুকনো বিদ্যা গিলিয়ে কিভাবে তাদের বৌদ্ধিক মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।[১৭২][১৭৩] ১৯১৭ সালের ১১ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারা ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা সম্পর্কে প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তাভাবনা শুরু করেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমকে দেশ ও ভূগোলের গণ্ডীর বাইরে বের করে ভারত ও বিশ্বকে একসূত্রে বেঁধে একটি বিশ্ব শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও এই সময়েই গ্রহণ করেছিলেন কবি।[১৬৭] ১৯১৮ সালের ২২ অক্টোবর বিশ্বভারতীη[›] নামাঙ্কিত তাঁর এই বিদ্যালয়ের শিলান্যাস করা হয়েছিল। এরপর ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছিল এই বিদ্যালয়ের।[১৭৪] বিশ্বভারতীতে কবি সনাতন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য ও গুরুপ্রথার পুনর্প্রবর্তন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়ের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ অর্থ তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন এই বিদ্যালয়ের পরিচালন খাতে।[১৭৫] নিজেও শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ ও শিক্ষক হিসেবেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতেন তিনি। সকালে ছাত্রদের ক্লাস নিতেন এবং বিকেল ও সন্ধ্যায় তাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতেন।[১৭৬] ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তিনি একাধিকবার ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ তথা দার্শনিক অমর্ত্য সেন রবীন্দ্রনাথকে এক "হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব" ও "গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক ও বহুমাত্রিক সমসাময়িক দার্শনিক" হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[১৭৮] বত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। রবীন্দ্রনাথকে "ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি" হিসেবেও বর্ণনা করা হয়ে থাকে।[১৭৯] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী "পঁচিশে বৈশাখ" ও প্রয়াণবার্ষিকী "বাইশে শ্রাবণ" আজও বাঙালি সমাজে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। এই উপলক্ষ্যে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, শান্তিনিকেতন আশ্রম ও শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে প্রচুর জনসমাগম হয়। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত ধর্মীয় ও ঋতুউৎসবগুলির মাধ্যমেও তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদনের রীতি অক্ষুন্ন আছে। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে ও অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া বা রবীন্দ্ররচনা পাঠের রেওয়াজও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এগুলি ছাড়াও কবির সম্মানে আরও কতকগুলি বিশেষ ও অভিনব অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যের আরবানাতে আয়োজিত বার্ষিক "রবীন্দ্র উৎসব", কলকাতা-শান্তিনিকেতন তীর্থ-পদযাত্রা "রবীন্দ্র পথপরিক্রমা" ইত্যাদি। জীবদ্দশাতেই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ায় প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইংল্যান্ডে ডার্টিংটন হল স্কুল নামে একটি প্রগতিশীল সহশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি।[১৮১] অনেজ জাপানি সাহিত্যিককে তিনি প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[১৮২] রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থাবলি অনূদিত হয় ইংরেজি, ওলন্দাজ, জার্মান, স্প্যানিশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। চেক ভারততত্ত্ববিদ ভিনসেন্স লেনসি সহ একাধিক ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর গ্রন্থ অনুবাদ করেন।[১৮৩] ফরাসি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আন্দ্রে জিদ্, রাশিয়ান কবি আনা আখমাতোভা [১৮৪], প্রাক্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত একেভিত[১৮৫], মার্কিন ঔপন্যাসিক জোনা গেইল সহ অনেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করেন রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে। ১৯১৬-১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দেওয়া তাঁর ভাষণগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা পায়। তবে কয়েকটি বিতর্ককে কেন্দ্র করে ১৯২০-এর দশকের শেষদিকে জাপান ও উত্তর আমেরিকায় তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। কালক্রমে বাংলার বাইরে রবীন্দ্রনাথ "প্রায় অস্তমিত" হয়ে পড়েছিলেন।[ চিলিয়ান সাহিত্যিক পাবলো নেরুদা ও গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, মেক্সিকান লেখক অক্টাভিও পাজ ও স্প্যানিশ লেখক হোসে অরতেগা ওয়াই গ্যাসেৎ, থেনোবিয়া কামপ্রুবি আইমার, ও হুয়ান রামোন হিমেনেথ প্রমুখ স্প্যানিশ-ভাষী সাহিত্যিকদেরও অনুবাদের সূত্রে অনুপ্রাণিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৪ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে হিমেনেথ-কামপ্রুবি দম্পতি রবীন্দ্রনাথের বাইশটি বই ইংরেজি থেকে স্প্যানিশে অনুবাদ করেছিলেন। দ্য ক্রেসেন্ট মুন (শিশু ভোলানাথ) সহ রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু রচনার বিস্তারিত পর্যালোচনা ও স্প্যানিশ সংস্করণ প্রকাশও করেছিলেন তাঁরা। উল্লেখ্য, এই সময়েই হিমেনেথ "নগ্ন কবিতা" (স্প্যানিশ: «poesía desnuda») নামে এক বিশেষ সাহিত্যশৈলীর উদ্ভাবন ঘটান।[১৮৭] রবীন্দ্রনাথের মূল বাংলা কবিতা পড়েননি এমন বহু পাশ্চাত্য সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব অস্বীকারও করেছিলেন। গ্রাহাম গ্রিন সন্দিগ্ধচিত্তে মন্তব্য করেছিলেন, "ইয়েটস সাহেব ছাড়া আর কেউই রবীন্দ্রনাথের লেখাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন না।"[১৮৬] রবীন্দ্রনাথের সম্মানের কিছু পুরনো লাতিন আমেরিকান খণ্ডাংশ সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। নিকারাগুয়া ভ্রমণের সময় সালমান রুশদি এই জাতীয় কিছু উদাহরণ দেখে অবাক হন।[ %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%B9%E0%A6%A8%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B8_%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%AE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%A6_%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%80 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (গুজরাটি ভাষায়: મોહનદાસ કરમચંદ ગાંધી এই শব্দ সম্পর্কে উচ্চারণ (সাহায্য·তথ্য)মোহান্‌দাস্‌ কারাম্‌চান্দ্‌ গান্ধী) বা মহাত্মা গান্ধী (২রা অক্টোবর, ১৮৬৯ - ৩০শে জানুয়ারি, ১৯৪৮) অন্যতম প্রধান ভারতীয় রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিদের একজন এবং প্রভাভশালী আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি ছিলেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। এর মাধ্যমে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণের অবাধ্যতা ঘোষিত হয়েছিল। এ আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অহিংস মতবাদ বা দর্শনের উপর এবং এটি ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চালিকা শক্তি, সারা বিশ্বে মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকার পাওয়ার আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণা। গান্ধী ভারতে এবং বিশ্ব জুড়ে মহাত্মা (মহান আত্মা) এবং বাপু (বাবা) নামে পরিচিত। ভারত সরকারীভাবে তাঁর সম্মানার্থে তাকে ভারতের জাতির জনক হিসেবে ঘোষণা করেছে । ২রা অক্টোবর তাঁর জন্মদিন ভারতে গান্ধী জয়ন্তী হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। ২০০৭ সালের ১৫ই জুন জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২রা অক্টোবর-কে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে ঘোষণা করা। জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশ এ দিবস পালনে সম্মতি জ্ঞাপন করে।[১] একজন শিক্ষিত ব্রিটিশ আইনজীবী হিসেবে, গান্ধী প্রথম তাঁর অহিংস শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের মতাদর্শ প্রয়োগ করেন দক্ষিণ আফ্রিকায় নিপীড়িত ভারতীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। ভারতে ফিরে আসার পরে কয়েকজন দুঃস্থ কৃষক এবং দিনমজুরকে সাথে নিয়ে বৈষম্যমূলক কর আদায় ব্যবস্থা এবং বহু বিস্তৃত বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে আসার পর গান্ধী সমগ্র ভারতব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারী স্বাধীনতা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণ, জাতির অর্থনৈতিক সচ্ছলতা সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার শুরু করেন। কিন্তু এর সবগুলোই ছিল স্বরাজ অর্থাৎ ভারতকে বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। ১৯৩০ সালে গান্ধী ভারতীয়দের লবণ করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ৪০০ কিলোমিটার (২৪৮ মাইল) দীর্ঘ ডান্ডি লবণ কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন, যা ১৯৪২ সালে ইংরেজ শাসকদের প্রতি সরাসরি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে বেশ কয়েকবার দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে কারাবরণ করেন। মহাত্মা গান্ধী সমস্ত পরিস্থিতিতেই অহিংস মতবাদ এবং সত্যের ব্যাপারে অটল থেকেছেন। তিনি সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেটি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার নিজের পরিধেয় কাপড় ছিল ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় ধুতি এবং শাল যা তিনি নিজেই চরকায় বুনতেন। তিনি সাধারণ নিরামিষ খাবার খেতেন। শেষ জীবনে ফলমূ্লই বেশি খেতেন। আত্মশুদ্ধি এবং প্রতিবাদের কারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য উপবাস থাকতেন। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৮৬৯ সালে পোরবন্দরের হিন্দু মোধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন পোরবন্দরের দেওয়ান (প্রধান মন্ত্রী)। মা পুতলিবা করমচাঁদের চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন। পুতলিবা প্রনামী বৈষ্ণব গোষ্ঠীর ছিলেন। করমচাঁদের প্রথম দুই স্ত্রীর প্রত্যেকেই একটি করে কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। অজানা কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছিল (এরকম শোনা যায় যে সন্তান জন্ম দেবার সময়ে তারা মারা যান)। ধার্মিক মায়ের সাথে এবং গুজরাটের জৈন প্রভাবিত পরিবেশে থেকে গান্ধী ছোটবেলা থেকেই জীবের প্রতি অহিংসা, নিরামিষ ভোজন, আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাসে থাকা, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয় শিখতে শুরু করেন। তিনি জন্মেছিলেন হিন্দু বৈশ্য গোত্রে যা ছিল ব্যবসায়ী গোত্র। ১৮৮৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধী তার বাবা মায়ের পছন্দে কস্তুরবা মাখাঞ্জীকে (কাস্তুবাই নামেও পরিচিত ছিলেন) বিয়ে করেন। তাদের চার পুত্র সন্তান জন্মায় যাদের নাম হরিলাল গান্ধী, (জন্ম ১৮৮৮) মনিলাল গান্ধী, (জন্ম ১৮৯২) রামদাস গান্ধী (জন্ম ১৮৯৭) এবং দেবদাস গান্ধী (জন্ম ১৯০০) সালে। মহাত্মা গান্ধী তাঁর ছোটবেলায় পোরবন্দর ও রাজকোটের ছাত্রজীবনে মাঝারি মানের ছাত্র ছিলেন। কোন রকমে গুজরাটের ভবনগরের সামালদাস কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি কলেজেও সুখী ছিলেন না কারণ তার পরিবারের ইচ্ছা ছিল তিনি ব্যারিস্টার হন। ১৮ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে যান। রাজকীয় রাজধানী লন্ডনে তার জীবন যাপন ছিল ভারতে থাকতে তার মায়ের কাছে করা শপথ প্রভাবিত। জৈন সন্ন্যাসি বেচার্জীর সামনে তিনি তার মায়ের কাছে শপথ করেছিলেন যে তিনি মাংস, মদ এবং উচ্ছৃঙ্খলতা ত্যাগ করার হিন্দু নৈতিক উপদেশ পালন করবেন। যদিও তিনি ইংরেজ আদব কায়দা পরীক্ষামূলকভাবে গ্রহণ করেছিলেন; যেমন নাচের শিক্ষা, কিন্তু তিনি তার বাড়িওয়ালীর দেওয়া ভেড়ার মাংস এবং বাঁধাকপি খেতেন না। তিনি লন্ডনের গুটি কয়েক নিরামিষভোজী খাবারের দোকানের একটিতে নিয়মিত যেতেন। শুধু তার মায়ের কথায় সাধারণ নিরামিষভোজী জীবন যাপন না করে তিনি এ বিষয়ে পড়াশোনা করে একান্ত আগ্রহী হয়ে নিরামিষভোজন গ্রহণ করেন। নিরামিষভোজী সংঘে যোগ দেন এবং কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন, এ সংস্থার একটি স্থানীয় শাখাও প্রচলন করেন। তার এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে সাংগঠনিক কার্যক্রমে অনেক ভাবে কাজে লাগে। নিরামিষভোজী অনেক সদস্যই আবার থিওসোফিক্যাল সোসাইটি (Theosophical Society)-এর সদস্য ছিলেন, যা ১৮৭৫ সালে সার্বজনীন ভাতৃত্বের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল এবং এতে ধর্ম শিক্ষায় বৌদ্ধ এবং হিন্দু ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য পড়ানো হত। তারা গান্ধীকে ভগবত গীতা পড়তে উৎসাহিত করেছিলেন। আগে ধর্ম বিষয়ে তেমন কোন আগ্রহ না থকলেও, গান্ধী হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, ইসলামসহ অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে এবং বিভিন্ন রীতি সম্পর্কে পড়াশোনা করেন। দক্ষিণ আফ্রিকা গান্ধীর জীবনকে নাটকীয়ভাবে পরবর্তন করে দেয়। এখানে তিনি ভারতীয় ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সাধারণভাবে প্রচলিত বৈষম্যের শিকার হন। একদিন ডারবানের আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট তার পাগড়ি সরিয়ে ফেলতে বলেন। গান্ধী তা অগ্রাহ্য করেন এবং আদালত কক্ষ থেকে ক্ষোভে বেরিয়ে পড়েন। তাকে পিটার ম্যারিজবার্গের একটি ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামড়া থেকে তৃতীয় শ্রেণীর কামড়ায় যেতে বাধ্য করা হয়, প্রথম শ্রেণীর বৈধ টিকিট থাকা স্বত্ত্বেও। স্টেজকোচে ভ্রমণের সময় একজন চালক তাকে প্রহার করে কারণ তিনি এক ইউরোপীয় যাত্রীকে জায়গা করে দেয়ার জন্য ফুট বোর্ডে চড়তে রাজি হননি। যাত্রাপথে তাকে আরও কষ্ট করতে হয় এবং অনেক হোটেল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এই ঘটনাগুলোকে তার পরবর্তী সামাজিক কার্যকলাপের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রাখে। ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ, কুসংস্কার এবং অবিচার লক্ষ করে গান্ধী তার জনগণের মর্যাদা এবং অবস্থান নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের ভোটাধিকার ছিল না। এই অধিকার আদায়ের বিল উত্থাপনের জন্য তিনি আরও কিছুদিন দেশটিতে থেকে যান। বিলের উদ্দেশ্য সিদ্ধি না হলেও এই আন্দোলন সেদেশের ভারতীয়দেরকে অধিকার সচেতন করে তুলেছিল। ১৮৯৪ সালে গান্ধী নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে সেখানকার ভারতীয়দেরকে রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করেন। ১৮৯৭ সালের জানুয়ারিতে ভারতে এক সংক্ষিপ্ত সফর শেষে ফিরে আসার পর এক শ্বেতাঙ্গ মব তাকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। গান্ধী এই মব সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেননি। কারণ তার মতে, কারও ব্যক্তিগত ভুলের জন্য পুরো দলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়াকে তিনি সমর্থন করেন না। ১৯০৬ সালে ট্রান্সভাল সরকার উপনিবেশের ভারতীয়দের নিবন্ধনে বাধ্য করানোর জন্য একটি আইন পাশ করে। ১১ই সেপ্টেম্বর জোহানেসবার্গে সংঘটিত এক গণ প্রতিরোধে গান্ধী সবাইকে এই আইন বর্জন করতে বলেন। তিনি বলেন, আইন না মানার কারণে তাদের উপর যে অত্যাচার করা হবে দরকার হলে তা মেনে নেবেন, কিন্তু আইন মানবেন না। এই পরিকল্পনা কাজে দেয়, এবং ৭ বছর ব্যাপী এক আন্দোলনের সূচনা ঘটে। এ সময় আইন অম্যান্য করা, নিজেদের নিবন্ধন কার্ড পুড়িয়ে ফেলা সহ বিভিন্ন কারণে অনেক ভারতীয়কে বন্দী করা হয়। অনেকে আহত বা নিহত হয়। সরকার তার কাজে অনেকটাই সফল হয়। কিন্তু শান্তিকামী ভারতীয়দের উপর এহেন নিগীপনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেই প্রতিবাদ শুরু হয়। অগত্যা, দক্ষিণ আফ্রিকার জেনারেল ইয়ান ক্রিশ্চিয়ান স্মুট গান্ধীর সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হন। এর মাধ্যমেই গান্ধীর আদর্শ প্রতিষ্ঠা পায়, সত্যাগ্রাহ তার আসল রূপ পেতে শুরু করে। গান্ধীর প্রথম অর্জন আসে ১৯১৮ সালের চম্পারন বিক্ষোভ এবং খেদা সত্যাগ্রহের মাধ্যমে। যদিও পরবর্তীতে খাদ্যশস্যের বদলে ইণ্ডিগো এবং অন্যান্য অর্থকরী ফসল তাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। জমিদারের মিলিশিয়াদের মাধ্যমে অত্যাচারিত হয়েও তারা নামেমাত্র ক্ষতিপুরণ পায় যা তাদের প্রখর দারিদ্রের দিকে ঠেলে দেয়। গ্রামগুলোকে অতিরিক্ত নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর করে রাখা হয় এবং মদ্যপান, অস্পৃশ্যতা এবং পর্দা প্রথা ছিল ব্যাপক। মারাত্মক দুর্ভিক্ষের মাঝে ব্রিটিশ একটি শোষণমূলক কর চালু এবং তা বাড়াবার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি প্রচণ্ড অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। খেদা এবং গুজরাটেও সমস্যার একইরকম অবস্থা ছিল। গান্ধী সেখানে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার বহুদিনের সমর্থক ও স্থানীয় সেচ্ছাসেবকদের জড়ো করেন। তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ জরিপ চালিয়ে গ্রামের মৃত্যুর হার এবং গ্রামবাসীদের ভয়াবহ দূর্ভোগের উপাত্ত সংগ্রহ করেন এবং কষ্টকর অবস্থার সাধারণ পরিস্থিতিও যুক্ত করেন। গ্রামবাসীদের কাছে বিশ্বস্ত হবার পর, তিনি গ্রামকে পরিষ্কার করার পাশাপাশি স্কুল ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন এবং গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোকদের সামাজিক নির্যাতন এবং কুসংস্কার মুক্ত হবার আহ্বান জানান। কিন্তু তার মূল প্রভাব পরিলক্ষিত হয় যখন অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রদেশ ছেড়ে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। জেলের বাইরে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এছাড়াও পুলিশ স্টেশন ও কোর্টে এসে তারা গান্ধীর মুক্তি দাবি করতে থাকে যা কোর্টকে নিরবে মেনে নিতে হয়। গান্ধী জমিদারদের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত বিক্ষোভ এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন এবং জমিদাররা ব্রিটিশ সরকারের দেখানো পথে কৃষকদের আরও বেশি ক্ষতিপুরণ এবং চাষাবাদের বিষয়ে তাদের আরো নিয়ন্ত্রণ প্রদানে রাজি হয়। তারা রেভিনিউ এর হার বৃদ্ধি বর্জন এবং দুর্ভিক্ষ শেষ হবার আগ পর্যন্ত তা সংগ্রহ করা স্থগিত করে। এই বিক্ষোভ চলাকালেই জনগণ গান্ধীকে বাপু (পিতা) এবং মহাত্মা (মহৎ হৃদয়) উপাধি দান করে। খেদায় ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতার সময় কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করেন সর্দার প্যাটেল। তিনি রেভিনিউ সংগ্রহ বন্ধ এবং সকল বন্দীদের মুক্তি দান করেন। এর ফলে, গান্ধীর সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গান্ধীর অস্ত্র ছিল অসহযোগ এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ । পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, যা সাধারণ মানুষের উপরে ব্রিটিশ সরকার দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল তা জনসাধারণ ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং মারামারির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। গান্ধী ব্রিটিশ রাজের কার্যাবলী এরং ভারতীয়দের প্রতিশোধপরায়ণ আচরণ উভয়েরই নিন্দা করেন। তিনি একটি লিখিত বিবৃতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিটিশ নাগরিকদের সমবেদনা জ্ঞাপন করেন এবং বিশৃঙ্খলার সমালোচনা করেন। তাঁর এই পদক্ষেপ প্রাথমিক পর্যায়ে দলের ভিতরে অসন্তোষের জন্ম দিলেও গান্ধীর একটি আবেগীয় বক্তৃতার পর, যেখানে তিনি তিনি মূলনীতিগুলোর বর্ণনা দিয়ে বলেন সবরকম বিশৃঙ্খলাই অমঙ্গলজনক এবং সমর্থনযোগ্য নয়, তা গৃহীত হয়।[২] এই হত্যাকাণ্ড এবং জন বিক্ষোভের গান্ধী পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্ত্বশাসন এবং সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ লাভের দিকে মনোনিবেশ করেন যা শেষ পর্যন্ত স্বরাজ বা সম্পুর্ণ ব্যক্তিগত, আদর্শগত, রাজনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাঝে মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাহী দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস স্বরাজের লক্ষ্যকে সামনে রেখে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেন। টোকেন ফি দিতে রাজি হওয়া যে কোন ব্যক্তির জন্য দলের সদস্যপদ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বিভিন্ন শ্রেণীর কমিটি গঠন করা হয় নিয়মানবর্তিতা উন্নতির জন্য। পার্টিকে একটি অভিজাত প্রতিষ্ঠান থেকে জাতীয় জনগণের আকর্ষণে রূপান্তর করা হয়। গান্ধী তার অহিংস নীতির পরিবর্ধন করেন স্বদেশী পলিসি যোগ করে। স্বদেশী পলিসি মতে সকল বিদেশী পণ্য বিশেষত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হয়। এর পথ ধরে তিনি সকল ভারতীয়কে ব্রিটিশ পোশাকের বদলে খাদি পরার আহ্বান জানান।[৩] তিনি সকল ভারতীয় পুরুষ ও মহিলা, ধনী ও গরিব মানুষকে দৈনিক খাদীর চাকা ঘুরানোর মাধ্যমে স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করতে বলেন। এটি এমন একটি কৌশল ছিল যা নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মত্যাগের অনুশীলনের মাধ্যমে অনিচ্ছা ও উচ্চাকাঙ্খা দূরীকরণের পাশাপাশি আন্দোলনে মহিলাদের যুক্ত করে, এ সময়ে মহিলাদের করা এ সকল কাজকে অসম্মানজনক বলে মনে করা হত। বাড়তি হিসেবে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের মাধ্যমে, গান্ধী জনগণকে ব্রিটিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অফিস আদালত বর্জনের সরকারী চাকরি র্থেকে ইস্তফা এবং ব্রিটিশ উপাধি বর্জনের ডাক দেন। “অসহযোগ'” ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও সাফল্য লাভ করে। উত্তেজনা বৃদ্ধিকারী এ আন্দোলনকে সমাজের সকল স্তরের লোক অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনটি শীর্ষে আরোহন করামাত্র অপ্রত্যাশিত ভাবে এ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে উত্তর প্রদেশের চৌরি চৌরায় এরক তীব্র সংঘর্ষের ফল হিসেবে। আন্দোলনটিতে সহিংসতার দিকে মোড় নিতে দেখে এবং এর ফলে সকল কর্মকাণ্ডের ব্যর্থতার আশংকায় গান্ধী গণ অহযোগ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।[৪] গান্ধী গ্রেপ্তার হন ১৯২২ সালের ১০ মার্চ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে তাকে ছয় বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয। ১৯২২ সালের ২৮ মার্চ শুরু হওয়া শাস্তির কেবল দুই বছরের মত ভোগ করতে হয় তাকে। ১৯২৪ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে এপেনডিসাইটিসের অপারেশনের পর তাকে মুক্তি দেয়া হয। গান্ধী একতাবদ্ধ ব্যক্তিত্যের অভাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভিতরে ফাটল ধরে যা দলটিকে দুটি ভাগে ভাগ করে দেয়। একটি অংশের নেতৃত্ব দেন চিত্তরঞ্জন দাস এবং মতিলাল নেহরু তারা আইনসভার পার্টির অংশগ্রহণ সমর্থন করেন। চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বের অপর অংশ এত পদক্ষেপের বিরোধীতা করে। এছাড়াও হিন্দু ও মুসলিম দের অহিংস আন্দোলন চলাকালীন সৌহাদ্র্যের ও ভাঙ্গন ধরে। গান্ধী এত বিরোধ মিটিয় তুলতে সেতুবন্ধের কাজ করার চেষ্টা করেন এবং এজন্য ১৯২৪ সালের শরৎকালে তিন সপ্তাহের অনশন করেন। তাঁর এই প্রচেষ্টার খুব বেশি সফলতা আসেনি। গান্ধী ১৯২০ এর দশকের বেশির ভাগ সময় নীরব থাকেন, এ সময় তিনি স্বরাজ পার্টি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মাঝে বাধা দুর করতে চেষ্টা করেন। অস্পৃশ্যতা, মদ্যপান, অবজ্ঞা এবং দারিদ্রতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। ১৯২৮ সালে তিনি আবার সামনে এগিয়ে আসেন। এর আগের বছর ব্রিটিশ সরকার স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে একটি নতুন সংবিধান সংশোধনী কমিশন গঠন করেন। যাতে একজনও ভারতীয় ছিল না। ফলে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো কমিশনকে বর্জন করে। গান্ধী কলকাতা কংগ্রেসে ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেবার দাবি জানান, অন্যথায় নতুন অহিংস নীতির পাশাপাশি পূর্ণ স্বাধীনতান লক্ষ্যের হুমকি দেন। গান্ধী এর মাধ্যমে তরুণ নেতা সুভাষ চন্দ্র বসু এবং জওহরলাল নেহরুর দর্শন সঞ্চালন করেন যারা অবিলম্বে স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিলেন। এই সিদ্ধান্তে তিনি দু'বছরের বদলে একবছর অপেক্ষা করারও প্রতিফলন ঘটান।[৬] ব্রিটিশ রাজ এর প্রত্যুত্তর দেয়নি। ১৯২৯ সালে সালের ৩১ ডিসেম্বর ভারতীয় পতাকার উন্মোচন হয় লাহোরে। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি লাহোর মিলিত হয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দিনটিকে ভাতীয় স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উৎযাপন করে। অন্যান্য প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান ও এই দিনটিকে উৎযাপন করে। ঘোষণামত গান্ধী লবণের উপর কর আরোপের বিরুদ্ধে নতুন সত্যাগ্রহ অভিযান শুরু করেন। ১৯৩০ সালের মার্চে এই উদ্দেশ্যে তিনি ডাণ্ডির উদ্দেশ্যে লবণ হাঁটা আয়োজন করেন ও ১২ই মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৪০০ কিলোমিটার হেঁটে এলাহাবাদ থেকে ডাণ্ডিতে পৌছান। নিজের হাতে লবণ তৈরির জন্য। হাজার হাজার ভারতীয় তাঁর সাথে হেঁটে সাগরের তীরের পৌছান। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তার আন্যতম সফল প্রয়াস। ব্রিটিশরা এর বদলা নিতে ৬০,০০০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। সরকার গান্ধীর সাথে সমঝোতা করতে লর্ড এডওয়ার্ড আরউইনকে প্রতিনিধি নিয়োগ করে। গান্ধী-আর উইন প্যাক্টস হয় ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে সরকার সকল গণ অসহযোগ আন্দোলন বন্ধের বিনিময় সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে রাজি হয়। এছাড়াও গান্ধীকে গোল টেবিল বৈঠকের জন্য লণ্ডনে আমন্ত্রণ জাননো হয। সেখানে তিনি একাই কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করেন। আলোচনা ভারতীয় যুবরাজ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অনুষ্ঠিত হয় গান্ধী ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের নিরাশ করে। লর্ড আরউইনের স্থলাভিষিক্ত লর্ড উইলিংডন জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করেন। গান্ধী পুনরায় গ্রেপ্তার হন এবং সরকার তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে তাকে সম্পূর্ণরূপে তাঁর অনুসারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পদ্ধতিটি অবশ্য সফল হয়নি। ১৯৩২ সালে দলিত নেতা বি আর আম্বেদকারের প্রচেষ্টার ভিত্তিতে সরকারী নতুন সংবিধানের আওতায় অস্পৃম্শ্যদের জন্য আলাদা ইলেকটোরেট আয়োজন করে। এর প্রতিবাদে গান্ধী ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বরে ৬ দিনের অনশন পালন করের এবং এতে সরকার বাধ্য হয়ে দলিত ক্রিকেটার ও পরবর্তীতে রাজনৈতিক নেতা পালওয়াঙ্কার বালুর মধ্যস্থ্যতায় আরও গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা প্রদান করে। এরপরই গান্ধী দলিত যাদের তিনি হরিজন বা ঈশ্বরের সন্তান নাম দিয়েছিলেন, সেই অস্পৃশ্যদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এক নতুন অগ্রযাত্রার সূচনা করেন। ১৯৩৩ সালের ৮ মে তিনি হরিজন আন্দোলনকে এগিয়ে নেবার লক্ষ্যে ২১ দিনের জন্য আত্মশুদ্ধি অনশন করেন।[৭] ১৯৩৪ সালের গ্রীষ্মে তাকে হত্যার জন্য তিনটি ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। কংগ্রেস পার্টি ফেডারেশন স্কিমের ক্ষমতা মেনে নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে রাজি হলে গান্ধী পার্টির থেকে নিজের সদস্যপদ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। গান্ধী এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা না করলেও রাজের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা করা কোন দলের নেতা হয়ে থাকবেন এমন গুজব এড়ানোর চেষ্টা করেন। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় তিনি নতুন দিল্লীর বিরলা ভবন (বিরলা হাউস) মাঝে রাত্রিকালীন পথসভা করছিলেন। তার হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ছিলেন একজন হিন্দু মৌলবাদী যার সাথে চরমপন্থী হিন্দু মহাসভার যোগাযোগ ছিল। হিন্দু মহাসভা পাকিস্তানীদের অর্থ সাহায্য দেবার প্রস্তাব করে ভারতকে দূর্বল করার জন্য গান্ধীকে দোষারোপ করে।[৮] গোডসে এবং সহায়তাকারী নারায়ণ আপতেকে পরবর্তীতে আইনের আওতায় এনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ১৯৪৯ সালের ১৪ নভেম্বর তাদের ফাঁসি দেয়া হয়। নতুন দিল্লীর রাজঘাটের স্মুতিসৌধে আছে "হে রাম" যাকে অনুবাদ করে বলা যায় "ও ঈশ্বর" এত দুটি শব্দ দুটিকে গান্ধীর শেষ কথা বলে বিশ্বাস করা হয়, অবশ্য এই উক্তির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে।[৯] জওহরলাল নেহরু রেডিওতে জাতীর উদ্দশ্যে ভাষণে বলেন: “ "বন্ধু ও সহযোদ্ধারা আমাদের জীবন থেকে আলো হারিয়ে গেছে, এবং সেখানে শুধুই অন্ধকার এবং আমি ঠিক জানি না আপনাদের কি বলব কেমন করে বলব। আমাদের প্রেমময় নেতা যাকে আমরা বাপু বলে থাকি, আমাদের জাতীর পিতা আর নেই। হয়ত এভাবে বলায় আমার ভূল হচ্ছে তবে আমরা আর তাকে দেখতে পাব না যাকে আমরা বহুদিন ধরে দেখেছি, আমরা আর উপদেশ কিংবা স্বান্ত্বনার জন্য তার কাছে ছুটে যাব না, এবং এটি এক ভয়াবহ আঘাত, শুধু আমার জন্যই নয়, এই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য।"[১০] ” গান্ধীর ইচ্ছানুযায়ী, তার দেহভস্ম বিম্বের বেশ কয়েকটি প্রধান নদী যেমন: নীলনদ, ভোলগা, টেমস প্রভৃতিতে ডুবানো হয়। সামান্য অংশ ডঃ ভি এম নোলের (পুণের একজন সাংবাদিক ও প্রকাশক) পক্ষ থেকে পরমহংস যোগানন্দকে পৌছে দেয়া হয়। এরপর তার দেহভস্ম সেলফ রিয়ালাইজেশন ফেলোশিপ লেক স্রাইনের মহাত্মা গান্ধী বিশ্ব শান্তি সৌধে একটি হাজার বছরের পুরনো চৈনিক পাথরের পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। সত্য[সম্পাদনা] গান্ধী তার জীবনকে সত্য অনুসন্ধানের বৃহৎ উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে, এবং নিজের উপর নিরীক্ষা চালিয়ে তা অর্জন করেছিলেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন দি স্টোরি অফ মাই এক্সপেরিমেণ্টস উইথ ট্রুথ যার অর্থ সত্যকে নিয়ে আমার নিরীক্ষার গল্প। গান্ধী বলেন তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল নিজের অন্ধকার ভয় ও নিরাপত্তাহীনতাকে কাটিয়ে ওঠা। গান্ধী তাঁর বিশ্বাসকে প্রথম সংক্ষিপ্ত করে বলেন, ঈশ্বর হল সত্য। পরবর্তীতে তিনি তাঁর মত বদলে বলেন, সত্য হল ঈশ্বর। এর অর্থ সত্যই হল ঈশ্বরের ক্ষেত্রে গান্ধীর দর্শন। অহিংসা[সম্পাদনা] অহিংসার ধারনার বহিঃপ্রকাশ হিন্দু ধর্মীয় চিন্তাধারা এবং নিদর্শনের হিসেবে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, ইহুদি এবং খ্রিষ্টান বর্ণণায় পাওয়া যায়। গান্ধী তার জীবনীতে বলেন: “যখন আমি হতাশ হই , আমি স্মরণ করি সমগ্র ইতিহাসেই সত্য ও ভালবাসার জয় হয়েছে । দুঃশাসক ও হত্যাকারীদের কখনো অপরাজেয় মনে হলেও শেষ সবসময়ই তাদের পতন ঘটে মনে রাখবেন সর্বদাই। নিরামিষভোজন[সম্পাদনা] শিশু থাকতে গান্ধী পরীক্ষামূলকভাবে মাংস খান। এটি হয়ত তার বংশগত কৌতুহল ও তার বন্ধু শেখ মেহতাবের কারণে হয়েছে। নিরামিষভোজন এর ধারণা হিন্দু ও জৈন ধর্মে গভীরভাবে বিদ্যমান এবং তার স্থানীয় রাজ্য গুজরাটএ, বেশির ভাগ হিন্দুই ছিলেন নিরামিষভোজী। গান্ধী পরিবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। লণ্ডনে পড়তে যাবার আগে গান্ধী তার মা পুতলিবাই এবং চাচা বেচারজির কাছে প্রতিগ্ঞা করেন যে, তিনি মাংস খাওয়া, মদ্যপান এবং নারীসঙ্গ থেকে বিরত থাকবেন। তিনি এই প্রতিগ্ঞা পালন করেছিলেন এবং এর মাধ্যমে খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি একটি দর্শন লাভ করেছিলেন। গান্ধী পরবর্তী জীবনে একজন পূর্ণ নিরামিষভোজী হয়ে ওঠেন। তিনি নিরামিষভোজনের উপর "দি মোরাল বেসিস অফ ভেজিটেরিয়ানিজম" বইটির পাশাপাশি এ বিষয়ের উপর বেশ কিছু নিবন্ধ লেখেন। এই লেখাগুলো কিছু কিছু ছাপা হয় লণ্ডনের নিরামিষভোজী সংগঠন লণ্ডন ভেজিটেরিয়ান সোসাইটির প্রকাশনা দি ভেজিটেরিয়ান এ। গান্ধী এ সময় অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব্যের সঙ্গলাভ করেন এবং লণ্ডন ভেজিটেরিয়ান সোসাইটির চেয়ারম্যান ড. জোসেফ ওল্ডফিল্ড এর বন্ধু হয়ে ওঠেন। হেনরি স্টিফেনস সল্টের লেখা ও কাজের পাঠক ও সমঝদার হয়ে ওঠা গান্ধী নিরামিষ খাওয়ার পক্ষে আন্দোলনকারীদের সাথেও মাঝে মাঝে যোগ দেন। লণ্ডন থেকে ফেরার পর গান্ধী নিরামিষ খাবার ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করেন। গান্ধীর মতে, নিরামিষ শুধু শরীরের চাহিদাই মেটাবে না, এটি মাংসের প্রয়োজন মিটানোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যও পুরণ করবে, যা সব্জী ও ফলের চেয়ে মূল্যবান। এছাড়াও সে সময় অনেক ভারতীয়ই নিম্ন আয়ের হওয়ার নিরামিষভোজন আন্দোলন কেবল আদর্শগত আন্দোলন না থেকে বাস্তব রুপও নিয়েছে। তিনি অনেক সময় ধরে খাওয়ার বিরোধীতা করেছেন, অনশন করাকে রাজনৈতিক প্রতিবাদ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি তার দাবি আদায়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত না খাওয়ার প্রতিগ্ঞা করতেন। তার জীবনীতে লেখা আছে, নিরামিষভোজনই ছিল ব্রহ্মচর্চায় তার গভীর মনযোগের সূচনা। মুখের উপর নিয়ন্ত্রণ না আনতে পারলে তার ব্রহ্মচার্য্য ব্যর্থ হতে পারত। ব্রহ্মচর্য[সম্পাদনা] গান্ধীর ষোল বছর বয়সে তার বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। গান্ধী তার বাবার অসুস্থতার পুরো সময় তার সাথে থাকেন। একরাতে গান্ধীর চাচা এসে তাকে বিশ্রাম নেবার সুযোগ করে দেন। তিনি তার বেডরুমে ফিরে যান এবং কামনার বশবর্তী হয়ে তার স্ত্রীর সাথে প্রণয়ে লিপ্ত হন। এর সামান্য পরেই একজন কর্মচারি এসে তার পিতার মৃত্যুসংবাদ জানায়। তিনি এ ঘটনাটিকে দ্বিগুণ লজ্জা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই ঘটনাটি গান্ধীকে ৩৬ বছর বয়সে বিবাহিত থাকা অবস্থায় একজন ব্রহ্মচারী হতে বাধ্য করে।[১১] এই সিদ্ধান্তের পেছনে ব্রহ্মচর্যের দর্শন তাকে ব্যাপকভাবে প্ররোচিত করে, যা আদর্শগত ও বাস্তবগত পবিত্রতার চর্চা করে। গান্ধী ব্রহ্মচর্যকে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ এবং আত্মোপলব্ধির পন্থা হিসেবে দেখতেন। গান্ধী তার আত্মজীবনীতে তার শৈশবের স্ত্রী কাস্তুর্বার সম্পর্কে তার কামলালসা এবং হিংসার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার কথা বলেন। গান্ধী আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আদর্শ হবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন যেন তিনি ভোগ করার বদলে ভালোবাসতে শেখেন। গান্ধীর কাছে ব্রহ্মচর্যের অর্থ, "চিন্তা, বাক্য ও কর্মের নিয়ন্ত্রণ"।[১২] বিশ্বাস[সম্পাদনা] গান্ধী হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার সারা জীবন ধরে হিন্দু ধর্মের চর্চা করেন। হিন্দু ধর্ম থেকেই তিনি তাঁর অধিকাংশ আদর্শ গ্রহণ করেন। একজন সাধারণ হিন্দু হিসেবে তিনি সকল ধর্মকে সমানভাবে বিবেচনা করতেন এবং তাঁকে এই ধারণা থেকে বিচ্যুত করার সব প্রচেষ্টা প্রতিহত করেন। তিনি ব্রহ্মবাদে আগ্রহী ছিলেন এবং সব বড় ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। হিন্দুবাদ সম্পর্কে তিনি নিচের উক্তিটি করেন: “ হিন্দুবাদ আমাকে পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত করে, আমার সম্পুর্ণ স্বত্ত্বাকে পরিপূর্ণ করে...। যখন সংশয় আমাকে আঘাত করে, যখন হতাশা আমার মুখের দিকে কড়া চোখে তাকায়, এবং যখন দিগন্তে আমি একবিন্দু আলোও দেখতে না পাই, তখন আমি ভগবত গীতার দিকে ফিরে তাকাই, এবং নিজেকে শান্ত করার একটি পংক্তি খুঁজে নিই; এবং আমি অনতিবিলম্বে অত্যাধিক কষ্টের মাঝেও হেসে উঠি। আমি ভগবত গীতার শিক্ষার কাছে কৃতজ্ঞ। গান্ধী গুজরাটি ভাষায় "ভগবত গীতা"র উপর ধারাভাষ্য লেখেন। গুজরাটি পাণ্ডুলিপিটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন মহাদেব দাসী। তিনি একটি অতিরিক্ত সূচনা এবং ধারাভাষ্য যোগ করেন। এটি গান্ধীর একটি ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে।[১৩][১৪] গান্ধী বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি ধর্মের মূলে আছে সত্য ও প্রেম (করুণা, অহিংসা এবং সোনালী শাসন)। তিনি একজন ক্লান্তিহীন সমাজ সংস্কারক ছিলেন এবং সব ধর্মের ভণ্ডামী, অপকর্ম ও অন্ধবিশ্বাসের বিপক্ষে ছিলেন। ধর্ম সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন: “ যদি আমি খ্রিস্টান ধর্মকে নিখুঁত এবং শ্রেষ্ঠতম ধর্ম হিসেবে মেনে নিতে না পারি, তবে হিন্দু ধর্মকেও সেভাবে মেনে নিতে পারি না। হিন্দুধর্মের ত্রুটিগুলি আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যদি অস্পৃশ্যতা হিন্দু ধর্মের অংশ হয় তবে, এটি একটি পচা অংশ বা আঁচিল। বেদবাক্যগুলোকে ঈশ্বরের অনুপ্রাণিত উক্তি বলার কারণ কি? যদি এগুলো অনুপ্রাণিত হয় তবে বাইবেল বা কোরান কেন নয়। খ্রিস্টান বন্ধুরা যেভাবে আমাকে ধর্মান্তরিত করতে প্রবল চেষ্টা করেছেন তেমনি মুসলিম বন্ধুরাও করেছেন। আবদুল্লাহ শেঠ ইসলাম চর্চা করার জন্য আমাকে প্ররোচিত করে চলেছেন এবং এর সৌন্দর্য সম্পর্কে সবসময়ই তার কিছু বলার থাকে। যখনি আমরা নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলি, আমরা ধার্মিক হওয়া থেকে ক্ষান্ত হই। নৈতিকতা হারিয়ে ধার্মিক হওয়া বলতে কিছু নেই। উদাহরণস্বরুপ, মানুষ মিথ্যাবাদী, নির্মম এবং আত্মসংযমহীন হয়ে দাবি করতে পারে না যে ঈশ্বর তার সাথে আছেন। ” পরবর্তী জীবনে তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় তিনি হিন্দু কি না তিনি বলেন, “ হ্যাঁ, আমি তাই। এ ছাড়াও আমি একজন খ্রিস্টান, একজন মুসলিম, একজন বৌদ্ধ এবং একজন ইহুদি। ” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গান্ধীর ভিতরে পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা স্বত্ত্বেও তাঁরা একাধিকবার নিজেদের মধ্যে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এই বিতর্কগুলি সে সময়কার জনপ্রিয়তম দুই ভারতীয়ের ভিতরে দার্শনিক মতভেদকে প্রমাণ করে। ১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৪ সালে বিহারে একটি ভূমিকম্প আঘাত করে এবং এটি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের কারণ হয়। গান্ধী বলেন, এটি হবার কারণ হল উঁচুশ্রেণীর হিন্দুদের অস্পৃশ্যদের তাদের প্রাসাদে ঢুকতে না দেবার পাপের ফল। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর এই মন্তব্যের ব্যাপক বিরোধীতা করে বলেন, ভূমিকম্প কেবল প্রাকৃতিক কারণেই সংঘটিত হতে পারে, অস্পৃশ্যতার চর্চা যতই বেমানান হোক না কেন। সরলত্ব[সম্পাদনা] গান্ধী প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন যে, সামাজিক কাজে নিয়োজিত একজন ব্যক্তি অবশ্যই সাধারণ জীবন যাপন করবে যেটা তার মতে তাকে ব্রহ্মচর্যের পথে নিয়ে যাবে । তাঁর সরলত্বের সূচনা ঘটে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাপিত পশ্চিমি জীবনাচরণ ত্যাগ করার মাধ্যমে। তিনি এটিকে "শুন্যে নেমে যাওয়া" হিসেবে আখ্যায়িত করেন যার মধ্যে ছিল অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে ফেলা, সাদামাটা জীবনযাপন গ্রহণ করা এবং নিজের কাপড় নিজে ধোয়া।[১৫] একবার তিনি নাটালদের দেয়া উপহার ফিরিয়ে দেন।[১৬] পরিধানের বস্ত্র[সম্পাদনা] ১৯৩১ সালে গান্ধী গেছেন লন্ডনে, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিতে, তা দেখে চার্চিল আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে বলেছিলেন তাঁর বমি আসছে, গান্ধীর অর্ধনগ্ন ফকিরের পোশাক দেখে নয়, ওই রকমের পোশাকধারী একজন আইন-অমান্য আন্দোলন চালাচ্ছে আবার সেই সঙ্গে সমান মর্যাদায় ভারত সম্রাটের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলছেন।[১৭] গান্ধীর জামাকাপড়ের হ্রস্বতা দেখে তার অনুরাগী অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন যিনি ওই সময়েই গান্ধীকে দেখতে গিয়েছিলেন, এবং দেখে যাঁর মনে হয়েছিল, শীতের দেশে গান্ধী ওই পোশাকে এসে নিজেকে এমনভাবে প্রত্যক্ষ করে না-তুললেও পারতেন৷[১৮] পরিধেয় নিয়ে গান্ধী নিজে অবশ্য মোটেই বিব্রতবোধ করেন নি, ঊষ্ণ আবহাওয়া ও দরিদ্র ভারতীয়দের পোশাক ওই রকমেরই মামুলি হওয়া দরকার বলে তিনি ভাবতেন৷[১৯] ঐ বেশেই তিনি গোলটেবিল বৈঠকের সদস্যদের জন্য বাকিংহাম প্যালেসে সম্রাট পঞ্চম জর্জের দেওয়া রাজকীয় অভ্যর্থনায় যোগ দিয়েছেন, এবং নিজের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে সম্রাটের সঙ্গে কৌতূকপূর্ণ বাক্য বিনিময় করেছেন৷ পরবর্তীতে গান্ধীর বেশভূষার স্বল্পতার কথা উল্লেখ করায়, গান্ধী জবাব দিয়েছিলেন, 'তাতে কোনো অসুবিধা হয় নি, কেননা সম্রাটের নিজের গায়ে যে পোশাক ছিল তা আমাদের দু'জনের জন্য পর্যাপ্ত৷' লেখালেখি[সম্পাদনা] গান্ধী ছিলেন বহুমূখী লেখক, সম্পাদক। দশক ধরে তিনি সম্পাদনা করেছেন গুজরাটী, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা হরিজন। কেবল ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন ইন্ডিয়ান অপিনিয়ন ও দেশে ফেরার পর ইয়ং ইন্ডিয়া। তাছাড়া তার হাতেই সম্পাদিত হতো গুজরাটী ভাষার মাসিকপত্র নবজীবন যা পরে হিন্দি ভাষায়ও প্রকাশিত হতো।[২০] গান্ধী পত্র-পত্রিকায় প্রচুর চিঠি লিখতেন। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন পত্রিকায় তার চিঠি প্রকাশিত হতো। গান্ধীর বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তার আত্মজীবনী, সত্যের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার গল্প (The Story of My Experiments with Truth), দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রাম নিয়ে “দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ (Satyagraha in South Africa), স্বাধীকার বিষয়ে মেনিফেস্টো “হিন্দি স্বরাজ” (Hind Swaraj or Indian Home Rule) ও গুজরাটী ভাষায় জন রাসকিন-এর Unto This Last । [২১] শেষোক্তটি গান্ধীর অর্থনৈতিক কর্মসূচী হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এছাড়া নিরামিষভোজন, আহার ও স্বাস্থ্য, ধর্ম, সমাজ সংসখবর ইত্যাদি বিষয়েও তিনি প্রচুর লেখালেখি করেছেন। গান্ধী মূলত লিখতেন গুজরাটী ভাষায়। তবে, তাঁর বই-এর হিন্দি ও ইংরেজি অনুবাদ তিনি দেথে দিতেন। ১৯৬০ এর-এর দশকে ভারত সরকার গান্ধীর রচনাবলী (The Collected Works of Mahatma Gandhi) প্রকাশ করে। প্রায় শতাধিক খন্ডে প্রকাশিত এই রচনাবলীতে প্রায় ৫০,০০০ পাতা আছে। ২০০০ সালে এর একটি পুনমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হলে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। গান্ধীর অনুসারীরা অভিযোগ করে যে, রাজনেতিক উদ্দ্যেশে সেখানে পরিবর্তন করা হয়েছে। [২২] গান্ধী বিষয়ক বই[সম্পাদনা] বেশ কয়েকজন জীবনীকার গান্ধীর জীবনী রচনার কাজ করেছেন। এর মধ্যে দুইটি রচনা প্রনিধানযোগ্য। ডি. জি. তেন্ডুলকরের আট খণ্ডের Mahatma. Life of Mohandas Karamchand Gandhi ও পিয়ারীলাল ও সুশীলা নায়ারের দশখণ্ডের Mahatma Gandhi। বলা হয়ে থাকে আমেরিকান সেনাবাহিনীর জি বি সিংহ ২০ বছর [২৩] ধরে গান্ধীর মূল বক্তৃতা ও রচনা সংগ্রহ করেছেন তার গবেষণা গ্রন্থ ‌Gandhi Behind the Mask of Divinity এর জন্য। অনুসারী ও প্রভাব[সম্পাদনা] অনেক রাজনৈতিক নেতা ও আন্দোলনকে গান্ধী প্রভাবিত করেছেন। আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলন-এর অন্যতম নেতা মার্টিন লুথার কিং ও জেসম লওসন গান্ধীর অহিংস নীতির আলোকে নিজেদের কর্মপন্থা ঠিক করতেন। [২৪] দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা নেলসন মেন্ডেলাও গান্ধীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছন।[২৫] এই তালিকায় আরো আছেন খান আবদুল গাফফার খান [২৬] , স্টিফ বিকো ও অং সান সু চী [২৭] গান্ধীর জীবন ও শিক্ষা অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে। এদের অনেকে পরবর্তী সময়ে গান্ধীকে তাদের শিক্ষাগুরু হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আবার অনেকে সারাজীবন গান্ধীর আদর্শ প্রচার করেছেন। ইউরোপে রোমেইন রোল্যান্ড ১৯২৪ সালে প্রথম তার “মহাত্মা গান্ধী” গ্রন্থে তাঁকে ইউরোপে তুলে ধরেন। ১৯৩১ সালে পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন গান্ধীর সঙ্গে পত্রালাপ করেন। গান্ধীর কাছে লেখা এক চিঠিতে আইনস্টাইন গান্ধীকে “আগামী প্রজন্মের জন্য আদর্শ” (a role model for the generations to come) হিসাবে বর্ণনা করেন। [২৮] এছাড়া ব্রিটিশ গায়ক জন লেনন অহিংসা নিয়ে তার অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে গান্ধীকে উল্লেখ করতেন। [২৯] ২০০৭ সালে এক সম্মেলনে আমেরিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট তার ওপর গান্ধীর প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন। [৩০] অবদান[সম্পাদনা] গান্ধীর জন্মদিন অক্টোবর ২ ভারতের জাতীয় ছুটি, গান্ধী জয়ন্তী হিসাবে পালিত হয়। ২০০৭ সালের ১৫ জুন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গান্ধীর জন্মদিনকে বিশ্ব অহিংস দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।[৩১] মহাত্মা গান্ধী বহুত্ববাদী ভারতীয় সমাজে সৌভ্রাতৃত্বপূর্ন সহাবস্থান আদর্শের বিশিষ্ট প্রবক্তা। সমালোচনা[সম্পাদনা] দক্ষিণ আফ্রিকায় লেখা গান্ধীর কিছু নিবন্ধ বিতর্কিত। পূণর্মুদ্রিত “দি কালেকটেড ওয়ার্কস অফ মহাত্মা গান্ধী” (ভলিউম ৮, পৃষ্ঠা.১২০) এ গান্ধী “ইণ্ডিয়ান ওপিনিয়ন” প্রবন্ধে ১৯০৮ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার সময় সম্পর্কে বলেন, অনেক স্থানীয় কয়েদী পশুত্ব থেকে কেবল একধাপ উপরে এবং প্রায়ই নিজেদের ভিতরে বিবাদ ও হানাহানি করত”। একই সংকলনের (ভলিউম ২, পৃষ্ঠা.৭৪)তে, গান্ধীর ২৬ সেপ্টেম্বর১৮৯৬ সালে দেয়া একটি ভাষণের উল্লেখ করা হয় যেখানে তিনি কাফির বলেন, যাদের পেশা শিকার করা এবং একমাত্র লক্ষ্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক গবাদি পশু জমিয়ে বউ ক্রয় করা। কাফির শব্দটিকে বর্তমানে আক্রমণাত্মক শব্দ হিসেবে বলা হয়। এমন সব উক্তির জন্য গান্ধীর বিরুদ্ধে বর্ণবাদের কিছু অভিযোগ উঠেছে।[৩২] আরও দেখুন[সম্পাদনা] মাদাম তুসো জাদুঘর %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%85%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%AB%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%A1_%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%95%E0%A6%95 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 স্যার অ্যালফ্রেড যোসেফ হিচকক (জন্মঃ আগস্ট ১৩, ১৮৯৯; মৃত্যুঃ এপ্রিল ২৯, ১৯৮০[৪]) একজন ইংরেজ চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন।[৫] যুক্তরাজ্যের চলচ্চিত্র ইন্ড্রাস্টিতে তিনি নির্বাক ও সবাক দুইধরনের চলচ্চিত্র নির্মান করেই সাফল্য পেয়েছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে সাফল্য পাওয়ার পর ১৯৩৯ সালে তিনি ইংল্যান্ড থেকে হলিউডে চলে আসেন[৬] এবং তিনি ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। অ্যালফ্রেড হিচকক পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার দীর্ঘ পরিচালনা জীবনে নিজের জন্য পরিচালনার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও জনপ্রিয় একটি ধারা তৈরি করেছেন।[৭] উদ্বেগ, ভয়, কল্পনা অথবা সহানুভূতির অভিব্যক্তি বাড়িয়ে দিয়ে তিনি শটকে এমন ভাবে ফ্রেমবন্দি করতেন ও সম্পাদনা করতেন যা সম্পূর্ন ছবিকে এক অন্যন্য মাত্রায় উপস্থাপন করত।[৮] তার চলচ্চিত্রের অধিকাংশের কাহিনীতেই নারী চরিত্র পাওয়া যায় যারা পুলিশের কাছ থেকে সবসময় পালিয়ে থাকে।[৯] হিচককের বহু ছবির সমাপ্তি ঘটেছে মিশ্র ঘটনার মধ্য দিয়ে এবং রোমহর্ষক প্লটগুলো চিত্রায়িত হয়েছে ভায়োলেন্স, খুন এবং অপরাধের ঘটনা দিয়ে। জীবনী[সম্পাদনা] অ্যালফ্রেড হিচকক ইংল্যান্ডের লন্ডনে এক রোমান ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ১৩ আগস্ট। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় পুত্র সন্তান ছিলেন তিনি । তার স্কুল এবং কলেজ ছিল জিসুইট ক্লাসিক স্কুল সেন্ট ইগনাতিয়াস কলেজ[১০] ও সালেসিয়ান কলেজ।[১১][১২] তাঁর মা ও পিতামহী ছিল আইরিশ বংশভূত।[১৩][১৪] প্রায় পাঁচ বছর বয়সে, তার বাবা তার খারাপ ব্যবহারের জন্যে নিকটবর্তী থানা পুলিশের কাছে প্রেরণ করেন তাকে পাঁচ মিনিট বন্দী করে রাখার জন্যে।[১৫][১৬] আর অল্প বয়সের এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতিই পরবর্তীতে তার সিনেমাজুড়ে আতংক, সাসপেন্স এ ব্যাপারগুলোকে বেশি আনতে আগ্রহী করে তুলে।[১৭] মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর তিনি লন্ডন কাউন্টি স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড নেভিগেশন এ যান সেন্ট ইগনাতিয়াস ছেড়ে।[১৮] শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ড্রাফটসম্যান এবং অ্যাডভারটাইজিং ডিজাইনার হিসেবে ক্যাবল কোম্পানি “হেনলি”তে কাজ করেন।[১৯] ১৯১৯ সালে হেনলি টেলিগ্রাফ প্রতিষ্ঠিত হয় আর তার প্রথম সংকলনে প্রকাশিত হয় তার লেখা “গ্যাস” , যেখানে অল্পবয়সী এক নারীকে তার লেখা আবর্তিত হয় । তার পরবর্তী লেখার নাম ছিল “দ্য ওমেন পার্ট”, এটাও একই সালে প্রকাশিত হয় একই পত্রিকায়। এখানে একজন স্বামী ও তার স্ত্রীর মাঝে সাংঘর্ষিক জীবনের কথা ফুটে উঠে।[২০] এছাড়া “সরদিদ”, “এন্ড দেয়ার ওয়াজ নো রেইনবো” এর মত লেখাও তিনি লিখেছেন। তার সর্বশেষ লেখা ছিল “ফেডোরা” , যেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী কেমন হবে তা নিয়ে।[২১] ১৯২০ সালের দিকে এসে অ্যালফ্রেড হিচকক আগ্রহী হয়ে উঠেন ফটোগ্রাফি এবং চলচ্চিত্রের প্রতি। তিনি লন্ডনে ফিল্ম প্রোডাক্টশনে কাজ করা শুরু করেন। “প্যারামাউন্ট পিকাচার”র লন্ডন শাখায় তিনি টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন।[২২] এরপর তিনি “ইসলিংটন স্টুডিও”তে কাজ করেন। এরপর টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে করতে চিত্রপরিচালক তিনি আত্নপ্রকাশ করেন। আন্তঃ-যুদ্ধে ব্রিটিশ কর্মজীবন[সম্পাদনা] ১৯২২ সালে “নাম্বার থার্টিন” নামে চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেন।[২৩] কিন্তু তার জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রটি অসম্পূর্ণই থেকে যায়। এরপর একের পর এক তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যান। আর চলচ্চিত্রে তিনি ফুটিয়ে তুলতে থাকেন তার নান্দনিকতা । ১৯২২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাধারে নির্মাণ করে যান বিভিন্ন চলচ্চিত্র । যাতে উঠে এসেছে সাসপেন্স , থ্রিলিং, রোমান্স। ১৯২৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন “দ্য প্লেজার গার্ডেন” । এ চলচ্চিত্রটি ছিল ব্রিটিশ-জার্মান প্রোডাক্টশনের এবং চলচ্চিত্রটি দারুণ জনপ্রিয় হয় । এরপর হিচকককে আর তাকিয়ে থাকতে হয়না । এরপর তিনি বিভিন্ন প্রোডাক্টশনের ব্যানারে একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যেতে থাকেন । ১৯২৭ সালে মুক্তি পায় তার চলচ্চিত্র “দ্য লডজার” । একই বছরের ডিসেম্বরে হিচকক বিয়ে করেন আলমা রিভিলিকে । “দ্য লেডি ভেনিশেস(১৯৩৮)” ও “জ্যামাইকা ইন(১৯৩৯) “ এর মত চলচ্চিত্র নির্মাণ এর পর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে আমেরিকাতেও । হলিউড[সম্পাদনা] অ্যালফ্রেড হিচকক ১৯৪০ সালে পুরো পরিবার নিয়ে হলিউডে যান। শুরু হয় তার হলিউডে চলচ্চিত্র জীবন । ডেভিডও সেলযনিকের প্রযোজনায় চলচ্চিত্র “রেবেকা”। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৪০ সালে। রেবেকা তখন অস্কারের আসরে বছরের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরষ্কার লাভ করে।[২৪] ১৯৪২ সালে “সাবতিউর” মুক্তির পায়। এরপর হলিউডে মুক্তি পায় একের পর এক ক্ল্যাসিক সব চলচ্চিত্র। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, লাইফবোট (১৯৪৪), স্পেলবাউন্ড (১৯৪৫), নটোরিয়াস (১৯৪৬), রোপ (১৯৪৮), স্ট্রেন্জারস অন এ ট্রেইন (১৯৫১), ডায়াল এম ফর মার্ডার (১৯৫৪), ঐ একই বছর মুক্তি পায় আরেকটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র রিয়ার উইন্ডো। ১৯৫৮ আর ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় দুইটি চলচ্চিত্র যথাক্রমে ভার্টিগো আর নর্থ বাই নর্থওয়েষ্ট। এরপর আসে সেই বিখ্যাত ১৯৬০ সাল। হিচককের ফিল্মোগ্রাফি ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এসময় মুক্তি পাওয়া “সাইকো (১৯৬০)” চলচ্চিত্রটির ব্যবসায়িক সাফল্য আর দর্শকপ্রিয়তা ছিলো চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক। অতি সম্প্রতি হিচককের সাইকোর সিনেমা নির্মাণের ভিতরের কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র “হিচকক”, যেখানে অ্যান্থনি হপকিন্স অভিনয় করেছেন হিচককের চরিত্রে। সাইকোর পর ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় আরেক সাড়াজাগানো চলচ্চিত্র দ্যা বার্ডস।[২৫] “ফ্যামিলি প্লট (১৯৭৬)” ছিলো তার পরিচালিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। হিচককের ফিল্মোগ্রাফিতে আরেকটি উজ্জ্বলতম অধ্যায় হয়ে আছে ১৯৫৫ সালে প্রচারিত অ্যালফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টস। এটি ছিলো একটি টিভি শো, যার প্রতিটি পর্বের ব্যাপ্তিকাল ছিলো ২৫ মিনিট। ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু হওয়া এই সিরিজটি চলে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত। ১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ অ্যালফ্রেড হিচকক আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট লাইফ এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পান । অনুষ্ঠানে তিনি একটা কথাই বলেন আর তা হচ্ছে চারজন মানুষের কথা । তারা হচ্ছেন এডিটর , লেখক ,তার মেয়ে প্যাট এবং তার স্ত্রী আলমা রিভিলি । যাদের স্নেহ , ভালোবাসা ও উৎসাহ ছাড়া তিনি এতদূর আসতে পারতেননা । “এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি” ম্যাগাজিনে বিশ্বের সেরা একশত চলচ্চিত্রের মধ্যে তার চলচ্চিত্র “সাইকো”, “ভারটিগো”, “নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট”, “নটোরিয়াস” স্থান পায় । এছাড়া ব্রিটেনের বিখ্যাত এম্পায়ার ম্যাগাজিনের “গ্রেটেস্ট ডিরেক্টরস এভার” তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন হিচকক। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের হান্ড্রেড মোস্ট হার্ট পাউন্ডিং মুভিজ তালিকায় ৯ টি সিনেমাই হিচককের। যার মধ্যে প্রথমস্থানটি অর্জন করেছে “সাইকো “। তিনি গোল্ডেন গ্লোব , সিনেমা জাম্পো অ্যাওয়ার্ড , লরিয়াল অ্যাওয়ার্ড , ডিরেক্টরস গিল্ড অফ আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড ,আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট অ্যাওয়ার্ড , একাডেমী অ্যাওয়ার্ড এর সম্মাননা সহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন । মৃত্যু[সম্পাদনা] ১৯৭৭ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের সাথে “দ্য শর্ট নাইট” নিয়ে কাজ করেন যা তার মৃত্যুর পরে স্ক্রিনপ্লে হয়।[২৬][২৭] ১৯৮০ সালের ২৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের কার্লিফোনিয়াতে তিনি ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[২৮] মৃত্যুর কয়েক মাস আগে রাণী এলিজাবেথের কাছে তিনি নাইট উপাধি লাভ করেছিলেন। আলফ্রেড হিচককের কিছু চলচ্চিত্র প্রতি নেয়া তার আয়[সম্পাদনা] দ্য লেডি ভেনিশেস (১৯৩৮) -$৫০,০০০ সাসপিশন (১৯৪১)- $২,৫০০/ সপ্তাহ নটোরিয়াস (১৯৪৬)- $৭,০০০/সপ্তাহ রেয়ার উইন্ডো (১৯৫৪)-$১৫০,০০০+১০%লাভ +ফিল্মের নেগেটিভের মালিকানা দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ (১৯৫৬)-$১৫০,০০০+১০%লাভ +ফিল্মের নেগেটিভের মালিকানা ভারটিগো (১৯৫৮)-$১৫০,০০০+১০%লাভ +ফিল্মের নেগেটিভের মালিকানা নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট (১৯৫৯)-$২৫০,০০০+১০%লাভ সাইকো (১৯৬০)-৬০%লাভ চলচ্চিত্রের তালিকা[সম্পাদনা] মূল নিবন্ধ: অ্যালফ্রেড হিচককের চলচ্চিত্র নাম্বার ১৩ (১৯২২) (অসম্পূর্ন) অলওয়েজ টেল ইউর ওয়াইফ (১৯২৩) (অসম্পূর্ন) দ্য প্লেজার গার্ডেন (১৯২৫) মাউন্টেইন ঈগল (১৯২৬) (হারিয়ে গিয়েছে) দ্য লুজার: অ্য স্টোরি অফ দ্য লন্ডন ফগ (১৯২৭) দ্য রিং (১৯২৭) ডাউনহিল (১৯২৭) দ্য ফার্মার’স ওয়াইফ (১৯২৮) ইজি ভার্চ্যু (১৯২৮) চ্যাম্পেগেন (১৯২৮) দ্য ম্যানাক্সম্যান (১৯২৯) ব্ল্যাকমেইল (১৯২৯) জুনো অ্যান্ড দ্য পেকক (১৯৩০) মার্ডার! (১৯৩০) এল্‌সট্রি কলিং (১৯৩০) দ্য স্কিন গেইম (১৯৩১) ম্যারি (১৯৩১) রিচ অ্যান্ড স্ট্রেইঞ্জ (১৯৩১) নাম্বার সেভেনটিন (১৯৩২) ওয়েলজেস ফ্রম ভিয়েনা (১৯৩৩) দ্য ম্যান হু নু টু মাচ (১৯৩৪) দ্য ৩৯ স্টেপ্‌স (১৯৩৫) সিক্রেট এজেন্ট (১৯৩৬) স্যাবোটেজ (১৯৩৬) ইয়াং অ্যান্ড ইনোসেন্ট (১৯৩৭) দ্য লেডি ভ্যনিশেস (১৯৩৮) জ্যামাইকা ইন (১৯৩৯) রেবেকা (১৯৪০) ফরেইন কারেসপন্ডেন্ট (১৯৪০) মিস্টার অ্যান্ড মিসেস স্মিথ (১৯৪১) সাসপিশন (১৯৪১) স্যাবোটিয়ার (১৯৪২) শ্যাডো অফ এ ডাউট (১৯৪৩) লাইফবোট (১৯৪৪) অ্যাডভেঞ্চার ম্যালগেইচ (১৯৪৪) বন ভয়েজ (১৯৪৪) স্পেলবাউন্ড (১৯৪৫) নটরিয়াস (১৯৪৬) দ্য প্যারাডাইন কেইস (১৯৪৭) রোপ (১৯৪৮) আন্ডার ক্যাপ্রিকর্ন (১৯৪৯) স্টেইজ ফাইট (১৯৫০) স্ট্রেঞ্জার্‌স অফ এ ট্রেইন (১৯৫১) আই কনফেস (১৯৫৩) ডায়াল এম ফর মার্ডার (১৯৫৪) রেয়ার উইন্ডো (১৯৫৪) টু ক্যাচ আ থিফ (১৯৫৫) দ্য ট্রাব্‌ল উইথ হ্যারি (১৯৫৫) দ্য ম্যান হু নু টু মাচ (১৯৫৬) দ্য রং ম্যান (১৯৫৬) ভার্টিগো (১৯৫৮) নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট (১৯৫৯) সাইকো (১৯৬০) দ্য বার্ডস (১৯৬৩) মেরিন (১৯৬৪) টর্ন কার্টেইন (১৯৬৬) টোপাজ (১৯৬৯) ফ্রেঞ্জি (১৯৭২) ফ্যামিলি প্লট (১৯৭৬) %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%B6%E0%A6%9A%E0%A7%80%E0%A6%A8_%E0%A6%A4%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A6%B0 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 শচীন রমেশ তেন্ডুলকর (শুনুনi/səˈtʃɪn tɛnˈduːlkər/) (হিন্দি এবং মারাঠী: सचिन तेंडुलकर; জন্ম এপ্রিল ২৪, ১৯৭৩) একজন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার, ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চমানের ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।[২][৩] শচীনের মাত্র ষোলো বছর বয়সে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় এবং এরপর থেকে প্রায় চব্বিশ বছর তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলেন। তিনি টেস্ট ক্রিকেট ও একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় সর্বোচ্চসংখ্যক শতকের অধিকারীসহ বেশ কিছু বিশ্বরেকর্ড ধারণ করে আছেন। তিনি প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা ও টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ মিলিয়ে শততম শতক করেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে ২০১২ সালের এশিয়া কাপ চারদেশীয় ক্রিকেট ম্যাচে তিনি এই রেকর্ড করেন।[৪] একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ইতিহাসে প্রথম দ্বিশতরানের মালিক তিনি।[৫][৬][৭][৮] ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই অক্টোবর, তিনি সমস্ত ধরণের স্বীকৃত ক্রিকেট খেলায় প্রথম ভারতীয় হিসেবে মোট ৫০,০০০ রানের মালিক হন।[৯][১০][১১] ২০০২ সালের উইজডেন এর একটি নিবন্ধে তাকে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা টেস্ট ক্রিকেটার এবং ভিভ রিচার্ডসের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা একদিনের ক্রিকেটার বলে অভিহিত করা হয়েছে।[১২][১৩] তিনি ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন।[১৪] ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে উইজডেনের দেড়শ বছর উপলক্ষ্যে সর্বকালীন সেরা বিশ্ব টেস্ট একাদশের দলে এক্মাত্র ভারতীয় হিসেবে তাঁর স্থান হয়।[১৫][১৬][১৭][১৮] তিনি ১৯৯৭ - ১৯৯৮ সালের জন্য ভারতের খেলাধুলার সর্বোচ্চ পুরস্কার রাজীব গান্ধী খেলরত্ন পুরস্কার এবং ১৯৯৯ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার পদ্মভূষণ প্রদান করা হয়। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে আইসিসির পক্ষ থেকে শচীনকে বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে স্যার গারফিল্ড সোবার্স ট্রফি প্রদান করে।[১৯] ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন।[২০] শচীন প্রথম ভারতীয় খেলোয়াড় যাকে ভারতীয় বিমানবাহিনী মর্যাদাসূচক ক্যাপ্টেন পদ প্রদান করে। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে ডিসেম্বর শচীন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে[২১][২২][২৩][২৪] এবং ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেট থেকে অবসর নেন।[২৫] ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর মুম্বই শহরের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ২০০তম টেস্ট ম্যাচ জয়লাভ করে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন।[২৬][২৭] অবসর গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই ভারত সরকার শচীনকে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ভারতরত্ন প্রদান করা হবে বলে ঘোষণা করেন। [২৮][২৯] জন্ম ও শৈশব[সম্পাদনা] ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে এপ্রিল নির্মল নার্সিং হোমে শচীন তেন্ডুলকর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রমেশ তেন্ডুলকর একজন মারাঠি ঔপন্যাসিক ছিলেন। তাঁর মাতা রজনী তেন্ডুলকর বীমা কোম্পানিতে কাজ করতেন।[৩০] রমেশ বিখ্যাত ভারতীয় সুরকার শচীন দেববর্মণের নামানুসারে তাঁর নাম শচীন রাখেন। শচীনের দুই দাদা নিতিন ও অজিত এবং দিদি সবিতা রমেশের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সন্তান।[৩১] প্রথম জীবনে শচীন বান্দ্রা (পূর্ব) অঞ্চলের সাহিত্য সহবাস কো-ওপারেটিভ হাউসিং সোসাইটিতে বসবাস করতেন।[৩২] শুরুর ক্রিকেট জীবন[সম্পাদনা] ছোটবেলায় শচীন জন ম্যাকেনরোকে আদর্শ করে টেনিস খেলার প্রতি আকৃষ্ট হলেও তাঁর দাদা অজিত তাঁকে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে দাদরের শিবাজী পার্ক অঞ্চলে বিখ্যাত ক্রিকেট কোচ রমাকান্ত আচরেকরের কাছে তাঁকে নিয়ে যান। আচরেকরের নির্দেশে দাদরের শচীনকে শারদাশ্রম বিদ্যামন্দির উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়[১][৩৩] এবং আচরেকর তাঁকে ক্রিকেটে শিক্ষাদান শুরু করেন।[৩৪][৩৩][৩৫] এই সময় শচীন তাঁর বিদ্যালয়কে মাতুঙ্গা গুজরাটী সেবা মন্ডল শীল্ড জয়ে সহায়তা করেন।[৩৬] এছাড়াও তিনি বোম্বাইয়ের কঙ্গ লীগ প্রতিযোগীতায় জন ব্রাইট ক্রিকেট ক্লাবের হয় এবং পরে ক্রিকেট ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার হয়ে খেলেন। [৩৩][৩৭][৩৮][৩৯] ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে চৌদ্দ বছর বয়সে মাদ্রাজে এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে ফাস্ট বোলিং করার প্রশিক্ষণ নিতে গেলে অস্ট্রেলিয়ার দ্রুতগতির ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলি তাঁকে ব্যাটিংয়ে মনোনিবেশ করতে বলেন।[৪০] ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জানুয়ারী মুম্বইয়ের ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার স্বর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এক প্রদর্শনী ম্যাচে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী ক্রিকেট দলের হয়ে শচীন পরিবর্তিত খেলোয়াড় হিসেবে খেলেন।[৪১] ১৯৮৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে খেলায় তিনি বলবয় হিসেবে সুযোগ পান।[৪২][৪৩] ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তেন্ডুলকর তাঁর খেলা প্রতিটি ইনিংসে শতরান করেন। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বন্ধু বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে লর্ড হ্যারিস শীল্ড আন্তঃ স্কুল প্রতিযোগিতায় সেন্ট জেভিয়ার্স হাই স্কুলের বিরুদ্ধে ৬৬৪ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ করেন। এই খেলায় শচীন ঐ ইনিংসে অপরাজিত ৩২৬* এবং পুরো প্রতিযোগিতায় এক হাজারেরও বেশি রান করেন ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই নভেম্বর তেন্ডুলকর রঞ্জি ট্রফি প্রতিযোগিতায় মুম্বই ক্রিকেট দলের হয়ে সুযোগ পেলেও কোন ম্যাচে প্রথম একাদশে খেলার সুযোগ তাঁর হয়নি।[৩৩] নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল ভারত সফর চলাকালীন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে নেটে প্রশিক্ষণরত ভারতীয় দলের অধিনায়ক কপিল দেবের বলের বিরুদ্ধে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে শচীন সহজেই তাঁকে খেলতে থাকলে মুম্বই ক্রিকেট দলের অধিনায়ক দিলীপ বেঙ্গসরকার তাঁকে মুম্বই দলে প্রথম একাদশে সুযোগ দেন। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর মাত্র পনেরো বছর ২৩২ দিন বয়সে শচীন ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে মুম্বই ক্রিকেট দলের হয়ে গুজরাট ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পেয়ে অপরাজিত ১০০ রান করে ভারতের কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেকে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট খেলায় শতরানের রেকর্ড করেন।[১] এরপর তিনি দেওধর ট্রফি ও দলীপ ট্রফিতেও শতরান করেন।[৪৫] ১৯৮৮-৮৯ মরসুমে শচীন মুম্বইয়ের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন।[note ১][৪৬] এছাড়াও তিনি ১৯৮৯-৯০ মরসুমের শুরুতে ইরানি ট্রফি প্রতিযোগিতায় অবশিষ্ট ভারতের হয়ে দিল্লী ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে অপরাজিত শতরান করেন।[৪৭] ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে শচীন দুইবার ইংল্যান্ড সফর করেন।[৪৮][৪৯] ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সফরে আসা অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে মুম্বই ক্রিকেট দলের হয়ে প্রথম দ্বিশতরান (২০৪*) করেন।[১][৫০] ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে রঞ্জি ট্রফি প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে তামিল নাড়ু ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে অপরাজিত ২৩৩ রান করেন।[৫১][৫২][৫৩] আন্তর্জাতিক ক্রিকেট[সম্পাদনা] আরো দেখুন: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীন তেন্ডুলকরের শতরানের তালিকা শুরুর দিক[সম্পাদনা] আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তেন্ডুলকর[৫৪] ম্যাচ জয় হার ড্র টাই ফলাফলবিহীন টেস্ট ক্রিকেট[৫৫] ২০০ ৭২ ৫৬ ৭২ ০ – একদিনের আন্তর্জাতিক[৫৬] ৪৬৩ ২৩৪ ২০০ – ৫ ২৪ টোয়েন্টি ২০[৫৭] ১ ১ – – – – মাত্র একটি প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট মরসুমের পরই[৫৮] ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজ সিং দুঙ্গারপুর শচীনকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সফরে ভারতীয় দলের সদস্য হিসেবে নির্বাচন করেন।[৫৯] এরফলে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে করাচী টেস্টে মাত্র ১৬ বছর ২২৩ দিন বয়সে তাঁর আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট অভিষেক হয়। এই ম্যাচে তিনি মাত্র পনেরো করে ওয়াকার ইউনুসের বলে বোল্ড হন।[৬০] সিয়ালকোট টেস্টে তিনি ওয়াকার ইউনিসের বলে নাকে আঘাত পেয়েও খেলা চালিয়ে যান।[৬১] পেশোয়ার শহরে অনুষ্ঠিত একটি ২০ ওভারের প্রদর্শনী ম্যাচে তেন্ডুলকর মাত্র ১৮ বলে ৫৩ রান করেন। এর মধ্যে পাকিস্তানের বিখ্যাত লেগ স্পিনার আব্দুল কাদিরের এক ওভারে তিনি ২৭ রান করেন।[৬২][note ২][৬৩] অভিষেক টেস্ট শৃঙ্খলায় তিনি ৩৫.৮৩ গড়ে ২১৫ রান করেন এবং তাঁর খেলা একটিমাত্র একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে কোন রান না করেই তিনি আউট হন[৬৪][৬৫] এরপর ভারতের নিউজিল্যান্ড সফরে তিনি টেস্টে ২৯.২৫ গড়ে মোট ১১৭ রান করেন, যার মধ্যে দ্বিতীয় টেস্টের একটি ইনিংসে ৮৮ রান করেন।[৬৬] নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুটি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে তিনি ০ এবং ৩৬ রান করে আউট হন।[৬৭] ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ইংল্যান্ড সফরে দ্বিতীয় টেস্টে বিশ্বের দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসেবে তিনি তাঁর জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট শতরান (১১৯*) করেন।[৬১][n ১] ১৯৯২ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ঠিক পূর্বে অস্ট্রেলিয়া সফরে তেন্ডুলকর তৃতীয় সিডনি টেস্টে অপরাজিত ১৪৮* ও অন্তিম পার্থ টেস্টে ১১৪ রান করে ক্রিকেট বিশ্বের সম্ভ্রম আদায় করে নেন। উত্থান[সম্পাদনা] তেন্ডুলকর ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে অকল্যান্ড শহরে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর জীবনের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ওপেন করেন।[৬৯] এই ম্যাচে তিনি ৪৯ বলে ৮২ রান করেন। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কার কলম্বো শহরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক শতরান করেন। ১৯৯৬ ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় তিনি দুইটি শতরান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন।[৭০] ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের ভারত সফরে এলে এই সফরের প্রস্ততি হিসেবে রঞ্জি ট্রফি বিজয়ী মুম্বই ক্রিকেট দলের হয়ে এক তিনদিনের ম্যাচে শচীন বিখ্যাত স্পিন বোলার শেন ওয়ার্নের বিরদ্ধে খেলে অপরাজিত ২০৪* করে অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করেন।।[৭১][৭২][৭৩] এই প্রতিযোগিতায় শচীন দুইটি টেস্ট শতরান, একদিনের ক্রিকেটে কানপুরে শতরান এবং কোচিতে পাঁচ উইকেট নিয়ে ভারতকে বিজয়ী হতে সহায়তা করেন।[৭৪] এরপর শারজাহতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় ১৯৯৮ কোকা কোলা কাপ প্রতিযোগিতায় দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শতরান করে ভারতকে কাপজয়ী করেন।[৭৫][৭৬] ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা শহরে অনুষ্ঠিত আইসিসি কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে শচীন ১৪১ রান করে ও চার উইকেট নিয়ে ভারতকে সেমিফাইনালে পৌছে দেন। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ১৯৯৮-৯৯ এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায়[৭৭] কলকাতার ইডেন গার্ডেনস মাঠে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের শোয়েব আখতারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে শচীন রান আউট হয়ে গেলে দর্শকদের ক্ষোভে খেলা বন্ধ করে দিতে হয়। কিন্তু কিছু পরে শচীনের আবেদনে দর্শকেরা শান্ত হলে খেলা আবার শুরু হয়।[৭৮] এই ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।[৭৯] এই প্রতিযোগিতায় শচীন শ্রীলঙ্কা।[৮০] ও পকিস্তানের বিরুদ্ধে শতরান করেন ১৯৯৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা চলাকালীন শচীনের পিতা রমেশ তেন্ডুলকরের মৃত্যু হলে শচীন প্রতিযোগিতার মাঝেই পিতার সৎকারের জন্য ভারত ফিরে আসেন। শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানের পর তিনি পুনরায় প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েই কেনিয়ার বিরুদ্ধে অপরাজিত ১৪০* রান করে তাঁর পিতাকে এই শতরান উৎসর্গ করেন।[৮১] অধিনায়কত্ব[সম্পাদনা] অধিনায়ক হিসেবে শচীনের রেকর্ড ম্যাচ জয় হার ড্র টাই ফলাফলবিহীন টেস্ট[৮২] ২৫ ৪ ৯ ১২ ০ – একদিনের ক্রিকেট[৮৩] ৭৩ ২৩ ৪৩ – ২ ৬ ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে শচীন মহম্মদ আজহারউদ্দীনের পর ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। কিন্তু তাঁর অধিনায়ক জীবন খুব একটা সফল ছিল না।[৮৪] অধিনায়কত্ব লাভের পর ভারত অস্ট্রেলিয়া সফরে গেলে ০-৩ ফলাফলে পরাজিত হয়।[৮৫] এরপর দক্ষিণ আফ্রিকা ভারত সফরে এসে ভারতকে ২-০ ফলাফলে পরাজিত করলে শচীন অধিনায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেন। আঘাতপ্রাপ্তি ও সফলতাবিহীন সময়কাল[সম্পাদনা] ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তেন্ডুলকর পোর্ট অফ স্পেন টেস্টে তাঁর উনত্রিশতম শতরান করে ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড স্পর্শ করেন।[৮৬][৮৭][৮৮][৮৯] কিন্তু এরপরের ইনিংসগুলিতে যথাক্রমে ০,০, ৮ এবং ০ রান করলে ভারত প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয়। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর ত্রিশতম টেস্ট শতরান করে ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ভেঙ্গে দেন।[৯০][৯১] ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় ১১টি ম্যাচে ৬৭৩ রান করে ভারতকে ফাইনালে নিয়ে যেতে সহায়তা করেন। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার নিকটে ভারত পরাজিত হলেও শচীন প্রতিযোগিতার সেরা নির্বাচিত হন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি টেস্ট ক্রিকেটে ভালো খেলতে না পারলেও ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিডনিতে অপরাজিত ২৪১* রান করেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরের টেস্ট প্রতিযোগিতায় তিনি অপরাজিত ১৯৪ রান করেন।[৯২][৯৩][৯৪][৯৫][৯৬] এরপর কনুইয়ের যন্ত্রণায় ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের বেশিরভাগ সময় শচীন ক্রিকেট খেলতে পারেননি। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর তেন্ডুলকর ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে শচীন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে নিজস্ব পঁয়ত্রিশতম টেস্ট শতরান করে বিশ্বরেকর্ড করেন। এরপর প্রায় দেড় বছর পর ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাঁর পরের টেস্ট শতরান করেন।[৯৭] ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একদিনের ক্রিকেটে তাঁর উনচল্লিশতম শতরান করেন। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে মার্চ ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২১ বলে মাত্র ১ রান করে আউট হলে দর্শকেরা প্রথমবার তাঁকে টিটকিরি দেয়।[৯৮] এই প্রতিযোগিতায় শচীন একটিও অর্ধশতরান না করায় ও তাঁর কাঁধের শল্যচিকিৎসা হওয়ায় তাঁর ক্রিকেট জীবন সম্বন্ধে প্রশ্ন দেখা দেয়। কিন্তু ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই সেপ্টেম্বর সুস্থ হয়ে ফিরে এসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে একদিনের ক্রিকেটে অপরাজিত ১৪১ রান করে তাঁর চল্লিশতম শতরান করেন। ২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় ভারতের কোচ গ্রেগ চ্যাপেল শচীনের বার বার ব্যর্থতায় ভারতের জেতার সম্ভাবনা কমে যাওয়ার কথা বলেন। তিনি শচীনকে ব্যাটিং অর্ডারে নীচের দিকে নামতে বললে শচীন তা মানতে না চাইলে তিনি শচীনের সমালোচনাও করেন।[৯৯] এই ঘটনায় আবেগপ্রবণ শচীন প্রতিক্রিয়া জানালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তাঁর কাছে এই আচরণের ব্যাখ্যা জানাতে নির্দেশ দেন।[১০০] এই প্রতিযোগিতায় কোচের নির্দেশ মতো শচীন ব্যাটিং অর্ডারে নীচের দিকে নেমে পুরোপুরি ব্যর্থ হলে ইয়ান চ্যাপেল তাঁকে অবসর নেওয়ার পরামর্শ দেন।[১০১] ধারাবাহিকতা প্রাপ্তি[সম্পাদনা] ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে সিডনিতে আটত্রিশতম টেস্ট শতরান করে শচীন ২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতার পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলায় তিনি আবার ওপেন করে প্রতিযোগিতার সেরা হন। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ফিউচার কাপেও তিনি সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও প্রতিযোগিতার সেরা হন।[১০২] ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে জুলাই নটিংহ্যাম টেস্টে শচীন বিশ্বের তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ১১,০০০ রান করেন।.[১০৩] ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি ৫৩.৪২ গড়ে ভারতের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন।[১০৪] ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পরের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি ২৭৮ রান করে ভারতের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন।[১০৫] ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ৯০ থেকে ১০০ রানের মধ্যে শচীন বেশ কয়েকবার আউট হয়ে যান। এরমধ্যে তিনবার ৯৯ রান করে তিনি আউট হন।[১০৬] ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ভারত অস্ট্রেলিয়া সফরে গেলে শচীন চারটি টেস্ট ম্যাচে মোট ৪৯৩ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন। সিডনিতে দ্বিতীয় টেস্টে শতরান করলে ঐ মাঠে শচীনের গড় দাঁড়ায় ২২১.৩৩। অ্যাডিলেডে চতুর্থ টেস্টে তিনি ১৫৩ রান করেন। কমনওয়েলথ ব্যাংক ত্রি-দেশীয় একদিনের সিরিজে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি ব্রিসবেনে শচীন ১৬,০০০ রান পূর্ণ করেন। এই প্রতিযোগিতার প্রথম ফাইনালে তিনি অপরাজিত ১১৭[১০৭] এবং দ্বিতীয় ফাইনালে ৯১ রান করে ভারতকে জয়ী করেন।[১০৮] ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা ভারত সফরে এলে একটি মাত্র ইনিংস খেলে কুঁচকিতে চোট পান।[১০৯] ফলে প্রতিযোগিতার বাকি দুই টেস্ট এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশকে নিয়ে ত্রিদেশীয় প্রতিযোগিতা ও ২০০৮ এশিয়া কাপ খেলতে পারেননি।[১১০] ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কা সফরে তিনটি টেস্টে মাত্র ১৫.৮৩ গড়ে মোট ৯৫ রান করলে ভারত এই প্রতিযোগিতা হেরে যায়।[১১১] এই সফরে একদিনের ক্রিকেটে চোটের জন্য শচীনকে সরে যেতে হয়। কিন্তু পরের অস্ট্রেলিয়া সফরে তিনি টেস্টে মোট ১২,০০০ রান করে ব্রায়ান লারার রেকর্ড ভেঙ্গে টেস্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের বিশ্বরেকর্ড করেন। এই প্রতিযোগিতায় দুইটি অর্ধ-শতরান ও একটি শতরান করলে ভারত প্রতিযোগিতা জিতে যায়। কিন্তু এরপর আবার চোটের জন্য ইংল্যান্ডের ভারত সফরের সাতটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের প্রথম তিনটি থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চেন্নাই টেস্টে অপরাজিত ১০৩* রান করে ভারতকে জয় করেন। কিন্তু ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে শ্রীলঙ্কা সফরে তেন্ডুলকর ব্যর্থ হন। এরপর নিউজিল্যান্ড সফরে তৃতীয় একদিনের ম্যাচে অপরাজিত ১৬৩ এবং প্রথম টেস্টে ১৬০ করে বিয়াল্লিশতম টেস্ট শতরান করেন। এরপর ত্রিদেশীয় কম্প্যাক কাপের ফাইনালে ১৩৮ রান করে ভারতকে কাপজয়ী করেন। ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরের প্রথম চারটি ম্যাচে শচীন যথাক্রমে ১৪, ৪, ৩২, ৪০ করেন। পঞ্চম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ৫০ ওভারে ৩৫০/৪ রান করলে তাঁর জবাবে শচীন ১৪১ বলে ১৭৫ রান করলেও শেষের দিকের ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় ভারত মাত্র ৩ রানে পরাজিত হয়। এই ম্যাচে তেন্ডুলকর একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় বিশ্বে সর্বপ্রথম ১৭,০০০ রান করেন। এরপর শচীন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্টে একটি [১১২] ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুইটি শতরান করেন। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার ভারত সফরে তিনি টেস্টে দুইটি শতরান এবং একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশ্বের প্রথম দ্বি-শতরান করেন।[১১৩] ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে টেস্টে ১৪,০০০ রানের পথে তেন্ডুলকর বিশ্বকাপ জয়[সম্পাদনা] আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শতরান টেস্ট ক্রিকেট একদিনের আন্তর্জাতিক অস্ট্রেলিয়া ১১ ৯ শ্রীলঙ্কা ৯ ৮ দক্ষিণ আফ্রিকা ৭ ৫ ইংল্যান্ড ৭ ২ নিউজিল্যান্ড ৪ ৫ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩ ৪ জিম্বাবুয়ে ৩ ৫ পাকিস্তান ২ ৫ বাংলাদেশ ৫ ১ কেনিয়া – ৪ নামিবিয়া – ১ মোট ৫১ ৪৯ ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় ৫৩.৫৫ গড়ে ৪৮২ রান করে শ্রীলঙ্কার তিলকরত্নে দিলশানের পরেই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় এবং ভারতের সর্বাধিক রান সংগ্রাহক হন।[১১৪] এই প্রতিযোগিতার ফাইনালে ভারতে শ্রীলঙ্কাকে পরাজিত করে বিশ্বকাপ জয় করে।[১১৫] তেন্ডুলকরের জীবনে এটি ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময়।[n ২] শততম শতরানের পথে[সম্পাদনা] বিশ্বকাপের পরে শচীন জুলাই মাসে ইংল্যান্ড সফরে যান।[১১৭] এই সফর চলাকালীন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তেন্ডুলকরের টেস্ট ও একদিনের আন্তর্জাতিক মিলিয়ে শততম শতরানের সম্ভাবনার ব্যাপারে জনমানসে যথেষ্ট উৎসাহ থাকলেও তিনি ৩৪.১২ গড়ে রান করে সর্বাধিক ৯১ রান করতে সক্ষম হন।[১১৮][১১৯] এই প্রতিযোগিতায় ভারত ০-৪ ফলাফলে পরাজিত বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট র‌্যাঙ্কিং থেকে নেমে যায়। এই প্রতিযোগিতায় শচীন পুনরায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ান।[১১৮] ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই নভেম্বর তেন্ডুলকর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে খেলতে নেমে টেস্ট ক্রিকেট প্রথম ১৫,০০০ রান করার বিশ্বরেকর্ড করেন।[১২০][১২১] ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ তেন্ডুলকর ২০১২ এশিয়া কাপ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে তাঁর বহুপ্রতীক্ষিত শততম শতরান করে বিশ্বরেকর্ড করেন।[১২২][n ৩] এই রেকর্ডের পরেও ভারত বাংলাদেশের নিকট পরাজিত হয়।[১২৪] অবসর[সম্পাদনা] টেস্টে ধারাবাহিকভাবে অর্ধ-শতক লাভকারী ক্রিকেটার দক্ষিণ আফ্রিকা এবি ডি ভিলিয়ার্স ১২ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড ভিভ রিচার্ডস ১১ ভারত গৌতম গম্ভীর ১১ ভারত বীরেন্দ্র শেওয়াগ ১১ বাংলাদেশ মমিনুল হক ১১ ইংল্যান্ড জন এডরিচ ১১ ভারত শচীন তেন্ডুলকর ১০ উৎস: ক্রিকইনফো যোগ্যতা: খেলোয়াড়ী জীবনে ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ অর্ধ-শতক। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আশানুরূপ খেলতে না পারায় শচীন ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে ডিসেম্বর একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা করেন।[১২৫][১২৬][১২৭] এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় প্রাক্তন ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আসন্ন প্রতিযোগিতায় শচীনের খেলা উচিত ছিল। প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার অনিল কুম্বলে[n ৪] ও জাভাগাল শ্রীনাথ[n ৫] শচীনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর তেন্ডুলকর ঘোষনা করেন যে, তিনি তাঁর জীবনের ২০০তম টেস্ট খেলে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেবেন।[১২৯] ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সেই অনুযায়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ঐ বছর নভেম্বর মাসে কলকাতা ও মুম্বাই শহরে দুইটি টেস্ট ম্যাচের আয়োজন করেন।[১৩০][১৩১] মুম্বাইতে অনুষ্ঠিত তাঁর ২০০তম টেস্ট ম্যাচে তিনি ৭৪ রান করেন, ফলে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর ১৬,০০০ থেকে মাত্র ৭৯ রান দূরে তিনি তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ করেন।[১৩২] শচীনের অবসরকে উল্লেখযোগ্য করতে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ও মুম্বাই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।[১৩৩][১৩৪] টোয়েন্টি ২০ ক্রিকেট[সম্পাদনা] টোয়েন্টি ২০ ক্রিকেটে শচীন তেন্ডুলকর[৫৪] ম্যাচ রান সর্বাধিক রান শতরান অর্ধ-শতরান গড় টুয়েন্টি২০ আন্তর্জাতিক[১৩৫] ১ ১০ ১০ ০ ০ ১০.০০ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ[১৩৬] ৭৮ ২৩৩৪ ১০০* ১ ১৩ ৩৪.৮৩ চ্যাম্পিয়ন্স লীগ টুয়েন্টি২০[১৩৭] ১৩ ২৬৫ ৬৯ ০ ১ ২০.৩৮ ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একমাত্র টোয়েন্টি ২০ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি এই ধরণের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করবেন না।[১৩৮] ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ প্রতিযোগিতায় ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে শচীনকে ১,১২১,২৫০ $ চুক্তিতে[১৩৯] মুম্বই ইন্ডিয়ানস দলের অধিনায়ক নির্বাচিত করা হয়।[১৪০] ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ প্রতিযোগিতায় মুম্বই ইন্ডিয়ানস ফাইনালে পৌঁছয়। এই প্রতিযোগিতায় শচীন ১৪টি ইনিংসে ৬১৮ রান করে প্রতিযোগিতার সেরা, সবচেয়ে ভালো ব্যাটসম্যান ও সবচেয়ে ভালো অধিনায়কের পুরস্কার জিতে নেন। ২০১১ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ প্রতিযোগিতায় কোচি টাস্কার্স কেরালা দলের বিরুদ্ধে শচীন মাত্র ৬৬ বলে অপরাজিত ১০০ রান করে তাঁর একমাত্র টোয়েন্টি ২০ শতরান করেন। এই প্রতিযোগিতায় তিনি মোট ১,৭২৩ রান করেন।[১৪১] ২০১৩ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ প্রতিযোগিতায় ২৬শে মে ফাইনালে মুম্বই ইন্ডিয়ানস চেন্নাই সুপার কিংস দলকে কলকাতার ইডেন গার্ডেনস মাঠে ২৩ রানে পরাজিত করলে তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ থেকে অবসরের কথা ঘোষনা করেন।[২৫] ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স লীগ টোয়েন্টি২০ প্রতিযোগিতায় খেলার পর তেন্ডুলকর টোয়েন্টি২০ ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন।[১৪২] খেলার ধরণ[সম্পাদনা] ব্যবসায়িক প্রাপ্তি[সম্পাদনা] ক্রিকেটে তেন্ডুলকরের অবদানকে পুঁজি করে তাঁর অসম্ভব জনপ্রিয়তার দরুণ অতীতের যেকোন বাণিজ্যিক চুক্তিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় যখন তিনি ১৯৯৫ সালে ওয়ার্ল্ডটেলের সাথে ₹৩০ কোটি (US$৫.৯৯ মিলিয়ন) চুক্তিবদ্ধ হন।[১৪৩] পরবর্তীতে ২০০১ সালে আবারো ৫ বছরের জন্য নবায়ণ করেন ₹৮০ কোটি (US$১৫.৯৬ মিলিয়ন)র বিনিময়ে।[১৪৪] ২০০৬ সালে সাচি এন্ড সাচি’র সাথে ₹১৮০ কোটি (US$৩৫.৯১ মিলিয়ন) তিন বছর মেয়াদী চুক্তি করেন।[১৪৫] টেন্ডুলকার তাঁর জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে দু’টি রেস্টুরেন্ট হিসেবে - তেন্ডুলকর’স,[১৪৬] কোলাবা, মুম্বাই এবং শচীন’স,[১৪৭] মুলুন্দ, মুম্বাই চালু করেন। মার্স রেস্টুরেন্টের মালিক সঞ্জয় নারাং এর সাথে উক্ত রেস্টুরেন্টগুলো যৌথভাবে পরিচালিত করছেন। এছাড়াও, তিনি ব্যাঙ্গালোরে শচীন’স নামে নতুন একটি রেঁস্তোরা চালু করবেন। ২০০৭ সালে শচীন ফিউচার গ্রুপ এবং মানিপাল গ্রুপের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্যসেবা এবং খেলাধূলায় শারীরিক সক্ষমতার লক্ষ্যে ‘এস ড্রাইভ এণ্ড সাচ’ নামক পণ্য উৎপাদনে আসার ঘোষণা করে।[১৪৮] ভার্জিন কমিকের পরিবেশনায় শচীনকে মহাবীর প্রদর্শন করে কমিক বই প্রকাশের পরিকল্পনা নিয়েছে।[১৪৯] বিজ্ঞাপন[সম্পাদনা] জীবন্ত কিংবদন্তি ও বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটস্‌ম্যান হিসেবে শচীন তেন্ডুলকর নিম্নলিখিত পণ্য ও সংস্থার বিজ্ঞাপন চিত্রে অংশগ্রহণ করেন:- ক্রমিক নং পণ্যের নাম মেয়াদকাল (১) পেপসি ১৯৯২ থেকে বর্তমান[১৫০] (২) ক্যানন ২০০৬ থেকে ২০০৯[১৫১] (৩) এয়ারটেল ২০০৪-২০০৬[১৫২] (৪) নাজারা টেকনোলোজিস ২০০৫-২০০৮[১৫৩] (৫) ব্রিটানিয়া ২০০১-২০০৭[১৫৪] (৬) হোমট্রেড ২০০১-২০০৭[১৫৫] (৭) সানফিস্ট ২০০৭-২০১৩[১৫৬] (৮) জাতীয় ডিম সমন্বয় কমিটি ২০০৩-২০০৫[১৫৭] (৯) বুস্ট ১৯৯০ থেকে বর্তমান[১৫৮] (১০) একশন শ্যুজ ১৯৯৫-২০০০[১৫৯] (১১) এডিডাস ২০০০-২০১০[১৬০] (১২) ফিয়েট পালিও ২০০১-২০০৩[১৬১] (১৩) রেনল্ডস ২০০৭ থেকে বর্তমান[১৬২] (১৪) টিভিএস ২০০২-২০০৫[১৬৩] (১৫) ইএসপিএন স্টার স্পোর্টস ২০০২ থেকে বর্তমান[১৬৪] (১৬) জি-হ্যাঞ্জ ২০০৫-২০০৭[১৬৫] (১৭) স্যানিও বিপিএল ২০০৭ থেকে বর্তমান[১৬৬] (১৮) এইডস্‌ সচেতনতা প্রদর্শনী ২০০৫[১৬৭] (১৯) কোলগেট-পালমোলাইভ[১৬৮] (২০) ফিলিপস্‌[১৬৯] (২১) এমআরএফ[১৬৮] (২২) ভিসা[১৭০] (২৩) আভিভা (২৪) রয়্যাল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ড গ্রুপ (২৫) তোসিবা %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 স্পাইডার-ম্যান উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে (স্পাইডার ম্যান থেকে পুনর্নির্দেশিত) স্পাইডার-ম্যান Spider-Man.jpg দ্য এমেইজিং স্পাইডারম্যান এর ৫৪৭তম সংখ্যা থেকে নেয়া প্রকাশনার তথ্য পরিবেশক মারভেল কমিকস প্রথম আবির্ভাব এমেইজিং ফ্যান্টাসি, সংখ্যা#১৫, আগস্ট ১৯৬২ নির্মাতা স্ট্যান লী, স্টিভ ডিটকো কাহিনীর তথ্য Alter ego পিটার বেনজামিন পার্কার পিটার পার্কার দলের অন্তর্ভুক্তি ডেইল ব্যুগল ফ্রন্ট লাইন হীরোস ফর হায়ার নিউ ফ্যান্টাস্টিক ফোর অ্যাভেন্জারস নিউ অ্যাভেঞ্জারস ফিউচার ফাউন্ডেশন সিক্রেট ডিফেন্ডার্স অংশীদারিত্ব ভেনম স্কারলেট স্পাইডার উলভারীন হিউম্যান টর্চ ডেয়ারডেভিল ব্ল্যাক ক্যাট পানিশার টক্সিন আয়রন ম্যান মিস মারভেল গ্রিন-গবলিন(হ্যারি ওসবর্ন) উল্লেখযোগ্য ছদ্মনাম ডাস্ক, প্রডিজি, হর্নেট,ওয়েব-হেড,ওয়াল-ক্রলার,স্পাইডী,ওয়েব-স্লিঙ্গার,বেন রেইলি,রিকোশেট ক্ষমতা ♦ অতিমানবীয় শক্তি, ♦ দেয়াল বেয়ে উঠার ক্ষমতা, ♦ শক্তিশালি জাল নিক্ষেপের ক্ষমতা, ♦ ক্ষিপ্রতা, ♦ শারীরিক কসরৎ দেখানোর ক্ষমতা, ♦ খালি হাতে লড়াই করার ক্ষমতা, ♦অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, ♦ আশ্চর্য পর্যবেক্ষণী শক্তি, ♦ তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়াশীলতা, স্পাইডারম্যান (ইংরেজি: Spiderman) হল একটি কাল্পনিক কমিক চরিত্র। এর স্রষ্টা হলেন মার্ভেল কমিকসের প্রধান সম্পাদক, লেখক স্ট্যান লী ও কার্টুনিস্ট স্টিভ ডিটকো। স্পাইডারম্যান প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে এমেইজিং ফ্যান্টাসির ১৫তম সংখ্যায়। তাকে দেখানো হয় একজন টিনএজার হিসেবে যে তার পিতৃব্য আঙ্কেল বেন ও আন্ট মে এর ঘরে বেড়ে উঠেছে। এ বয়সে তাকে বয়োসন্ধিক্ষণের সাথে সাথে মুখোশধারী দস্যুদের সাথে সংগ্রাম করতে হয়। শীঘ্রই স্পাইডারম্যানের স্রষ্টারা তাকে অতিমানবীয় ক্ষমতাবান হিসেবে দেখানো শুরু করেন। ১৯৬০ দশকের যে সময়ে স্পাইডারম্যান প্রকাশিত হয় তখন কমিক বইগুলোতে টিনএজারদের দেখানো হতো প্রধান সুপারহিরোর পার্শ্বচরিত্র হিসেবে। স্পাইডারম্যানের পিটার পার্কার এ গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ধারা চালু করে। পিটার পার্কার একজন সাধারন স্কুল পড়ুয়া টিনএজার যার মধ্যে সমবসয়ীরা নিজেদের ছায়া খুজেঁ পায়।[১] সময়ের সাথে পিটার পার্কার তার লাজুকতা পিছনে ফেলে স্কুল থেকে কলেজে পা দেয়, সেই সাথে যুক্ত হতে থাকে নানান ঝঞ্ঝাটে। কমিকে স্পাইডারম্যানকে প্রায়ই স্পাইডি, ওয়েব-স্লিঙ্গার, ওয়াল-ক্রলার বা ওয়েব-হেড নামেও ডাকা হয়। স্পাইডারম্যান হল পৃথিবী সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল সুপারহিরোর একটি।[২] মারভেল কমিকসের ফ্ল্যাগশিপ চরিত্র এবং কোম্পানির মাস্কট হিসেবে তাকে বিভিন্ন মাধ্যমে হাজির করা হয়েছে; যেমন, এনিমেটেড বা মোশন টিভি সিরিয়াল, সংবাদপত্র এবং একটি জনপ্রিয় মুভি সিরিজ যার প্রথম তিন পর্বে অভিনয় করেছেন অভিনেতা টোবি ম্যাগুয়েরে। পরিচ্ছেদসমূহ [আড়ালে রাখো] ১ প্রকাশের ইতিহাস ১.১ আদিকথা ১.২ ব্যবসায়িক সফলতা ১.৩ কাহিনী সংক্ষেপ ২ পুরস্কার ও সম্মাননা ৩ আরো পড়ুন ৪ তথ্যসূত্র ৫ বহিঃসংযোগ প্রকাশের ইতিহাস[সম্পাদনা] আদিকথা[সম্পাদনা] ১৯৬২ সালে ফ্যান্টাস্টিক ফোর এর সাফল্যের পর মারভেল কমিকসের সম্পাদক ও প্রধান লেখক স্ট্যান লী নতুন একটি চরিত্রের সন্ধান করতে থাকেন। টিনএজারদের কাছে কমিক বইয়ের ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাকে একটি টিনএজ চরিত্র সৃষ্টিতে উদ্বদ্ধ করে। ব্যবসায়িক সফলতা[সম্পাদনা] এমেইজিং ফ্যান্টাসিতে প্রকাশিত হবার পর থেকে স্পাইডারম্যান মারভেল কমিকসের বেস্ট সেলিং কমিকস হিসেবে চলতে থাকে। কাহিনী সংক্ষেপ[সম্পাদনা] নিউ ইয়র্ক সিটির বাসিন্দা স্কুলছাত্র পিটার পার্কার তার আঙ্কেল বেন ও আন্ট মে এর ঘরে বেড়ে উঠছে। স্কুলের এক প্রদর্শনীতে এক তেজস্ক্রিয় মাকড়শার কামড়ে সে মাকড়শার মতো ক্ষিপ্রতা আর ক্ষমতা লাভ করে। এই অতিমানবীয় ক্ষমতার সাথে সে দেয়াল বেয়ে উঠার ক্ষমতা লাভ করে আর স্পাইডার সেন্স এর মাধ্যমে কোনো আক্রমনের আগেই বুঝতে পারে। তার বৈজ্ঞানিক দক্ষতা দিয়ে সে একটি ছোট যন্ত্র তৈরি করে যা দিয়ে আঠালো জাল নিক্ষেপ করা যায়। শুরুতে জনপ্রিয় হবার জন্য সে একটি পোশাক তৈরি করে এবং এর নাম দেয় স্পাইডারম্যান। একদিন সে এক চোর কে বাধা না দিয়ে পালানোর সুযোগ দেয় এবং পরবর্তীতে আবিষ্কার করে একই ব্যক্তি তার আঙ্কেল বেনকে হত্যা করেছে। স্পাইডারম্যান পরবর্তীতে হত্যাকারীকে খুজেঁ বের করে এবং প্রতিশোধ নেয় এরপর তার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে জনকল্যান মূলক কাজ করতে থাকে ও নিউ ইয়র্ক সিটিকে নানা বিপদ থেকে মুক্ত করতে থাকে। %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%B8%E0%A6%A8_%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BE %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 নেলসন ম্যান্ডেলা উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে মহামান্য নেলসন ম্যান্ডেলা ওএম এসি সিসি ওজে ওএসজে কিউসি জিসিএইচ বিআর আরএসও এনপিকে নেলসন ম্যান্ডেলা, ২০০৮ মে, দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে, তার ৯০তম জন্মদিনে ২০০৮-এ নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ে ১০ই মে, ১৯৯৪ – ১৪ই জুন, ১৯৯৯ Deputy থাবো এম্‌বেকি এফ. ডব্লিউ. ডি ক্লার্ক পূর্বসূরী এফ. ডব্লিউ. ডি ক্লার্ক উত্তরসূরী থাবো এম্‌বেকি ব্যক্তিগত বিবরণ জন্ম রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা ১৮ জুলাই ১৯১৮ Mvezo, দক্ষিণ আফ্রিকা মৃত্যু ৫ ডিসেম্বর ২০১৩ (৯৫ বছর) জাতীয়তা দক্ষিণ আফ্রিকা রাজনৈতিক দল আফ্রিকার জাতীয় কংগ্রেস দাম্পত্য সঙ্গী ইভিলিন ন্‌তকো মাসে (১৯৪৪-১৯৫৭) উইনি মাদিকিজেলা-ম্যান্ডেলা (১৯৫৭-১৯৯৬) গ্রাসা মাচেল (১৯৯৮–বর্তমান) সন্তান মাদিবা থেম্বেকিল মাগগাথো লিওয়ানিকা মাকাজিউই মাকি জিনানি জিঞ্জিসোয়া বাসস্থান হাফটন এস্টেট, জোহানেসবার্গ, গাউটেং, দক্ষিণ আফ্রিকা অধ্যয়নকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অফ ফোর্ট হ্যায়ার ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন এক্সটার্নাল সিস্টেম ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ আফ্রিকা ইউনিভার্সিটি অফ দ্য উইটওয়াটারস্র্যান্ড ধর্ম খ্রিস্টান ধর্ম (Methodism) স্বাক্ষর নেলসন ম্যান্ডেলার স্বাক্ষর ওয়েবসাইট www.nelsonmandela.org নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা (জোজা উচ্চারণ: [xoˈliːɬaɬa manˈdeːla]; জন্ম: জুলাই ১৮, ১৯১৮ - ডিসেম্বর ৫, ২০১৩)[১] ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি। তিনি ১৯৯৪ হতে ১৯৯৯ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র সংগঠন উমখন্তো উই সিযওয়ের নেতা হিসাবে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬২ সালে তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার গ্রেপ্তার করে ও অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ম্যান্ডেলা ২৭ বছর কারাবাস করেন। এর অধিকাংশ সময়ই তিনি ছিলেন রবেন দ্বীপে। ১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি কারামুক্ত হন। এর পর তিনি তাঁর দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সাথে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। এর ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে এবং সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে ১৯৯৪ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলা তাঁর গোত্রের দেয়া মাদিবা নামে পরিচিত। গত চার দশকে ম্যান্ডেলা ২৫০টিরও অধিক পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৯৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার।[২] তাছাড়াও তিনি ১৯৮৮ সালে শাখারভ পুরস্কারের অভিষেক পুরস্কারটি যৌথভাবে অর্জন করেন। পরিচ্ছেদসমূহ [আড়ালে রাখো] ১ জীবনের প্রাথমিককাল ২ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ২.১ বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রাম ২.২ গ্রেপ্তার ও রিভোনিয়ার মামলা ২.৩ কারাবাস ২.৪ মুক্তি ২.৫ শান্তি আলোচনা ৩ ব্যক্তিগত জীবন ৩.১ প্রথম বিয়ে ৪ পুরস্কার ও সম্মাননা ৫ আরও দেখুন ৬ তথ্যসূত্র ৭ গ্রন্থপঞ্জি ৮ বহিঃসংযোগ জীবনের প্রাথমিককাল[সম্পাদনা] ১৯৩৭ সালে ম্যান্ডেলা।[৩] নেলসন ম্যান্ডেলা থেম্বু রাজবংশের ক্যাডেট শাখায় জন্মগ্রহণ করেন। থেম্বু রাজবংশ দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশের ট্রান্সকেই অঞ্চলের শাসক। [৪] তাঁর জন্ম হয় ট্রান্সকেই এর রাজধানী উমতাতার নিকটবর্তী ম্‌ভেজো গ্রামে। [৪] তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন নগুবেংচুকা (মৃত্যু ১৮৩২), যিনি ছিলেন থেম্বু জাতিগোষ্ঠীর ইনকোসি এনখুলু অর্থাৎ রাজা।[৫] এই রাজার পুত্র ম্যান্ডেলা হলেন নেলসন ম্যান্ডেলার পিতামহ। নেলসনের বংশগত নাম ম্যান্ডেলাই এই পিতামহ থেকেই পাওয়া। তবে নেলসনের পিতামহী ইক্সহিবা গোত্রের হওয়ায় রীতি অনুযায়ী তাঁর শাখার কেউ থেম্বু রাজবংশে আরোহণ করার অধিকার রাখেন না [৬]। ম্যান্ডেলার বাবা গাদলা হেনরি মপাকানইসা ম্‌ভেজো গ্রামের মোড়ল হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। [৭] তবে ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরাগভাজন হবার পরে তারা ম্যান্ডেলার পিতাকে পদচ্যুত করে। তিনি তখন তার পরিবারসহ কুনু গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তবে তা সত্ত্বেও ম্‌পাকানইসা ইনকোসিদের প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন এবং থেম্বুর শাসনকর্তা হিসাবে জোঙ্গিন্তাবা দালিন্দ্যেবোকে নির্বাচিত করায় ভূমিকা রাখেন। ম্‌পাকানইসার মৃত্যুর পর দালিন্দ্যেবো ম্যান্ডেলাকে পোষ্যপূত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। [৮] ম্যান্ডেলার পিতা ম্‌পাকানইসার ছিলো চারজন স্ত্রী, ও সর্বমোট ১৩টি সন্তান (৪ পুত্র, ৯ কন্যা)। [৮] ম্যান্ডেলার মা ছিলেন ম্‌পাকানইসার ৩য় স্ত্রী নোসেকেনি ফ্যানি। ফ্যানি ছিলেন ম্‌পেম্ভু হোসা গোত্রের ন্‌কেদামার কন্যা। নানার বাড়িতেই ম্যান্ডেলার শৈশব কাটে।[৯] তাঁর ডাক নাম "রোলিহ্লাহ্লা"র অর্থ হলো "গাছের ডাল ভাঙে যে", অর্থাৎ দুষ্ট ছেলে। [১০][১১] ম্যান্ডেলা তাঁর পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। স্কুলে পড়ার সময়ে তাঁর শিক্ষিকা ম্‌দিঙ্গানে তাঁর ইংরেজি নাম রাখেন "নেলসন"।[১২] ম্যান্ডেলার বয়স যখন ৯ বছর, তখন তাঁর পিতা যক্ষা রোগে মারা যান। শাসক জোঙ্গিন্তাবা তখন তাঁর অভিভাবক নিযুক্ত হন।[৮] ম্যান্ডেলা রাজপ্রাসাদের কাছের একটি মিশনারী স্কুলে পড়াশোনা করেন। থেম্বু রীতি অনুযায়ী ১৬ বছর বয়সে ম্যান্ডেলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর গোত্রে বরণ করে নেয়া হয়। এর পর তিনি ক্লার্কবারি বোর্ডিং ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা করেন।[১৩] সেখানে ম্যান্ডেলা ৩ বছরের জায়গায় মাত্র ২ বছরেই জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাস করেন। [১৩] ১৯৩৭ সালে ম্যান্ডেলা প্রিভি কাউন্সিলে তাঁর পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। এরপর তিনি ফোর্ট বোফোর্ট শহরের মিশনারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হেল্ডটাউন স্কুলে ভর্তি হন। এখানেই থেম্বু রাজবংশের ছাত্ররা পড়াশোনা করতো। [১৪] এই স্কুলে পড়ার সময়েই ১৯ বছর বয়সে ম্যান্ডেলা দৌড় ও মুষ্টিযুদ্ধের মতো খেলাধুলায় নিয়মিত অংশ নিতে শুরু করেন। [৯] স্কুল থেকে পাস করার পর ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অফ আর্টস কোর্সে ভর্তি হন। এখানেই অলিভার টাম্বোর সাথে তার পরিচয় হয়। টাম্বো আর ম্যান্ডেলা সারাজীবন ধরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ম্যান্ডেলার আরেক বন্ধু ছিলেন ট্রান্সকেই এর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী কাইজার (কে ডি) মাটানজিমা [৬]। এই বন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদেই পরবর্তীকালে ম্যান্ডেলা বান্টুস্থানের রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণে জড়িত হন। তবে এসব নীতিমালার ক্ষেত্রে ম্যান্ডেলা ও মাটানজিমার মতবিরোধ হয়।[৯] বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষের শেষে ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্র সংসদের ডাকা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন। এর ফলে তাঁকে ফোর্ট হেয়ার থেকে চলে যেতে বলা হয়। শর্ত দেয়া হয়, কেবল ছাত্র সংসদে নির্বাচিত সদস্য হতে পারলেই তিনি সেখানে ফেরত আসতে পারবেন। [১৫] জীবনের পরবর্তী সময়ে কারাগারে বন্দী থাকার সময়ে ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার ছাড়ার অল্প পরেই জানতে পারেন, জোঙ্গিন্তাবা তাঁর সন্তান জাস্টিস (যুবরাজ ও সিংহাসনের উত্তরাধিকারী)এবং ম্যান্ডেলার বিয়ে ঠিক করার ঘোষণা দিয়েছেন। ম্যান্ডেলা ও জাস্টিস এভাবে বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না। তাই তাঁরা দুজনে জোহানেসবার্গে চলে যান।[১৬] সেখানে যাবার পর ম্যান্ডেলা শুরুতে একটি খনিতে প্রহরী হিসাবে কাজ নেন।[১৭] তবে অল্পদিন পরেই খনির মালিক জেনে যান যে, ম্যান্ডেলা বিয়ে এড়াতে জোঙ্গিন্তাবার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছেন। এটা জানার পর খনির কর্তৃপক্ষ ম্যান্ডেলাকে ছাঁটাই করেন। পরবর্তীকালে ম্যান্ডেলা জোহানেসবার্গের আইনী প্রতিষ্ঠান উইটকিন, সিডেলস্কি অ্যান্ড এডেলম্যানে কেরানি হিসাবে যোগ দেন। ম্যান্ডেলার বন্ধু ও শুভাকাঙক্ষী ওয়াল্টার সিসুলু এই চাকুরি পেতে ম্যান্ডেলাকে সহায়তা করেন। [১৭] এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময়ে ম্যান্ডেলা ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ আফ্রিকার দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এর পরে ম্যান্ডেলা ইউনিভার্সিটি অফ উইটওয়াটার্সরান্ডে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেন। এখানে তাঁর সাথে জো স্লোভো, হ্যারি শোয়ার্জ এবং রুথ ফার্স্টের পরিচয় হয়। পরবর্তিতে এই বন্ধুরা বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী হিসাবে অংশ নেন। এসময় ম্যান্ডেলা জোহানেসবার্গের উত্তরের দিকের শহর আলেক্সান্ড্রিয়াতে বাস করতেন। [১৮] রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড[সম্পাদনা] দক্ষিণ আফ্রিকার ১৯৪৮ এর নির্বাচনে আফ্রিকানারদের দল ন্যাশনাল পার্টি জয়লাভ করে। এই দলটি বর্ণবাদে বিশ্বাসী ছিলো, এবং বিভিন্ন জাতিকে আলাদা করে রাখার পক্ষপাতি ছিলো। [১৯] ন্যাশনাল পার্টির ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটে ম্যান্ডেলা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ১৯৫২ সালের অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৫ সালের জনগণের সম্মেলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এই সম্মেলনে মুক্তি সনদ প্রণয়ন করা হয়, যা ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি। [২০][২১] এই সময় ম্যান্ডেলা ও তাঁর বন্ধু আইনজীবী অলিভার টাম্বো মিলে ম্যান্ডেলা অ্যান্ড টাম্বো নামের আইনী প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন। এই প্রতিষ্ঠানটি উকিল নিয়োগ করার মতো টাকা নেই, এমন দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের স্বল্প মূল্যে আইনগত সাহায্য প্রদান করতো।[২২] ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক জীবনের প্রথমভাগে তিনি মহাত্মা গান্ধীর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী কর্মীরা আন্দোলনের প্রথম দিকে গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের নীতিকে গ্রহণ করে বর্ণবাদের বিরোধিতা করেছিলো। [২৩][২৪] ম্যান্ডেলাও প্রথম থেকেই অহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ সালের ৫ই ডিসেম্বর তারিখে ম্যান্ডেলা সহ ১৫০ জন বর্ণবাদ বিরোধী কর্মীকে দেশদ্রোহিতার মামলায় গ্রেপ্তার করে। এই মামলাটি সুদীর্ঘ ৫ বছর ধরে (১৯৫৬-১৯৬১) চলে, কিন্তু মামলার শেষে সব আসামী নির্দোষ প্রমাণিত হন।[২৫] ১৯৫২ হতে ১৯৫৯ এর মধ্যে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) এর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে উগ্রপন্থী আফ্রিকানিস্ট উপদলের কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীরা বাধা দিতে শুরু করে। আফ্রিকানিস্টরা বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে চরমপন্থী আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলো। [২৬] এএনসির নেতা অ্যালবার্ট লুথুলি, অলিভার ট্যাম্বো, ও ওয়াল্টার সিসুলু অনুভব করেন, আফ্রিকানিস্টরা এই আন্দোলনে খুব তাড়াহুড়া করছে, আর তাঁদের নেতৃত্বকে অস্বীকার করছে। [২৬] বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রাম[সম্পাদনা] ১৯৬১ সালে ম্যান্ডেলা এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন উমখোন্তো উই সিযওয়ে (অর্থাৎ "দেশের বল্লম", সংক্ষিপ্ত নাম MK) এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন এই সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। [২৭] তিনি বর্ণবাদী সরকার ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা পরিকল্পনা ও সমন্বয় করেন। এতে বর্ণবাদী সরকার পিছু না হটলে প্রয়োজনবোধে গেরিলা যুদ্ধে যাবার জন্যও ম্যান্ডেলা পরিকল্পনা করেন। [২৮] এছাড়া ম্যান্ডেলা বিদেশে এমকে-র জন্য অর্থ জোগাড় ও সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য কাজ শুরু করেন।[২৮] ম্যান্ডেলার সহকর্মী উলফি কাদেশ ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই সশস্ত্র আন্দোলনের ব্যাপারে বলেন, "When we knew that we [sic] going to start on 16 December 1961, to blast the symbolic places of apartheid, like pass offices, native magistrates courts, and things like that ... post offices and ... the government offices. But we were to do it in such a way that nobody would be hurt, nobody would get killed."[২৯] উলফির ব্যাপারে ম্যান্ডেলা বলেন, "His knowledge of warfare and his first hand battle experience were extremely helpful to me."[১১] ম্যান্ডেলা নিজে তাঁর এই সশস্ত্র আন্দোলনকে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে নিতান্তই শেষ চেষ্টা বলে অভিহিত করেন। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন সফল হবে না বলে তিনি উপলব্ধি করেন এবং এ জন্যই সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নেন। [১১][৩০] পরবর্তীকালে ১৯৮০র দশকে এমকে বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। এতে অনেক বেসামরিক লোক হতাহত হন। [২৮] ম্যান্ডেলা পরে স্বীকার করেন, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে গিয়ে এএনসি অনেক সময় মানবাধিকার লংঘন করেছে। বর্ণবাদের অবসানের পরে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন (সত্য ও আপোস কমিশন) এর রিপোর্ট থেকে এএনসির অনেক নেতা এই বিষয়ের তথ্য অপসারণ করতে চেয়েছিলো -- ম্যান্ডেলা এর তীব্র সমালোচনা করেন। [৩১] ২০০৮ এর জুলাই পর্যন্ত ম্যান্ডেলা ও এএনসি কর্মীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা থেকে নিষিদ্ধ ছিলো। কেবল মাত্র নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে তাঁদের আসার অনুমতি ছিলো। এর কারণ ছিলো ম্যান্ডেলার ষাটের দশকের সশস্ত্র আন্দোলনের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন সরকার ম্যান্ডেলা ও এএনসিকে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে ঘোষণা করেছিলো। ২০০৮ এর জুলাইতে এসেই কেবল ম্যান্ডেলাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারে প্রণীত সন্ত্রাসবাদীদের তালিকা হতে সরিয়ে নেয়া হয়। [৩২][৩৩] গ্রেপ্তার ও রিভোনিয়ার মামলা[সম্পাদনা] প্রায় ১৭ মাস ধরে ফেরারি থাকার পর ১৯৬২ সালের ৫ই আগস্ট ম্যান্ডেলাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে জোহানেসবার্গের দুর্গে আটক রাখা হয়। [৩৪] মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ম্যান্ডেলার গতিবিধি ও ছদ্মবেশ সম্পর্কে দক্ষিণ আফ্রিকার নিরাপত্তা পুলিশকে জানিয়ে দেয়, ফলে ম্যান্ডেলা ধরা পড়েন।[৩৫][৩৬][৩৭] তিন দিন পরে তাঁকে ১৯৬১ সালে শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়া এবং বেআইনীভাবে দেশের বাইরে যাবার অভিযোগে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৬২ সালের ২৫শে অক্টোবর ম্যান্ডেলাকে এই দুই অভিযোগে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এর দুই বছর পর ১৯৬৪ সালের ১১ই জুন ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে এএনসির সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্বদানের অভিযোগ আনা হয় ও শাস্তি দেয়া হয়।[৩৮] ম্যান্ডেলা কারাগারে বন্দী থাকার সময়ে পুলিশ এএনসির প্রথমসারির নেতাদের ১৯৬৩ সালের ১১ই জুলাই জোহানেসবার্গের কাছের রিভোনিয়ার লিলেসলিফ ফার্ম থেকে গ্রেপ্তার করে। রিভোনিয়ার মামলা নামে খ্যাত এই মামলায় ম্যান্ডেলাকেও অভিযুক্ত করা হয়। সরকারের প্রধান আইনজীবী ডক্টর পারসি ইউটার ম্যান্ডেলাসহ এএনসির নেতাদের অন্তর্ঘাতের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। এ ছাড়াও তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। [৩৯] ম্যান্ডেলা অন্তর্ঘাতের অভিযোগ স্বীকার করে নেন। কিন্তু বিদেশী রাষ্ট্রের দালাল হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার জন্য আনা দেশদ্রোহিতার অভিযোগটি ম্যান্ডেলা অস্বীকার করেন।[৩৯] প্রিটোরিয়ার সুপ্রিম কোর্টে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ম্যান্ডেলা ১৯৬৪ সালের ২০শে এপ্রিল তারিখে তাঁর জবানবন্দি দেন। ম্যান্ডেলা ব্যাখ্যা করেন, কেনো এএনসি সশস্ত্র আন্দোলন বেছে নিয়েছে। [৪০] ম্যান্ডেলা বলেন যে, বহু বছর ধরে এএনসি অহিংস আন্দোলন চালিয়ে এসেছিলো। কিন্তু শার্পভিলের গণহত্যার পর তাঁরা অহিংস আন্দোলনের পথ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।[৪১] এই গণহত্যা, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারকে অবজ্ঞা করে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেয়া, জরুরি অবস্থার ঘোষণা এবং এএনসিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরে ম্যান্ডেলা ও তাঁর সহযোদ্ধারা অন্তর্ঘাতমূলক সশস্ত্র সংগ্রামকেই বেছে নেন। তাঁদের মতে সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো কিছুই হতো বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের নামান্তর।[৪১] ম্যান্ডেলা আদালতে আরো বলেন, ১৯৬১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে তাঁরা উমখোন্তো উই সিযওয়ে অর্থাৎ এমকে-এর ম্যানিফেস্টো লিখেন। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য হিসাবে তাঁরা বেছে নেন সশস্ত্র সংগ্রাম। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিলো, অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদেশী বিনিয়োগকে তাঁরা নিরুৎসাহিত করবেন, আর এর মাধ্যমে বর্ণবাদী ন্যাশনাল পার্টির সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করবেন। [৪২] জবানবন্দির শেষে ম্যান্ডেলা বলেন, "During my lifetime I have dedicated myself to the struggle of the African people. I have fought against white domination, and I have fought against black domination. I have cherished the ideal of a democratic and free society in which all persons live together in harmony and with equal opportunities. It is an ideal which I hope to live for and to achieve. But if needs be, it is an ideal for which I am prepared to die."[৩০] ম্যান্ডেলার পক্ষে ব্র্যাম ফিশার, ভার্নন বেরাঞ্জ, হ্যারি শোয়ার্জ, জোয়েল জফ, আর্থার চাসকালসন, এবং জর্জ বিজোস ওকালতি করেন। [৪৩] মামলার শেষভাগে হ্যারল্ড হ্যানসন আইনী সহায়তার জন্য যোগ দেন। [৪৪] কিন্তু মামলায় রাস্টি বার্নস্টেইন ছাড়া অন্য সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তবে ১৯৬৪ সালের ১২ই জুন দেয়া রায়ে ফাঁসীর বদলে তাঁদের সবাইকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। [৪৪] কারাবাস[সম্পাদনা] রবেন দ্বীপের কারাগারের প্রাঙ্গন। রবেন দ্বীপে ম্যান্ডেলার কারাকক্ষ। এখানেই বন্দী ছিলেন দীর্ঘদিন। ম্যান্ডেলার কারাবাস শুরু হয় রবেন দ্বীপের কারাগারে। এখানে তিনি তাঁর ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান।[৪৫] জেলে থাকার সময়ে বিশ্বজুড়ে তাঁর খ্যাতি বাড়তে থাকে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসাবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন।[২] সশ্রম কারাদণ্ডের অংশ হিসাবে রবেন দ্বীপের কারাগারে ম্যান্ডেলা ও তাঁর সহবন্দীরা একটি চুনাপাথরের খনিতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হন। [৪৬] কারাগারের অবস্থা ছিলো বেশ শোচনীয়। কারাগারেও বর্ণভেদ প্রথা চালু ছিলো। কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের সবচেয়ে কম খাবার দেয়া হতো।[৪৭] সাধারণ অপরাধীদের থেকে রাজনৈতিক বন্দীদের আলাদা রাখা হতো। রাজনৈতিক বন্দীরা সাধারণ অপরাধীদের চাইতেও কম সুযোগ সুবিধা পেতো।[৪৮] ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনীতে লিখেছেন, তাঁকে ডি-গ্রুপের বন্দী হিসাবে গণ্য করা হতো, অর্থাৎ সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন্দীদের তালিকায় তাঁকে রাখা হয়েছিলো। তাঁকে প্রতি ৬ মাসে একটিমাত্র চিঠি দেয়া হতো এবং একজনমাত্র দর্শনার্থীর সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হতো।[৪৯] ম্যান্ডেলাকে লেখা চিঠি কারাগারের সেন্সরকর্মীরা অনেকদিন ধরে আটকে রাখতো। চিঠি ম্যান্ডেলার হাতে দেয়ার আগে তার অনেক জায়গাই কালি দিয়ে অপাঠযোগ্য করে দেয়া হতো।[১১] কারাগারে থাকার সময়ে ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কর্মসূচীর আওতায় পড়াশোনা শুরু করেন এবং আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।[৫০] পরবর্তীকালে ১৯৮১ সালে তাঁকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু তিনি প্রিন্সেস অ্যানের কাছে সেই নির্বাচনে হেরে যান।[৫০] দক্ষিণ আফ্রিকার গোয়েন্দা বিভাগের গুপ্তচর গর্ডন উইন্টার ১৯৮১ সালে আত্মজীবনী লিখেন, যার শিরোনাম ছিলো Inside BOSS[৫১]। এই আত্মজীবনীতে উইন্টার দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের একটি গোপন ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেন। এই ষড়যন্ত্র অনুসারে ১৯৬৯ সালে ম্যান্ডেলাকে কারাগার থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে কারাগারে হামলা চালাবার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। উইন্টারের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার গুপ্তচরেরা এই ষড়যন্ত্রে অংশ নেয় ও মদদ দেয়। উদ্দেশ্য ছিলো, কারাগার থেকে ম্যান্ডেলাকে পালাতে দেয়া, যাতে তাঁকে ধাওয়া করে পুনরায় গ্রেপ্তারের নামে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা যায়। এই ষড়যন্ত্রের খবর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা জেনে ফেলায় তা নস্যাত হয়ে যায়।[৫১] ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে ম্যান্ডেলাকে রবেন দ্বীপের কারাগার থেকে পোলস্‌মুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এসময় ম্যান্ডেলার সাথে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের উচ্চপদস্থ নেতা ওয়াল্টার সিসুলু, অ্যান্ড্রু ম্লাগেনি, আহমেদ কাথরাদা এবং রেমন্ড ম্‌লাবাকেও সেখানে নেয়া হয়। [৪৯] ধারণা করা হয়, রবেন দ্বীপে কারারুদ্ধ নতুন প্রজন্মের কৃষ্ণাঙ্গ রাজনৈতিক বন্দীদের উপর ম্যান্ডেলা ও অন্যান্য নেতার প্রভাব কমানোর জন্যই এটা করা হয়। তরুণ কর্মীদের উপরে ম্যান্ডেলা ও তাঁর সহযোদ্ধাদের এই প্রভাবকে ব্যঙ্গ করে "ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয়" বলা হতো।[৫২] তবে ন্যাশনাল পার্টির তদানিন্তন মন্ত্রী কোবি কোয়েটসির মতে ম্যান্ডেলাকে স্থানান্তর করার মূল লক্ষ্য ছিলো ম্যান্ডেলার সাথে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের গোপন বৈঠক ও আলোচনার ব্যবস্থা করা।[৫৩] ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন রাষ্ট্রপতি পি ডব্লিউ বোথা ম্যান্ডেলাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেন। শর্তটি ছিলো, ম্যান্ডেলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ করতে হবে।[৫৪] কোয়েটসি সহ অন্যান্য মন্ত্রীরা অবশ্য বোথার এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তারা মত প্রকাশ করেন যে, ম্যান্ডেলা ব্যক্তিগত কারামুক্তির লোভে পড়ে কখনোই নিজের সংগঠনকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে আনবেন না।[৫৫] ম্যান্ডেলা আসলেই এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তিনি তাঁর মেয়ে জিন্দজির মাধ্যমে একটি বিবৃতি দেন, যাতে তিনি বলেন, “ "What freedom am I being offered while the organisation of the people remains banned? Only free men can negotiate. A prisoner cannot enter into contracts." (আমাকে মুক্ত করার জন্য দেয়া এ কেমনতরো প্রস্তাব, যেখানে জনগণের সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে রাখা হচ্ছে? কেবল মুক্ত মানুষই আলোচনায় বসতে পারে। বন্দীরা কখনো চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে না।)[৫৩] ” ম্যান্ডেলা ও ন্যাশনাল পার্টি সরকারের মধ্যকার প্রথম আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। কোবি কোয়েটসি ম্যান্ডেলার সাথে কেপ টাউনের ভোক্স হাসপাতালে দেখা করেন। ম্যান্ডেলা তখন প্রস্টেট গ্রন্থির শল্য চিকিৎসা শেষে আরোগ্য লাভ করছিলেন।[৫৬] পরের চার বছর ধরে ম্যান্ডেলার সাথে সরকার একাধিকবার আলোচনায় বসে। কিন্তু এসব আলোচনায় বিশেষ কিছু অগ্রগতি হয়নি।[৫৩] ১৯৮৮ সালে ম্যান্ডেলাকে ভিক্টর ভার্সটার কারাগারে সরিয়ে নেয়া হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত ম্যান্ডেলা এখানেই বন্দী ছিলেন। আস্তে আস্তে তাঁর উপরে কড়াকড়ি কমানো হয় এবং দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হয়। ম্যান্ডেলার ছাত্রজীবনের বন্ধু হ্যারি শোয়ার্জ এসময় তাঁর সাথে দেখা করেন। ম্যান্ডেলার কারাবন্দীত্বের সময়ে তাঁর মুক্তির জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের উপরে চাপ বাড়তে থাকে। ম্যান্ডেলার মুক্তির জন্য এই আন্দোলনের বহুল ব্যবহৃত শ্লোগানটি ছিলো, Free Nelson Mandela! (ম্যান্ডেলার মুক্তি চাই)[৫৭] ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি বোথা হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ফ্রেডেরিক উইলেম ডি ক্লার্ক।[৫৮] রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের পরেই ডি ক্লার্ক ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেয়ার কথা ঘোষণা করেন।[৫৯] ম্যান্ডেলার কারাবন্দীত্বের সময়ে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির দূতেরা বেশ কয়েকবার তাঁর সাথে রবেন দ্বীপ ও পোলস্‌মুর কারাগারে দেখা করেন। এই সাক্ষাতগুলো সম্পর্কে ম্যান্ডেলা বলেন, "to me personally, and those who shared the experience of being political prisoners, the Red Cross was a beacon of humanity within the dark inhumane world of political imprisonment." (ব্যক্তিগত ভাবে আমার জন্য এবং আমার মতো অন্য রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য রেড ক্রস ছিলো কারাগারের অমানুষিক নিষ্ঠুর অন্ধকার জগতে আলোর দিশা।)[৬০][৬১] মুক্তি[সম্পাদনা] ১৯৯০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন রাষ্ট্রপতি এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সহ অন্যান্য বর্ণবাদ বিরোধী সংগঠনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। একই সাথে তিনি ঘোষণা দেন, ম্যান্ডেলাকে অচিরেই মুক্তি দেয়া হবে। [৬২] ভিক্টর ভার্সটার কারাগার থেকে ম্যান্ডেলাকে ১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি তারিখে মুক্তি দেয়া হয়। ম্যান্ডেলার কারামুক্তির ঘটনাটি সারাবিশ্বে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।[৬৩] মুক্তির দিনে ম্যান্ডেলা জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন।[৬৪] এই ভাষণে তিনি শান্তি রক্ষা করা ও দেশের শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য আহবান জানান। একই সাথে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। এই বিষয়ে তিনি বলেন, “ "our resort to the armed struggle in 1960 with the formation of the military wing of the ANC (Umkhonto we Sizwe) was a purely defensive action against the violence of apartheid. The factors which necessitated the armed struggle still exist today. We have no option but to continue. We express the hope that a climate conducive to a negotiated settlement would be created soon, so that there may no longer be the need for the armed struggle." (১৯৬০ সালে আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হই। বর্ণবাদের হিংস্রতার হাত থেকে আত্মরক্ষার খাতিরেই আমরা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন উমখান্তো উই সিযওয়ে গঠন করেছিলাম। সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার পেছনের কারণগুলো এখনো রয়ে গেছে। তাই এ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো পথ নেই। আমরা আশা করি, শান্তি আলোচনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ অচিরেই সৃষ্টি হবে এবং আমাদের আর সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবার দরকার থাকবে না।) ” ম্যান্ডেলা আরো বলেন, তাঁর মূল লক্ষ্য হলো সংখ্যাগুরু কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য শান্তি নিয়ে আসা, আর স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করা।[৬৪] শান্তি আলোচনা[সম্পাদনা] কারামুক্তির পর ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯০ হতে ১৯৯৪ পর্যন্ত তিনি এই দলের নেতা ছিলেন। এই সময়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ অবসানের লক্ষ্যে সরকারের সাথে আলোচনায় বসেন। এই শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হবার পর ১৯৯৪ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।[৬৫] আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস দলটির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে ১৯৯১ সালে এই দলের প্রথম জাতীয় সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে ম্যান্ডেলাকে দলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হয়। ম্যান্ডেলার পুরানো বন্ধু ও সহকর্মী অলিভার টাম্বো ম্যান্ডেলার বন্দীত্বের সময়ে প্রবাসে এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই সম্মেলনে টাম্বোকে দলের জাতীয় সভাপতি নির্বাচন করা হয়।[৬৬] দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সাথে শান্তি আলোচনায় অবদান রাখার জন্য ম্যান্ডেলা এবং রাষ্ট্রপতি এফ ডব্লু ডি ক্লার্ককে ১৯৯৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। তবে সব সময় এই শান্তি আলোচনা নির্বিঘ্নে চলেনি। ১৯৯১ সালে একবার মতানৈক্য হলে ম্যান্ডেলা রেগে গিয়ে ডি ক্লার্ককে অবৈধ সরকারের নেতা বলে অভিহিত করেছিলেন। ১৯৯২ সালের জুন মাসে বৈপাটোং এর গণহত্যার ঘটনা ঘটলে আলোচনা ভেস্তে যায়। ম্যান্ডেলা সেসময় ডি ক্লার্কের সরকারকে এই গণহত্যায় জড়িত থাকার জন্য অভিযোগ করেন।[৬৭] তবে এর ৩ মাস পরে ১৯৯২ এর সেপ্টেম্বর মাসে বিসো গণহত্যা ঘটলে আবার আলোচনা শুরু হয়। দুই পক্ষই উপলব্ধি করেন যে, শান্তি আলোচনাই হলো শান্তি ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ। ১৯৯৩ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টনের সাথে ম্যান্ডেলা। ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা ক্রিস হানিকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ফলে সারা দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।[৬৮] ম্যান্ডেলা এসময় জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ জানান। সেসময় ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি ছিলেন না। তা সত্ত্বেও ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রপতিসুলভ এই ভাষণে বলেন, “ "tonight I am reaching out to every single South African, black and white, from the very depths of my being. A white man, full of prejudice and hate, came to our country and committed a deed so foul that our whole nation now teeters on the brink of disaster. A white woman, of Afrikaner origin, risked her life so that we may know, and bring to justice, this assassin. The cold-blooded murder of Chris Hani has sent shock waves throughout the country and the world. ...Now is the time for all South Africans to stand together against those who, from any quarter, wish to destroy what Chris Hani gave his life for – the freedom of all of us".[৬৯] ” ম্যান্ডেলার এই আহবানে কাজ হয়। দেশের কিছু অংশে দাঙ্গা হলেও মোটের উপর শান্তি বজায় থাকে। শান্তি আলোচনা আবার জোরেসোরে শুরু হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ১৯৯৪ সালের ২৭শে এপ্রিল তারিখে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।[৫৩] ব্যক্তিগত জীবন[সম্পাদনা] ম্যান্ডেলা ৩ বার বিয়ে করেন। তাঁর ৬টি সন্তান, ২০জন নাতি-নাতনি এবং অনেক প্রপৌত্র রয়েছে। থেম্বুর উপজাতীয় নেতা মান্দলা ম্যান্ডেলা হলেন নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি।[৭০] প্রথম বিয়ে[সম্পাদনা] ম্যান্ডেলার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ইভিলিন ন্‌তোকো মাসে। ম্যান্ডেলার মতোই তাঁরও বাড়ি ছিলো ট্রান্সকেই অঞ্চলে। জোহানেসবার্গে তাঁদের দুজনের পরিচয় হয়।[৭১] ১৩ বছর সংসার করার পর ১৯৫৭ সালে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ম্যান্ডেলার অনুপস্থিতি এবং সংসার ফেলে রাজনৈতিক আন্দোলনে ম্যান্ডেলার বেশি সময় দেয়াই ছিলো এই বিয়ে ভাঙার কারণ। তার উপরে ইভিলিন ছিলেন খ্রিস্টধর্মের জেহোভা'স উইটনেস মতাদর্শের অনুসারী, যাতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ছিলো।[৭২] Evelyn Mase died in 2004.[৭৩] ইভিলিন ও ম্যান্ডেলার দুই পুত্র সন্তান (মাদিবা থেম্বেকিল (থেম্বি) (১৯৪৬-১৯৬৯) এবং মাকাগাথ ম্যান্ডেলা (১৯৫০-২০০৫)) এবং দুই কন্যা সন্তান (দুজনের নামই মাকাযিওয়ে ম্যান্ডেলা, জন্ম ১৯৪৭ ও ১৯৫৩ সালে)। প্রথম কন্যা সন্তানটি ৯ মাস বয়সে মারা যায়। দ্বিতীয় কন্যার নামটি ম্যান্ডেলা প্রথম কন্যার নামানুসারেই রাখেন।[৭৪] ম্যান্ডেলার এই চারজন সন্তানই ওয়াটারফোর্ড কামহ্লাভা এলাকার ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড কলেজে পড়াশোনা করে।[৭৫] ম্যান্ডেলার জ্যেষ্ঠ পুত্র থেম্বি ২৫ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। এসময় ম্যান্ডেলা কারাগারে বন্দী ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ম্যান্ডেলাকে তাঁর পুত্রের অন্তেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে দেয়নি।[৭৬] মাকাতাথ ২০০৫ সালে ৫৪ বছর বয়সে এইডসে মারা যান। [৭৭] পুরস্কার ও সম্মাননা[সম্পাদনা] নোবেল শান্তি পুরস্কার ভারতরত্ন আরও দেখুন[সম্পাদনা] মাদাম তুসো জাদুঘর %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF_%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E2%80%8C%E0%A6%B8 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 দ্য বিটল্‌স উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে Beatles logo.svg A square quartered into four head shots of young men with moptop haircuts. All four wear white shirts and dark coats. ১৯৬৪ সালে দ্য বীটল্‌স উপরে: জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি, নিচে: জর্জ হ্যারিসন, রিঙ্গো স্টার প্রাথমিক তথ্যাদি উদ্ভব লিভারপুল, ইংল্যান্ড ধরন রক, পপ[১] কার্যকাল ১৯৬০–১৯৭০ (আংশিক পুনর্মিলন: ১৯৯৪–১৯৯৫) লেবেল পারলোফোন, সোয়ান, ভী-জে, ক্যাপিটল, ইউনাইটেড আর্টিস্টস্, অ্যাপল সহযোগী শিল্পী দ্য কুঅরিম্যান, বিলি প্রিস্টন, প্লাস্টিক ওনো ব্যান্ড ওয়েবসাইট thebeatles.com প্রাক্তন সদস্যবৃন্দ প্রধান জন লেনন পল ম্যাককার্টনি জর্জ হ্যারিসন রিঙ্গো স্টার অন্যান্য স্টুয়ার্ট সাটক্লিফ পিট বেস্ট দ্য বীটল্‌স (ইংরেজি: The Beatles দ্য বীট্‌ল্‌জ়্‌) ছিল ইংল্যান্ডের লিভারপুলের একটি রক সঙ্গীত গ্রুপ। এর চার জন সদস্য ছিলেন জন লেনন, পল ম্যাকার্টনি, জর্জ হ্যারিসন এবং রিঙ্গো স্টার। বিটল্‌স জনপ্রিয় ধারার সঙ্গীতের ইতিহাসে সমালোচক ও শ্রোতা উভয় দিক থেকেই শীর্ষস্থানীয় সঙ্গীত দল ছিল।[২] ১৯৬০ এর দশকের মধ্যভাগে বিটল্‌স অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬৯ এ বীটল্‌স ভেঙ্গে যায়, কিন্তু তা সত্ত্বেও সারা পৃথিবীতে বিটল্‌স এখন পর্যন্ত জনপ্রিয়। প্রথম যুগের রক এন্ড রোল এবং পপ সঙ্গীতে তাদের প্রভাবের জন্য তাদের শিল্পসম্মত অর্জন ও বাণিজ্যিক সফলতা একটি মর্যাদাপূর্ণ আসনে আসীন হয়ে আছে। যদিও তাদের প্রাথমিক সাঙ্গীতিক ধরণ ১৯৫০ এর রক এন্ড রোল এর মূলে প্রোথিত ছিল; তার পরও বিভিন্ন সাঙ্গীতিক ধরণ, যেমন, লোক সঙ্গীত, রকাবেলী সাইকেডেলিক এবং ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্নতাকে ধারণ করেছিল বিটলস্ । বিটলস্ এর প্রভাব সঙ্গীতের বাহিরেও ব্যাপ্ত ছিল। তাদের পোষাক আশাক, কেশ বিন্যাস, বক্তব্য, এমনকি তাদের পছন্দ সঙ্গীত যন্ত্রসমূহের প্রভাব ১৯৬০ দশক জুড়ে তাদেরকে দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী হিসেবে তৈরি করে ফেলেছিল । আজ পর্যন্ত বিটলস্ অন্য যেকোন ব্যান্ড দলের চেয়ে বেশি অ্যালবাম বিক্রি করেছে। যুক্তরাজ্যে তাদের ৪০টি বিভিন্ন অ্যালবাম বেরিয়েছিল যা সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই বাণিজ্যিক সফলতার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল অন্যান্য অনেক দেশেই । ই.এম.আই. এর অনুমান অনুযায়ী ১৯৮৫ এর মধ্যে বিটলস্ এর এক বিলিয়নের উপর ডিস্ক ও টেপ বিক্রি হয়েছিল।[৩] আমেরিকাতেও একক গান এবং অ্যালবাম বিক্রির ক্ষেত্রে বিটলস্ ছিল সর্বকালের সেরা শিল্পী দল।[৪] ২০০৪ সালে রোলিং স্টোন ম্যাগাজিন বিটল্‌সকে সর্বকালের সেরা ১০০ শ্রেষ্ঠ শিল্পীর তালিকার শীর্ষে স্থান দেয়।[৫] মাদাম ত্যুসো যাদুঘরে দ্য বীটল্‌স এর মোমের মূর্তি পরিচ্ছেদসমূহ [আড়ালে রাখো] ১ ইতিহাস ১.১ ১৯৫৭–৬২: গঠন, হামবুর্গ এবং যুক্তরাজ্য জনপ্রিয়তা ১.১.১ নামকরণ ২ আন্তর্জাতিক খ্যাতি ৩ ভাঙ্গন ৪ ডিস্কোগ্রাফি ৪.১ মূল ক্যাটালগ ৫ টীকা ৬ উদ্ধৃতি ৭ উৎস ৮ আরও পড়ুন ৯ বহিঃসংযোগ ইতিহাস[সম্পাদনা] ১৯৫৭–৬২: গঠন, হামবুর্গ এবং যুক্তরাজ্য জনপ্রিয়তা[সম্পাদনা] টেমপ্লেট:The Beatles history ১৯৫৭ সালের মার্চে লিভারপুলের কুয়েরি ব্যাংক গ্রামার স্কুলে পড়াকালীন সময়ে জন লেনন দ্য কোয়ারিমেন নামে একটি দল গঠন করেন।[৬] ১৯৫৭ সালের ৬ জুলাই সেইন্ট পিটার্স চার্চের উল্টন গার্ডেনে লেননের সাথে পল ম্যাককার্টনির সাক্ষাৎ হয় এবং এর কিছুদিন পর তাকে ব্যান্ডে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়।[৭] ১৯৫৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তরুণ গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনকে লিভারপুলের উইন্সটন হলে দলটির শো দেখতে আমন্ত্রণ জানানো হয়।[৮] ম্যাককার্টনি ও হ্যারিসন ছিলেন একই এলাকার বাসিন্দা। লিভারপুল ইনস্টিটিউট থেকে ফেরার সময় তারা পরিচিত হন এবং ম্যাককার্টনির অনুরোধে জর্জ হ্যারিসন লিড গিটারিস্ট হিসেবে দ্য কোয়ারিমেন দলে যোগ দেন।[৯] লেনন শুরুতে কম বয়স্ক হবার কারণে হ্যারিসনকে নিতে না চাইলেও ১৯৫৮ সালের মার্চে দলের সাথে মহড়ার পর তিনি সন্তুষ্ট হন।[১০] সে সময় নিয়মিত সদস্য যোগ দিয়েছেন আবার বেরিয়েও গেছেন। ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে লেননের ক্লেজ জীবনের বন্ধু স্টুয়ার্ট সাটক্লিফ ব্যাস গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দেন।[১১] লেনন ও ম্যাককার্টনি উভয়েই রিদম গিটার বাজাতেন। দলে ড্রামারের সঙ্কট ছিল। পরে,১৯৬২ সালে রিঙ্গো স্টার দলটিতে যোগ দান করেন। রিঙ্গোকে সঙ্গে নিয়ে দলটি তাদের নিজস্ব একক গানগুলো বিভিন্ন কনসার্টে পরিবেশন করতে থাকে। ম্যাককার্টনি ও লেনন ম্যাককার্টনি /লেনন গান লেখায় জুটি গরে তলেন। ইতমধেই তারা বেশ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। নামকরণ[সম্পাদনা] কোয়ারিমেন ব্যান্ডের নাম বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করা হয় — "জনি অ্যান্ড দ্য মুনডগস", "লং জন অ্যান্ড দ্য বিটল্‌স", "দ্য সিলভার বিটল্‌স" — এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে "দ্য বিটল্‌স" নামটি স্বীকৃতি পায়। ব্যান্ডের নাম ও নামের বানান নিয়ে বেশ কয়েকটি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। তবে সাধারণত লেননকেই নামকরনের কৃতিত্ব দেয়া হয়, যিনি বলেছিলেন নামটি বিটল (beetle) পোকা (বাডি হলির দ্য ক্রিকেটস নামে ব্যান্ড ছিল) ও বিট (beat) এর মিলনে তৈরি করা হয়েছে। সিনথিয়া লেননের মতে বিটল্‌স নামটি রর্যাাভেনশ হল বারের বিয়ার-পূর্ণ টেবিলে মাথা খাটিয়ে তৈরি করা হয়েছে।[১২] লেনন যিনি একই ঘটনার বিভিন্ন কাহিনী বলার জন্য বিখ্যাত, ১৯৬১ সালে মার্সি বিট ম্যাগাজিনকে বলেন, স্বপ্নে একটি মানুষ জলন্ত পাই নিয়ে তাদের কাছে আসে এবং বলে যে আজকে থেকে তারা এ বানানের বিটল্‌স।[১৩] ২০০১ সালে এক সাক্ষাৎকারে পল ম্যাককার্টনি নামের বিদঘুটের বানানের কৃতিত্ব নিজের বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, জন বিটল্‌স (beetles) নামের প্রস্তাব করেছিল, তখন আমি বলি বিটল্‌স (beatles) হলে কেমন হয়? কারণ আমি ড্রামের বিট পছন্দ করি। তখন সবাই এটি বেশ পছন্দ করে।[১৪] আন্তর্জাতিক খ্যাতি[সম্পাদনা] ১৯৬৩ সালের ২২ মার্চ দ্য বিটল্‌স এর প্রথম স্টুডিও অ্যালবাম প্লিজ প্লিজ মি মুক্তি পায়। ১৯৬২ সালের জনপ্রিয় একক গানগুলোর পাশাপাশি নতুন কিছু গানসহ মোট ১৪টি গান এ অ্যালবামে স্হান পায়। এ অ্যালবামটি ইংল্যান্ডের সঙ্গীতের শীর্ষতালিকায় প্রথম স্হান দখল করে। দলটি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তারা নিজেদের একটি লোগোও তৈরি করে ফেলে। দ্য বীটল্‌স এর লোগো দ্য বিটল্‌স এর দ্বিতীয় স্টুডিও অ্যালবাম উইদ দ্য বিটল্‌স মুক্তি পায় ২২ নভেম্বর ১৯৬৩ সালে। এ অ্যালবামটির রেকর্ডিং চলেছে একই বছরের ১৮ জুলাই থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত। এতে জর্জ হ্যারিসনের প্রথম কম্পোসিশান করা গানটি রয়েছে। ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দলটি ইংল্যান্ড ত্যাগ করে আন্তর্জাতিক পরিসরে কনসার্ট করার জন্য। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এক টিভি অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করে । ৭৩ লক্ষ দর্শক - সে দেশের ৪০% মানুষ এ অনুষ্ঠান দেখেন। [১৫][১৬] এর ফলে তাদের আন্তর্জাতিক খ্যাতি আরও বেরে যায়।জন লেনন পরিচিতি ছিলেন সুদর্শন বিটল হিসেবে, পল ম্যাককার্টনি মিষ্টি বিটল, জর্জ হ্যারিসন শান্ত বিটল, ও রিঙ্গো স্টার রশাত্নক বিটল হিসেবে পরিচিতি ছিলেন। এ হার্ড ডে’স নাইট ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। এতে ‘দ্য বিটল্‌স’ তাদের রক অ্যান্ড রোল ধারা অব্যাহত রাখে। এটি প্রক্রিতপক্ষে কয়েক দিন আগের মুক্তি পাওয়া ‘৪ বিটল’ অভিনীত একই শিরোনামের একটি হাস্য রসাত্নক চলচিত্রের গানের অ্যালবাম। চলচিত্রটি আন্তর্জাতিক ভাবে প্রচন্ড জনপ্রিয় হয়। এ গানের অ্যালবামের রেকর্ডিংএ জর্জ হ্যারিসন ব্যাবহার করেন ১২ তারের রিকেনবেকার গীটারটি। একই বছরের একেবারে শেষভাগে, বড়দিনের আগে বিটল্‌স ফর সেল মুক্তি পায়। তারা সর্বমোট ১২ টি স্টুডিও অ্যালবাম প্রকাশ করে। তাদের সবশেষ অ্যালবাম 'লেট ইট বি' ১৯৭০ সালের মে মাসে মুক্তি পায়। ১৯৬০ দশক পুরটুকুই দ্য বিটল্‌স বিশ্ব সঙ্গীত জগৎ রাজত্ব করেছে। ২০০৯ সালে রিঙ্গো স্টার ও পল ম্যাককার্টনি ভাঙ্গন[সম্পাদনা] দ্য বিটল্‌স এর ভঙ্গন এর পিছনে একাধিক কারন ছিল। মূলত ব্যাক্তিগত মতের অমিলের রেশ ধরেই ১৯৬৮ সাল থেকে তাদের দলে ভাঙ্গনের সূত্রপাত হয়। ১৯৭০ সালে 'দ্য বিটল্‌স। এর আনুষ্ঠানিক ভাঙ্গন হয়। ভাঙ্গনের পর ৪ বিটল্ ব্যক্তিগত সঙ্গীত ক্যারিয়ারে প্রবেশ করে। ‌ ১৯৯৪ সালে জন লেনন এর মৃত্যর পর বাকি ৩ বিটল্ একত্রিত হয়ছিল।ন্মজল ডিস্কোগ্রাফি[সম্পাদনা] মূল নিবন্ধ: The Beatles discography আরও তথ্যের জন্য দেখুন: List of the Beatles songs, The Beatles' recording sessions, এবং The Beatles bootleg recordings মূল ক্যাটালগ[সম্পাদনা] প্লিজ প্লিজ মি (১৯৬৩) উইথ দ্য বীটল্‌স (১৯৬৩) এ হার্ড ডে'স নাইট (১৯৬৪) বিটল্‌স ফর সেল (১৯৬৪) হেল্প! (১৯৬৫) রাবার সোল (১৯৬৫) রিভলভার (১৯৬৬) এসজিটি. পেপার'স লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড (১৯৬৭) Magical Mystery Tour (১৯৬৭) দ্য বিটল্‌স (হোয়াইট অ্যালবাম) (১৯৬৮) ইয়েলো সাবমেরিন (১৯৬৯) অ্যাবে রোড (১৯৬৯) লেট ইট বি (১৯৭০) টীকা[সম্পাদনা] উদ্ধৃতি[সম্পাদনা] %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%A8_%E0%A6%AE%E0%A6%A8%E0%A6%B0%E0%A7%8B %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 মেরিলিন মনরো উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে এই নিবন্ধটি অভিনেত্রী সম্পর্কিত। অন্য ব্যবহারের জন্য, দেখুন মেরিলিন মনরো (দ্ব্যর্থতা নিরসন)। মেরিলিন মনরো জন্ম নর্মা জীন মর্টেনসন জুন ১, ১৯২৬ লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া, ইউ.এস. মৃত্যু আগস্ট ৫, ১৯৬২ (৩৬ বছর) ব্রেন্টউড, লস অ্যাঞ্জেলেস, ক্যালিফোর্নিয়া, ইউ.এস. মৃত্যুর কারণ বারবিটুরেড ওভারডোজ সমাধি ওয়েস্টউড ভিলেজ মেমোরিয়াল পার্ক সিমেট্রি|, ওয়েস্টউড, লস অ্যাঞ্জেলেস অন্য নাম নর্মা জীন বেকার নর্মা জীন ডগ্রেথি নর্মা জীন ডিমাজিও মেরিলিন মনরো মিলার পেশা অভিনেত্রী মডেল গায়ক চলচ্চিত্র প্রযোজক কার্যকাল ১৯৪৫–১৯৬২ উল্লেখযোগ্য কাজ নায়াগ্রা, জেন্টলমেন প্রেফার ব্লন্ডস, রিভার অব নো রিটার্ন, দ্য সেভেন উয়ার ইচ, সাম লাইক ইট হট, দ্য মিসফিট্স ধর্ম পেন্টেকোস্টাল (১৯২৬–১৯৫৬), ইহুদি ধর্ম (১৯৫৬–১৯৬২) দম্পতি জেমস ডগেথি (১৯৪২–১৯৪৬) জো ডিমাগিও (জানু.–নভে. ১৯৫৪) আর্থার মিলার (১৯৫৬–১৯৬১) টেমপ্লেট:Infobox comedian awards স্বাক্ষর Marilyn Monroe Signature.svg মেরিলিন মনরো[১][২] (জন্ম নর্মা জীন মর্টেনসন; জুন ১, ১৯২৬ - আগস্ট ৫, ১৯৬২)[৩] ছিলেন মার্কিন অভিনেত্রী, মডেল এবং গায়ক। যিনি তার সময়ের একজন প্রধান যৌনতার প্রতীক হয়ে ওঠেন এবং ১৯৫০ ও ১৯৬০ দশকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাণিজ্যিকভাবে সফল চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।[৪] শৈশবের বেশিভাগ সময় শিশুপল্লীতে কাটিয়ে, মনরো মডেল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন, যা পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে তাকে টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্সের সাথে চুক্তিবদ্ধ করে। তার প্রথমদিকের চলচ্চিত্রে উপস্থিতি খুবই গৌণ ছিল, কিন্তু দ্যা আশফাল্ট জাঙ্গল এবং অল অ্যাবাউট ইভ (দুটিই ১৯৫০ সালে) চলচ্চিত্রে তার কর্মসঞ্চালন সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। ১৯৫২ সালে প্রথম তিনি ডোন্ট বদার টু নক[৫] চলচ্চিত্রে এবং ১৯৫৩ সালে নায়াগ্রা শিরোনামের একটি মেলোড্রামাটিক চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান, যা চলচ্চিত্র তার মোহময়তা অধিষ্ঠিত করে। তার "মূক স্বর্ণকেশী" ব্যক্তিত্ব পরবর্তী বিভিন্ন চলচ্চিত্রে কমিক প্রভাব বিস্তার করে, যেমন জেন্টলমেন প্রেফার ব্লন্ডস (১৯৫৩), হাও টু ম্যারি অ্যা মিলিওনার (১৯৫৩) এবং দ্য সেভেন উয়ার ইচ (১৯৫৫)। টাইপকাস্টিং দ্বারা সীমাবদ্ধ, মনরো তার পরিসীমা প্রসারিত করতে অ্যাক্টরস স্টুডিওতে পড়াশোনা করেন। বাস স্টপ চলচ্চিত্রে তার নাটকীয় পারফরম্যান্স সমালোচকদের কর্তৃক প্রশংসিত হয় এবং গোল্ডেন গ্লোব মনোনয়ন অর্জন করে। পরিচ্ছেদসমূহ [আড়ালে রাখো] ১ জন্ম ২ অভিনয় জীবন ৩ পারিবারিক জীবন ৪ মৃত্যু ৫ তথ্যসূত্র ৬ বহিঃসংযোগ জন্ম[সম্পাদনা] মনরোর জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৯২৬ সালে। আসল নাম ছিল নরমা জেন মর্টেনশন। ১৬ বছর বয়সে তিনি এয়ার ক্রাফট প্লান্টের একজন চাকরিজীবিকে বিয়ে করেন। অভিনয় জীবন[সম্পাদনা] মনেরোর অভিনয় জীবন শুরু হয় মডেলিং দিয়ে ১৯৪৬সালে। এখানেই মনরো বাদামি বা ব্রাউনিস কালার চুল কে প্লাটিনাম হোয়াইটের এক আভা আনেন যা তার ট্রেডমার্ক বলা চলে। আর তার নামের পরিবর্তে নতুন নাম হয় মেরিলিন মনরো। ১৯৪৭ সালে 20th Century-Fox স্টুডিওর সাথে চুক্তি বদ্ধ হন মনরো এবং দুটি মুভিতে তাকে প্রথমবারের মত দেখা যায়। ১৯৪৯ সালে মনেরো আবার মডেলিংয়ে ফিরে আসেন। ১৯৫০ সালে অল অ্যাবাউট ইভ নামে চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৫৭ সালে মুক্তি পায় বিখ্যাত ছবি দ্য সেভেন ইয়ার ইটচ। এছাড়াও হাউ টু মেরি অ্যা মিলিওনিয়ার, দ্য প্রিন্স অ্যান্ড দ্য শোগার্ল প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করে তিনি বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করেন। সাম লাইক ইট হট ছবিতে অভিনয় করে তিনি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। পারিবারিক জীবন[সম্পাদনা] সংক্ষিপ্ত জীবনে তিন তিনবার বিয়ের করেন। মৃত্যু[সম্পাদনা] ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট লস অ্যাঞ্জেলেসের ব্রেন্টউডে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন মনরো। ধারণা করা হয়, মাত্রাতিরিক্ত বড়ি খেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%85%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BE_%E0%A6%9C%E0%A7%8B%E0%A6%B2%E0%A6%BF %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 অ্যাঞ্জেলিনা জোলি উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে এই পাতায় করা সম্পাদনাগুলির পর্যালোচনা প্রয়োজন।বিস্তারিত দেখাও/আড়াল করো অ্যাঞ্জেলিনা জোলি Angelina Jolie 2 June 2014 (cropped).jpg জোলি ২০১৪ সালে যৌন নিপীড়ন বন্ধে আয়োজিত বিশ্ব সম্মেলনে। জন্ম অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ভট ৪ জুন ১৯৭৫ (বয়স ৪০) পেশা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, প্রযোজক কার্যকাল ১৯৮২; ১৯৯৩–বর্তমান দম্পতি জনি লি মিলার (১৯৯৬–১৯৯৯) বিলি বব থর্নটন (২০০০–২০০৩) ব্র্যাড পিট (২০১৪–বর্তমান) সন্তান ৬ জন (৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে) পিতা-মাতা জন ভট (পিতা) মার্শেলিন বার্ট্রান্ড (মাতা) চলচ্চিত্র পুরস্কার অ্যাকাডেমি পুরস্কার ২০০০ সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার ১৯৮৮ সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী - ধারবাহিক, মিনি ধারাবাহিক, বা টেলিচলচ্চিত্র ১৯৯৯ সেরা অভিনেত্রী - ধারবাহিক, মিনি ধারাবাহিক, বা টেলিচলচ্চিত্র ২০০০ সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী - চলচ্চিত্র স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কার ১৯৯৯ সেরা অভিনেত্রী - মিনি ধারাবাহিক, বা টেলিচলচ্চিত্র ২০০০ সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী - চলচ্চিত্র অ্যাঞ্জেলিনা জোলি (ইংরেজি: Angelina Jolie) (জন্ম: ৪ জুন, ১৯৭৫; অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ভট) একজন জনপ্রিয় মার্কিন অভিনেত্রী। তিনি তিনবার গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার, দুইবার স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কার এবং একবার একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। চলচ্চিত্র জগতের বাইরে ২০০১ সালে তিনি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার শুভেচ্ছাদূত মনোনীত হয়েছেন। বিশ্বব্যাপী মানবতার প্রচার, এবং বিশেষ করে শরণার্থীদের জন্য কাজ করার জন্য জোলি বিশেষভাবে সমাদৃত। একাধিকবার তিনি ‘বিশ্বের সেরা সুন্দরী’ নির্বাচিত হয়েছেন। রূপালী পর্দার অন্তরালে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন প্রায় সময়ই গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার লাভ করেছে।[১] ১৯৮২ সালে লুকিন’ টু গেট আউট চলচ্চিত্রে বাবা জন ভটের সাথে একটি শিশু চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র জগতে জোলির আবির্ভাব হয়। তবে পেশাদার চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর অভিষেক ঘটে স্বল্প বাজেটের ছবি সাইবর্গ ২ (১৯৯৩)-এ অভিনয়ের মাধ্যমে। তাঁর অভিনীত প্রথম বড় মাপের ছবি হ্যাকারস (১৯৯৫)। এ ছবিতে তিনি নামভূমিকায় অভিনয় করেন। পরবর্তীতে তাঁকে জর্জ ওয়ালেস (১৯৯৭) ও জিয়া (১৯৯৮)-এর মতো সমালোচক-নন্দিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। নাট্য চলচ্চিত্র গার্ল, ইন্টারাপ্টেড (১৯৯৯)-এ অনবদ্য অভিনয়ের জন্য তিনি সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ভিডিও গেম নায়িকা লারা ক্রফ্‌ট চরিত্র নিয়ে লারা ক্রফ্‌ট: টুম্ব রেইডার (২০০১) চলচ্চিত্রে অভিনয় তাঁর তারকাখ্যাতি আরও বাড়িয়ে দেয়। মূলত এরপর থেকেই জোলি হলিউডের অন্যতম ও সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক-প্রাপ্ত একজন অভিনেত্রী হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন।[২] তাঁর চলচ্চিত্র-জীবনের সর্বোচ্চ ব্যবসায়িক সাফল্য যে দুটি চলচ্চিত্র থেকে এসেছে সেগুলো হলো অ্যাকশন-কমেডিধর্মী মি. এন্ড মিসেস. স্মিথ (২০০৫) এবং অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র কুং ফু পান্ডা (২০০৮)।[৩] ব্যক্তিগত জীবনে জোলি দুইবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। প্রথমবার অভিনেতা জনি লি মিলার ও দ্বিতীয়বার বিলি বব থর্নটনের সাথে। পরবর্তীতে উভয়ের সাথেই তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। বর্তমানে তিনি অভিনেতা ব্রাড পিটের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ।[৪] জোলি-পিট যুগলের দাম্পত্য সম্পর্ক বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে বারংবার আলোচিত হয়েছে। তাঁদের সন্তান-সন্ততির সংখ্যা ছয়; এর মধ্যে রয়েছে নিজেদের তিন সন্তান শিলোহ, নক্স ও ভিভিয়ান; এবং বিভিন্ন সময়ে দত্তক নেয়া তিন সন্তান ম্যাডক্স, প্যাক্স ও জাহারা। পরিচ্ছেদসমূহ [আড়ালে রাখো] ১ প্রাথমিক জীবন ও পরিবার ২ পেশাজীবন ২.১ প্রাথমিক কাজ (১৯৯৩–১৯৯৭) ২.২ আলোচিত সাফল্য (১৯৯৭–২০০০) ২.৩ আন্তর্জাতিক সাফল্য (২০০১–বর্তমান) ৩ মানবহিতৈষী কর্মকাণ্ড ৪ ব্যক্তিগত জীবন ৪.১ সম্পর্ক ৪.২ সন্তানাদি ৫ গণমাধ্যমে উপস্থিতি ৬ চলচ্চিত্র তালিকা ৬.১ অভিনেত্রী হিসেবে ৬.২ পরিচালক হিসেবে ৭ পুরস্কার ৮ গ্রন্থসূত্র ৯ তথ্যসূত্র ও পাদটীকা ১০ আরও পড়ুন ১১ বহিঃসংযোগ প্রাথমিক জীবন ও পরিবার[সম্পাদনা] যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেসে জোলির জন্ম। তার মা-বাবার নাম যথাক্রমে মার্শেলিন বার্ট্রান্ড ও জন ভট; মা-বাবা উভয়েই ছিলেন পেশাদার অভিনয়শিল্পী। এছাড়া জোলির আত্মীয়বর্গের ভেতরেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ছাপ সুস্পষ্ট। সম্পর্কের দিক থেকে জোলি, চিপ টেইলরের ভ্রাতুষ্পুত্রী, জেমস হ্যাভেনের বোন, এবং জ্যাকুইলিন বিসেট ও ম্যাক্সিমিলিয়ান শেলের ধর্মকন্যা। বাবার দিক থেকে জোলি চেকোস্লোভাকীয় ও জার্মান বংশোদ্ভূত।[৫][৬] আর মায়ের দিক থেকে ফরাসি কানাডীয় বংশোদ্ভূত। তার মায়ের ভাষ্য অনুসারে তার মধ্যে ইরোকয় বংশের ছাপও বিদ্যমান।[৭][৮] যদিও তাঁদের এমন কথার প্রেক্ষিতে ভটের ভাষ্য, তাঁর স্ত্রী বার্ট্রান্ড ‘ঠিক ইরোকয় নয়’, এবং তাঁর সাবেক স্ত্রীর বংশকে চমকপ্রদ হিসেবে প্রচার করার উদ্দেশ্য থেকেই তাঁরা এমনটি বলে থাকে।[৯] ১৯৭৬ সালে তার মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদের পর জোলি ও তার ভাই উভয়েই তাদের মায়ের কাছে বেড়ে উঠতে থাকেন। বিচ্ছেদ-পরবর্তী এই প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে তার মা নিজের অভিনয়ের উচ্চাশা বিসর্জন দেন, এবং সন্তানদের সাথে নিয়ে নিউ ইয়র্কের প্যালিসেডে চলে যান।[১০] শৈশব থেকেই জোলি নিয়মিতভাবে ছবি দেখতেন ও ছবি দেখার পর মায়ের কাছে, অভিনয় করার ব্যাপারে তার আগ্রহ প্রকাশ করতেন। কিন্তু তিনি কখনোই তার বাবার কারণে অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হননি।[১১] জোলির বয়স যখন এগারো, তখন তার পরিবার আবার লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরে আসে। লস অ্যাঞ্জেলেসে এসে এবার তিনি অভিনয় করার সিদ্ধান্ত নেন। এরই সূত্র ধরে তিনি লি স্ট্র্যাসবার্গ থিয়েটার ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন। সেখানে তিনি দুই বছর ধরে অভিনয়ের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই থিয়েটার ইনস্টিটিউটে থাকাকালীন সময়ে তিনি বেশ কিছু মঞ্চনাটকেও অভিনয় করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে জোলি তার অভিনয় শিক্ষা থেকে সরে গিয়ে একজন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।[১২] তখন তিনি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিচালকদের মতো কালো পোশাক পরা শুরু করেন। এছাড়াও তিনি তার চুলের রং পরিবর্তন করে বেগুনী করেছিলেন, এবং তৎকালীন প্রেমিকের সাথে মোশিংয়ে যাওয়াও শুরু করেছিলেন।[১১] দুই বছর পর প্রেমিকের সাথে তার সম্পর্ক ভেঙে যায়। এরপর তিনি তার মায়ের বাড়ি থেকে কয়েক গলি দূরে অবস্থিত একটি গ্যারাজের ওপরের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করেন।[১০] কিছুদিন পর তিনি আবারও অভিনয় শিক্ষায় ফিরে যান, এবং কয়েকবার সেমিস্টার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পরেও শেষপর্যন্ত হাই স্কুলের গণ্ডি পার হন। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জোলির বক্তব্য, “আমি মূলত এখনো—উল্কিওয়ালা এক বদমাশ পিচ্চি—এবং আমি থাকবোও”।[১৩] ১৯৮৮ সালে অস্কার অনুষ্ঠানে জন ভট, পেছনে জোলিকে দেখা যাচ্ছে পরবর্তীতে জোলি ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিল্‌স হাই স্কুলে (পরবর্তী নাম মরেনো হাই স্কুল) ভর্তি হন। সেখানে তার সময় কাটতো অনেকটা বিচ্ছিন্ন ও একাকী অবস্থায়, কারণ এ স্কুলের ছেলেমেয়েরা সবাই ছিলো সেই এলাকার অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান। অপরদিকে জোলির মা তার স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। অধিকাংশ সময়ই জোলিকে অন্যের ব্যবহৃত পুরোন জামাকাপড় ব্যবহার করতে হতো। স্বাতন্ত্রসূচক বেশভূষার (যেমন: হ্যাংলা স্বাস্থ্য, রোদচশমা ও ব্রেস পরে থাকা ইত্যাদি[১১]) জন্য স্কুলের অন্যান্য ছেলেমেয়েরা জোলিকে উত্যক্ত করতো। মডেল হওয়ার জন্য তার প্রথম চেষ্টাটি বিফলে গেলে জোলির আত্মবিশ্বাসেও চিড় ধরে। সেসময় প্রায়ই তিনি নিজের শরীর কাটাকাটি করার মাধ্যমে নিজেকে রক্তাক্ত করতেন। পরে তিনি এসম্বন্ধে বলেছিলেন, “আমি সবসময়ই ছুরি সংগ্রহ করতাম আর এগুলো আমার ধারেকাছেই থাকতো। কিছু কারণে, কাটাকাটি করার এই আচরণটি, এবং ব্যথা অনুভব করা—আমাকে অনুভব করতে সাহায্য করতো যে, আমি বেঁচে আছি, এবং আমি কিছুটা মুক্তি পাচ্ছি। এটা আমার কাছে ছিলো কিছুটা রোগনিরাময়ের মতো।”[১৪] জোলির সাথে তার বাবা জন ভটের সম্পর্ক অত্যন্ত শীতল ও দূরত্বপূর্ণ। তারা দুজন পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। লারা ক্রফ্‌ট: টুম্ব রেইডার চলচ্চিত্রে তারা একসঙ্গে বাবা-মেয়ের ভূমিকায় অভিনয়ও করেন।[১০] কিন্তু হঠাৎ করেই, ২০০২ সালের জুলাইয়ে জোলি তার নামের শেষাংশ থেকে আইনগতভাবে ‘ভট’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু ‘অ্যাঞ্জেলিনা জোলি’ করার আবেদন করেন।[১৫] দুই মাস পর, ২০০২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তার নাম আইনগতভাবে পরিবর্তিত হয়ে শুধু ‘অ্যাঞ্জেলিনা জোলি’ হয়। ওই বছরেই অ্যাকসেস হলিউড নামের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ভট দাবি করেন যে, তার মেয়ের ‘মারাত্মক মানসিক সমস্যা’ আছে। এই কথার প্রেক্ষিতে জোলি পরে বলেন যে, তিনি তার বাবার সাথে আর সম্পর্ক চালিয়ে যেতে অপারগ। তার কথায়: “আমার বাবার সাথে আমি কথা বলি না, আমি তার সামনে রাগারাগিও করি না। আমি বিশ্বাস করি না কারো পরিবার তাদের বংশধর তৈরি করে, কারণ আমার ছেলেটি দত্তককৃত, আর পরিবারটি অর্জিত”। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, তিনি তার বাবার সাথে দূরত্বের কারণগুলো নিয়ে গণমাধ্যমের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে চাননি, কিন্তু তার একটা দত্তক নেওয়া ছেলে আছে, এবং এবং তিনি মনে করেন না ভটের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়াটা এখন আর খুব একটা ভালো হবে।[১৬] ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জোলি পুনরায় তার বাবার সাথে দেখা করেন ও সম্পর্ক উন্নয়নের আভাস দেন। ছেলেমেয়েদেরসহ জোলি, পিট, ও ভট ইতালির ভেনিসে একত্রিত হন। সে সময় জোলি ভেনিসে দ্য ট্যুরিস্ট চলচ্চিত্রে কাজ করছিলেন।[১৭] পেশাজীবন[সম্পাদনা] প্রাথমিক কাজ (১৯৯৩–১৯৯৭)[সম্পাদনা] একজন ফ্যাশন মডেল হিসেবে চৌদ্দ বছর বয়সে জোলির পেশাজীবন শুরু হয়। তিনি মডেলিং করতেন মূলত লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনে। সে সময়ে তৈরি বিভিন্ন মিউজিক ভিডিওতে তাকে দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে মিট লোফের (‘রক অ্যান্ড রোল ড্রিমস কাম থ্রু’), অ্যানতোনেল্লো ভেনেডিত্তির (‘আলতা মারিয়া’), লেনি ক্র্যাভিট্‌জের (‘স্ট্যান্ড বাই মাই ওমেন’), এবং দ্য লেমনহেডসের (‘ইট'স অ্যাবাউট টাইম’)। ষোলো বছর বয়সে মঞ্চ থেকে তাঁর অভিনয় জীবনের শুরু, এবং তাঁর প্রথম চরিত্রটি ছিলো একজন জার্মান প্রতাপশালীর। মূলত বাবার থেকেই জোলির অভিনয়ের হাতেখড়ি। অভিনয় শেখার জন্য তিনি তাঁর বাবার শিখন প্রক্রিয়া লক্ষ করতেন। তিনি মানুষকে পর্যবেক্ষণ করতেন, এবং আচরণ ও বাহ্যিকতায় ঠিক তাদের মতো হয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন। সে সময় বাবার সাথে জোলির সম্পর্ক পরবর্তীকালের মতো এতোটা শীতল ছিলো না। তখন জোলির কাছে তাঁরা দুজনেই হচ্ছেন ‘নাট্যজগতের রাজা-রাণী’।[১১] জোলির ভাই জেমস হ্যাভেন যখন ইউএসসি স্কুল অফ সিনেম্যাটিক আর্টসের শিক্ষার্থী, তখন তাঁর পাঁচটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্রে জোলি অভিনয় করেন। যদিও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে জোলির পেশাজীবন শুরু হয় ১৯৯৩ সালে; অল্প বাজেটের চলচ্চিত্র সাইবর্গ ২-এ নাম ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে। সেখানে তাঁর চরিত্রের নাম ছিলো ক্যাসেলা ‘ক্যাশ’ রিজ, যে কিনা মানুষের কাছাকাছি একটি রোবট। রোবটটিকে এমনভাবে নকশা করা হয় যেন সে নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় সদরদপ্তরে নিয়ে যেতে প্রলুব্ধ করে, অতঃপর নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে জোলি দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। একটি হচ্ছে স্বাধীন চলচ্চিত্র উইদাউট এভিডেন্স, এবং অপরটি রহস্য চলচ্চিত্র হ্যাকারস। হ্যাকারস-এ তিনি কেট ‘এসিড বার্ন’ লিবি চরিত্রে পার্শ্বভূমিকায় অভিনয় করেন। এটি ছিলো জোলির অভিনয় জীবনের প্রথম হলিউড চলচ্চিত্র। এবং এখানেই জোলির সাথে পরবর্তীতে তাঁর প্রথম স্বামী জনি লি মিলারের পরিচয় হয়। চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মন্তব্য ছিলো, “কেট (অ্যাঞ্জেলিনা জোলি) আসলেই অসাধারণ। তাঁর সহঅভিনেতার চেয়েও তাঁর মুখখানি ছিলো নিষ্প্রতিভ, এবং এই বিরল নারী হ্যাকার যিনি কিনা অর্ধস্বচ্ছ টপস পরিহিত অবস্থায় মনোযোগের সাথে কিবোর্ড নিয়ে কাজে বসেন। তাঁর গুরুগম্ভীর আকর্ষণটুকুকে বাদ দিলে চরিত্রটির যা দরকার ছিলো তার সবই তাঁর মাঝে বিদ্যমান। মিজ জোলির ভঙ্গিমাটি ছিলো খুবই মিষ্টি, একেবারে তাঁর বাবা জন ভটের নিষ্পাপ ভূমিকার মতো।”[১৮] ছবিটি বক্স-অফিসে সাফল্য না দেখাতে পারলেও, এর ভিডিওচিত্রটি মুক্তি পাবার পর এটি প্রশংসিত হয়।[১৯] পরবর্তী বছরে জোলি রম্য চলচ্চিত্র লাভ ইজ অল দেয়ার ইজ (১৯৯৬)-এ জিনা মালাসিসি চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি অনেকাংশে রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটকের একটি অঙ্কের ওপর ভিত্তি করে রচিত, এবং অনেকটা এর সাম্প্রতিক সংস্করণের মতো। তবে মানের দিক থেকে এটি ততোটা উঁচুদরের ছিলো না। চলচ্চিত্রের কাহিনী গড়ে উঠেছিলো নিউ ইয়র্কের ব্রনক্সে বসবাসরত পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রেস্তোরাঁ মালিকের পরিবারকে কেন্দ্র করে। এছাড়াও ঐ বছর জোলি মোহাভি মুন নামে একটি পথচলচ্চিত্রে ইলিয়ানর রিগবি চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটিতে কাহিনী অনেকটা এরকম: মাকে দেখতে যাওয়ার পথে মোহাভি মরুভূমি পাড়ি দেবার সময় পথিমধ্যে এক রেস্তোরাঁয় জোলির (ইলিয়ানর রিগবি) সাথে ড্যানি আয়েলোর (অ্যাল ম্যাকর্ড) দেখা হয় ও তাঁরা পরস্পরের প্রেমে পড়েন। একই বছর জোলি ফক্সফায়ার চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন। এখানে তাঁর চরিত্রের নাম ছিলো মার্গারেট ‘লেগ্‌স’ স্যাডোভ্‌স্কি নামের এক কিশোরীর। ছবিতে লেগ্‌স পাঁচ কিশোরীর একজন। তাঁদের ওপর যৌননিপীড়ন চালানোর কারণে তাঁরা তাঁদেরই এক শিক্ষককে প্রহার করে। এ ছবিতে জোলির অভিনীত চরিত্রটি সম্পর্কে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস-এর মন্তব্য, “এই চরিত্রটি তৈরিতে প্রচুর অবাঞ্ছিত বিষয়বস্তুর আশ্রয় নেওয়া হয়েছে; কিন্তু জোলি, ভটের এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী কন্যা, সর্বদাই এই দ্বিমুখীতাকে জয় করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট ছিলেন। এ ছবির কাহিনী ম্যাডির জবানীতে বিবৃত হলেও ছবিটির মূল বিষয় এবং অনুঘটকরূপে ভূমিকা পালন করেছেন মূলত লেগ্‌স।”[২০] ১৯৯৭ সালে জোলি লস অ্যাঞ্জেলেসের অপরাধজগতের ওপর ভিত্তি করে তৈরি রহস্যচলচ্চিত্র প্লেয়িং গড-এ ডেভিড ডুকভ্‌নি চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিটি সমালোচকদের দৃষ্টিতে মানসম্পন্ন ছিলো না, এবং রজার এবার্ট মন্তব্য করেন, “সাধারণত কঠিন ও আক্রমণাত্মক চরিত্রে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে অভিনয় করেন; অপরাধীর প্রেমিকা হিসেবে তাঁর অভিনয় সবসময়ই রমণীয়, এবং হয়তো তিনি তাই।”[২১] এরপর তিনি টেলিচলচ্চিত্র ট্রু উইমেন-এ অভিনয় করেন। এটি ছিলো একই নামের একটি ঐতিহাসিক রোমান্টিক নাটকের একটি অঙ্কের চলচ্চিত্ররূপ। নাটকটি ছিলো আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলের একটি অন্যতম জনপ্রিয় নাটক। আর এটির মূল ধারণাটি এসেছিলো যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস-নিবাসী কথাসাহিত্যিক জেনিস উডস উইন্ডেলের লেখা একটি বই থেকে। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি সেবছর তাঁকে রোলিং স্টোনসের মিউজিক ভিডিও ‍‘এনিবডি সীন মাই বেবি?’-তেও দেখা যায়। আলোচিত সাফল্য (১৯৯৭–২০০০)[সম্পাদনা] ১৯৯৭ সালে জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র জর্জ ওয়ালেস-এ কর্নেলিয়া ওয়ালেস চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে জোলির পরিচিতি বাড়তে শুরু করে। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার অর্জন করেন ও এমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। এ ছবিতে আলাবামার গভর্নর জর্জ ওয়ালেসের চরিত্রে অভিনয় করেন গ্যারি সিনিস। ছবির পরিচালক জন ফ্রাঙ্কেনহাইমার সমালোচকদের দৃষ্টিতে প্রশংসিত হন, এবং চলচ্চিত্রটি বেশ কয়েকটি পুরস্কারও লাভ করে। এর মধ্যে আছে সেরা মিনি ধারাবাহিক/টেলিচলচ্চিত্র বিভাগে গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার। এই চলচ্চিত্রে দৈনন্দিন জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এক সাবেক গভর্নরের দ্বিতীয় স্ত্রী’র ভূমিকায় অভিনয় করেন জোলি। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় এই গভর্নর গুলিবিদ্ধ ও পক্ষাঘাতগ্রস্থ হন। ১৯৯৮ সালে তিনি এইচবিও প্রযোজিত চলচ্চিত্র জিয়া-তে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন, এবং এখানে তিনি সুপারমডেল জিয়া কারাঞ্জি’র ভূমিকায় অভিনয় করেন। ছবিটির মুখ্য বিষয়গুলো ছিলো যৌনতা, মাদক, আবেগ, এবং মাদকাসক্তির কারণে কারাঞ্জির শারীরিক ও পেশাগত জীবনের ক্রম অধঃপতন; অবশেষে সবকিছু থেকে তাঁর হাল ছেড়ে দেওয়া ও এইডসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ। জিয়া-তে তাঁর অভিনয় সম্পর্কে চলচ্চিত্র সমালোচক ভেনেসা ভেন্সি বলেন, “অ্যাঞ্জেলিনা জোলি জিয়া চরিত্রে অভিনয় করে ভালো পরিচিতি লাভ করেছেন, এবং এটা কেন, তা আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। জোলি তাঁর চরিত্রাভিনয়ে ছিলেন বিপ্লবী—তাঁর অংশগুলো তিনি চিত্রিত করেছেন একধরণের দৃঢ়তা, আকর্ষণীয়তা, এবং বেপরোয়াত্বের সাথে— এই চলচ্চিত্রে তাঁর ভূমিকাটি খুব সম্ভবত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য অভিনয়।”[২২] চলচ্চিত্রটির জন্য পরবর্তী বছরে জোলি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার লাভ করেন, এবং এমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। সেই সাথে তিনি তাঁর প্রথম স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কারটিও লাভ করেন। লি স্ট্যাসবার্গের মেথড অ্যাক্টিং দ্বারা জোলি প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই তাঁর প্রথম দিকের ছবিগুলোতে কাজ করার সময় তিনি ছবির চরিত্রটির মতো জীবনযাপন করতেন। আর এধরণের চেষ্টা চলচ্চিত্র জগতে তাঁর খ্যাতিবৃদ্ধি করে। জিয়াতে অভিনয়ের সময় জোলি তাঁর স্বামী জনি লি মিলারকে বলেছিলেন যে, তিনি তাঁকে ফোন করতে পারবেন না। তাঁর ভাষায়, “আমি তাঁকে বলতাম: ‘আমি নিঃসঙ্গ, আমি মারা যাচ্ছি, আমি সমকামী; তোমার সাথে আমার সামনের কয়েক সপ্তাহ দেখা হবে না।’”[২৩] জিয়া-তে অভিনয় শেষে জোলি তাঁর আবাসস্থল পরিবর্তন করে নিউ ইয়র্কে চলে যান এবং কিছুদিনের জন্য অভিনয় থেকে বিরতি নেন, কারণ তিনি তখন অনুভব করছিলেন যেন তাঁর ‘কিছুই দেবার নেই’। তিনি নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে চলচ্চিত্র পরিচালনার ওপর পড়াশোনা শুরু করেন এবং লিখিত ক্লাসগুলোতে নিয়মিত অংশ নিতে থাকেন। ইনসাইড দি অ্যাক্টরস স্টুডিও নামে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি এর কারণ ব্যাখ্যা করেন এই বলে যে—“আমাকে আবার টেনে তোলার জন্য এটাই ভালো উপায়”।[২৪] ১৯৯৮ সালে জোলি পুণরায় চলচ্চিত্রে ফিরে আসেন হেল’স কিচেন চলচ্চিত্রে গ্লোরিয়া ম্যাকনিয়ারি চরিত্রে অভিনয়ের মাধমে, এবং পরে তাঁকে দেখা যায় চলচ্চিত্র প্লেয়িং বাই হার্ট-এ। সেখানে তাঁকে নেওয়া হয়েছিলো একটি দলের সদস্য হিসেবে, এবং দলটিতে আরও ছিলেন শন কনারি, জিলিয়ান অ্যান্ডারসন, রায়ান ফিলিপ ও জন স্টুয়ার্ট। চলচ্চিত্রটি সমাদৃত হয়; বিশেষ করে জোলির অভিনয় বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। সান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকল এসম্পর্কে মন্তব্য করে, “জোলি এখানে পুণর্নির্মিত একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যা একটি বেপরোয়া ক্লাবারের কথা মনে করিয়ে দেয়, যে কিনা শিখছে কী নিয়ে সে জুয়া খেলতে যাচ্ছে।”[২৫] এ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জোলি ন্যাশনাল বোর্ড অফ রিভিউয়ের ব্রেকথ্রু পারফরমেন্স পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে জোলি মাইক নিউয়েল পরিচালিত কমেডি-ড্রামা চলচ্চিত্র পুশিং টিন-এ অভিনয় করেন। সেখানে তাঁর সহ-অভিনয়শিল্পীরা ছিলেন জন কুস্যাক, বিলি বব থর্নটন, এবং কেট ব্লানচেট। জোলির চরিত্রটি ছিলো থর্নটনের আবেদনময়ী স্ত্রী’র। চলচ্চিত্রটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া লাভ করে, বিশেষ করে জোলির চরিত্রটি সমালোচিত হয়। ওয়াশিংটন পোস্ট সমালোচনা করে লেখে, “ম্যারি (অ্যাঞ্জেলিনা জোলি) লেখকের সম্পূর্ণ হাস্যকর এক সৃষ্টি। মেয়েটি মুক্ত আত্মার অধিকারী, যে কিনা মৃত জবাফুলের ওপর চোখের পানি ফেলে, গাদাখানেক ফিরোজা পাথরের আংটি পরে থাকে, রাসেল সারারাত বাড়ির বাইরে কাটালে একাকী বোধ করে।”[২৬] এরপর তিনি ডেনজেল ওয়াশিংটনের সাথে জেফ্রি ডেভারের অপরাধ উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা চলচ্চিত্র দ্য বোন কালেক্টর-এ অভিনয় করেন। এখানে জোলির চরিত্রটি ছিলো অ্যামেলিয়া ডোনাঘি নামক এক পুলিশ কর্মকর্তার। ডোনাঘির বাবাও পুলিশে ছিলেন এবং তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। ওয়াশিংটনকে, জোলি, একজন সিরিয়াল কিলারকে অনুসরণ করতে সাহায্য করে। ছবিটি বিশ্বব্যাপী ১৫.১ কোটি মার্কিন ডলার আয় করলেও[৩] সমালোচকদের দৃষ্টিতে এটি সফল হতে পারেনি। ডিট্রয়েট ফ্রি প্রেস মন্তব্য করে, “জোলি সবসময়ের মতো এখানেও সুন্দর অভিনয় উপহার দেবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে চরিত্রটি তাঁর ছিলো না।”[২৭] “জোলি বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্রের অত্যন্ত কর্মস্পৃহা সম্পন্ন একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, তিনি যেন একটা খোলা কামান, যার উদ্দেশ্যই হচ্ছে সবকিছু চূর্ণ করে দেওয়া।” —চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট; গার্ল, ইন্টারাপ্টেড চলচ্চিত্রে জোলির অভিনয় সম্পর্কে মন্তব্য করে[২৮] পরবর্তীতে জোলি গার্ল, ইন্টারাপ্টেড (১৯৯৯) চলচ্চিত্রে পার্শ্ব-অভিনেত্রী হিসেবে লিসা রো চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ছবির কাহিনী ছিলো সুসানা কায়জেন নামক একজন মানসিক রোগীকে ঘিরে। চরিত্রটি নেওয়া হয়েছিলো কায়জেনের একই নামের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ গার্ল, ইন্টারাপ্টেড থেকে। ছবিটিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন উইনোনা রাইডার, এবং আশা করা হয়েছিলো এর মাধ্যমেই তিনি আবার ভালোভাবে অভিনয়ে ফিরে আসবেন, কিন্তু বাস্তবে এটি জোলির জন্য বর হয়ে আসে, এবং তিনি হলিউডে তাঁর শেষ আলোচিত সাফল্যটি লাভ করেন।[২৯] এটির জন্য তিনি সেরা পার্শ্ব-অভিনেত্রী হিসেবে, তৃতীয়বারের মতো গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার, দ্বিতীয়বারের মতো স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কার, এবং প্রথমবারের মতো একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। এই চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় সম্পর্কে ভ্যারাইটি ম্যাগাজিনের মন্তব্য, “দৃঢ়তাপূর্ণ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হিসেবে জোলি অসাধারণ, কিন্তু এখানে জোলির অভিনয় ছিলো পুণর্বাসনকেন্দ্রের ডাক্তারদের চেয়েও অনেক বেশি যান্ত্রিক।”[৩০] ২০০০ সালে, জোলি তাঁর জীবনের প্রথম গ্রীষ্মকালীন ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র গন ইন সিক্সটি সেকেন্ডস-এ অভিনয় করেন, যেখানে তাঁর চরিত্রটি ছিলো গাড়ি চোর নিকোলাস কেজের সাবেক প্রেমিকা সারা ‘সোয়ে’ ওয়েল্যান্ডের। ছবিতে জোলির ভূমিকা ও উপস্থিতি ছিলো খুবই অল্প এবং ওয়াশিংটন পোস্ট সমালোচনা করে লেখে, “এ ছবিতে সে যা কিছু করেছে তা হচ্ছে, যাওয়া-আসা, ঘুরে বেড়ানো, আর দাঁতগুলোকে ঘিরে থাকা তাঁর হৃষ্টপুষ্ট ঠোঁটযুগলকে উত্তেজনাকরভাবে নাড়ানো”[৩১] পরবর্তীতে জোলি ব্যাখ্যা করে বলেন, লিসা রো-এর মতো একটি গুরুগম্ভীর চরিত্রে অভিনয়ের পর সেটা ছিলো অনেকটা স্বাগত উপস্থিতির মতো। এ চলচ্চিত্রটি ছিলো তখন পর্যন্ত জোলির অভিনীত সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। বিশ্বব্যাপী এটির আয় ছিলো ২৩.৭ কোটি মার্কিন ডলার।[৩] আন্তর্জাতিক সাফল্য (২০০১–বর্তমান)[সম্পাদনা] কান চলচ্চিত্র উৎসবে জোলি, ২০০৭ উঁচুমানের অভিনয় প্রতিভা ও দক্ষতা থাকাসত্ত্বেও জোলির অভিনীত চলচ্চিত্রগুলো প্রায়ই আন্তর্জাতিকভাবে সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হতো; তাঁর এই অপূর্ণতা পূর্ণ হয় ২০০১ সালে লারা ক্রফ্‌ট: টুম্ব রেইডার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। চলচ্চিত্রটি ছিলো জনপ্রিয় ভিডিও গেম টুম্ব রেইডার-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এই চলচ্চিত্রে লারা ক্রফ্‌ট চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে জোলিকে ব্রিটিশ উচ্চারণে ইংরেজি বলা শিখতে হয়েছিলো ও মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিলো। জোলি তাঁর অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত হন, কিন্তু চলচ্চিত্রটির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মন্তব্যই আসে অনুৎসাহমূলক। স্লান্ট ম্যাগাজিন মন্তব্য করে, “লারা ক্রফ্‌ট চরিত্রটিতে অভিনয় করার জন্যই অ্যাঞ্জেলিনা জোলির জন্ম হয়েছিলো কিন্তু পরিচালক সাইমস ওয়েস্ট তাঁকে একটি ফ্রগার খেলার কাঠামোর ভেতর দিয়ে যেতে বাধ্য করেছেন।”[৩২] তবে সবকিছুর পরও ব্যবসায়িকভাবে চলচ্চিত্রটি ছিলো সফল; বিশ্বব্যাপী এটির আয় ছিলো ২৭.৫ কোটি মার্কিন ডলার,[৩] এবং এই চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে জোলির আন্তর্জাতিক খ্যাতির শুরু। এরপর জোলি অরিজিনাল সিন (২০০১) চলচ্চিত্রে আন্তোনিও বান্দেরাসের বিপরীতে অভিনয় করেন। এখানে জোলির চরিত্রটি ছিলো বান্দেরাসের চিঠিপ্রাপ্ত বিয়ের কনে ও পরবর্তীতে বিবাহিত স্ত্রী জুলিয়া রাসেল হিসেবে। চলচ্চিত্রটির নাট্যরূপ রচিত হয়েছিলো কর্নেল উলরিচ রচিত রহস্যপোন্যাস ওয়াল্টজ ইনটু ডার্কনেস অনুসারে। সমালোচকদের সুদৃষ্টি কাড়তে চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স মন্তব্য করে, “গল্পটি মিজ জোলিকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলো।”[৩৩] ২০০২ সালে তিনি লাইফ অর সামথিং লাইক ইট চলচ্চিত্রে ল্যারি ক্যারিগ্যান চরিত্রে অভিনয় করেন। একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী টেলিভিশন প্রতিবেদককে নিয়ে এই ছবিটির মূল গল্প আবর্তিত, যে ঘোষণা দেয় সে এক সপ্তাহের মধ্যে মারা যাবে। সমালোচকরা ছবিটিকে খুব ভালোভাবে নেননি, কিন্তু জোলির অভিনয় কিছু উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্য লাভ করে। সিএনএন-এর পল ক্লিনটন লেখেন, “জোলি তাঁর চরিত্রে ছিলেন অসাধারণ, যদিও ছবিটির কাহিনীর মাঝের কিছু অংশ ছিলো হাস্যকর। একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অভিনেত্রী এখানে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা, এবং অর্থপূর্ণ জীবনের প্রকৃত অর্থের সন্ধানে তাঁর যাত্রা অবিশ্বাস্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।”[৩৪] ২০০৩ সালে জোলি লারা ক্রফ্‌ট: টুম্ব রেইডার চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় পর্ব লারা ক্রফট টুম্ব রেইডার: দ্য ক্রেডেল অফ লাইফ-এ অভিনয় করেন, কিন্তু এখানে তাঁর অভিনয় আগের মতো ততোটা উজ্জ্বল ছিলো না। ছবিটি আন্তর্জাতিকভাবে ১৬.৫ কোটি মার্কিন ডলার আয় করে।[৩] ঐ বছরে জোলি বিয়ন্ড বর্ডারস নামে আরেকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, যার কাহিনী গড়ে উঠেছিলো আফ্রিকায় কাজ করা সাহায্যকর্মীদের নিয়ে। যদিও ছবিটির বিষয়বস্তু জোলির বাস্তব জীবনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, তবুও ছবিটি সমালোচকদের দৃষ্টি ও ব্যবসা, উভয়দিক থেকে সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস এ সম্পর্কে তাঁদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, “জোলি যা করেছেন তাঁর অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র গার্ল, ইন্টারাপ্টেড-এ, তা প্রমাণ করে, যেটির বাস্তবতা তিনি বোঝেন সেই চরিত্রে তিনি গতিময়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা উভয়ই আনার সামর্থ্য রাখেন। এবং তিনি সেটা করতেও পারেন, লারা ক্রফট-এর ছবিগুলোতে, কার্টুনের ছবিগুলোতে তিনি তা করে দেখিয়েছেন। কিন্তু একটি উঁচুমানের চরিত্রের অবহেলিত অবস্থা, আর নিচুমানের লেখায় ফুটিয়ে তোলা এই সহিংস পৃথিবীর হাড্ডিসার কিছু মানুষের কথা, তাঁকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে ফেলেছে।”[৩৫] অভিনেতা ইথান হকের সাথে জোলি ২০০৪ সালে রহস্য চলচ্চিত্র টেকিং লাইভস-এ অভিনয় করেন। এখানে জোলি ইলিয়ানা স্কট নামের একজন এফবিআই এজেন্ট রূপে অভিনয় করেন, এবং তাঁর কাজ ছিলো কানাডার মন্ট্রিলের অপরাধ বিভাগকে একজন ক্রমিক খুনি খুঁজে বের করতে সাহায্য করা। ছবিটি সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আসে, এবং দ্য হলিউড রিপোর্টার মন্তব্য করে, “অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন, এটি নিশ্চিতভাবেই মনে আসে যে তিনি আগেও এধরণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু এখানে তাঁর উত্তেজনা ও গ্ল্যামারের অতিরিক্ত বহিঃপ্রকাশ ছিলো খুবই গাঢ় ও চোখে লাগার মতো।”[৩৬] জোলি একই বছর ড্রিমওয়ার্কস প্রযোজিত চলচ্চিত্র শার্ক টেল (২০০৪)-এ লোলা চরিত্রে কণ্ঠদান করেন। শার্ক টেল হচ্ছে একটি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র এবং লোলা একটি অ্যাঞ্জেলফিশ। ঐ বছরই তিনি কেরি কনরানের বিজ্ঞান কল্পকাহিনীভিত্তিক অ্যাডভেঞ্চার চলচ্চিত্র স্কাই ক্যাপ্টেন এন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অফ টুমরো-এ কমান্ডার ফ্রান্সেসকা ‘ফ্র্যাঙ্কি’ কুক চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণ ব্লুস্ক্রিনের সামনে তৈরি করা হয়। ২০০৪ সালে তাঁর অভিনীত শেষ চলচ্চিত্রটি হচ্ছে অলিভার স্টোনের তৈরি জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র আলেকজান্ডার। ছবিটির কাহিনী গড়ে উঠেছে সেনাপতি মহামতি আলেকজান্ডারের জীবনকে কেন্দ্র করে। এখানে জোলির অভিনীত চলচ্চিত্রটির নাম ছিলো অলিম্পাস। পরিচালক স্টোনের, আলেকজান্ডারের চরিত্রের উভকামী দিকটি নিচুভাবে উপস্থাপন করাটা স্থানীয় দর্শকরা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি।[৩৭] ছবিটি স্থানীয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়িকভাবে সফলতা লাভে ব্যর্থ হয়, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এটি ছিলো একটি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে এটি ১৩.৯ কোটি ডলার আয় করে।[৩] ২০০৫ সালে জোলির অভিনীত একমাত্র চলচ্চিত্রটি ছিলো ডাগ লাইম্যান পরিচালিত অ্যাকশন কমেডি মি. এন্ড মিসেস. স্মিথ। চলচ্চিত্রটির কাহিনী গড়ে উঠেছে একঘেয়েমীতে ভোগা এক বিবাহিত দম্পতিকে কেন্দ্র করে, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সেখানে দুটি ভিন্ন সংগঠনের নিয়োগপ্রাপ্ত গোপন হত্যাকারী। জোলির চরিত্রের নাম ছিলো জেন স্মিথ, এবং তিনি অভিনয় করেছিলেন জেমস স্মিথ নামী ব্র্যাড পিটের বিপরীতে। চলচ্চিত্রটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেলেও ছবিটিতে এই দুই তারকার বিচিত্র দাম্পত্যজীবনের কারণে এটি দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। স্টার ট্রিবিউন-এর মন্তব্য, “যদিও কাহিনীটি মাঝে মাঝে খাপছাড়া বলে মনে হয়, তবুও এটি সবাইকে নিয়ে দেখার মতো, আর দৃশ্যের গতিময়তা ও পর্দার তারকাদের তাপীয় রসায়ন দর্শককে আরও বেশি চাঙ্গা করে তোলে।”[৩৮] চলচ্চিত্রটি বিশ্বব্যাপী ৪৭.৮ কোটি মার্কিন ডলার আয় করে, যা ছিলো ২০০৫ সালে সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবিগুলোর অন্যতম।[৩] ২০০৭ সালের নভেম্বরে চেঞ্জলিং চলচ্চিত্রে কাজ করার সময় ক্রিস্টিন কলিন্স ভূমিকায় জোলি পরবর্তী বছরে তিনি রবার্ট ডি নিরোর দ্য গুড শেপার্ড চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এটি ছিলো এডওয়ার্ড উইলসনের দেখা সিআইএ-এর প্রাথমিক ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি চলচ্চিত্র। এখানে এডওয়ার্ড উইলসন চরিত্রে অভিনয় করেন ম্যাট ডেমন, এবং জোলি পার্শ্বঅভিনেত্রী হিসেবে অভিনয় করেন ডেমনের অবহেলিত স্ত্রী মার্গারেট রাসেলের চরিত্রে। ছবিটিতে জোলির অভিনয় সম্পর্কে শিকাগো ট্রিবিউন-এর মত: “জোলির বয়স ছিলো আগাগোড়া বিশ্বাসযোগ্য ও প্রাণবন্ত, এবং এভাবেই তাঁর ভঙ্গুর চরিত্রটি সচারচর সহানুভূতি থেকে বেরিয়ে আসে।”[৩৯] চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে জোলির অভিষেক ঘটে ২০০৭ সালে, তথ্যচিত্র আ প্লেস ইন টাইম পরিচালনার মাধ্যমে। মাত্র এক সপ্তাহে পৃথিবীর ২৭টি ভিন্ন স্থানে চলচ্চিত্রটির চিত্রধারণের কাজ করা হয়। ট্রাইবেকা চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি প্রদর্শিত হয়, এবং ন্যাশনাল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে মূলত হাই স্কুলগুলোতে ছবিটি বিতরণ করার ব্যবস্থা করা হয়।[৪০] ঐ বছরই জোলি পরিচালক মাইকেল উইন্টারবটমের নাট্যচলচ্চিত্র আ মাইটি হার্ট (২০০৭)-এ মারিয়ান পার্ল চরিত্রে অভিনয় করেন। এ ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে পাকিস্তানে কর্মরত ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লের অপহরণ ও হত্যাকে ঘিরে। আ মাইটি হার্ট হচ্ছে ড্যানিয়েল পার্লের স্ত্রী মারিয়ান পার্লের লেখা একটি স্মৃতিকথামূলক বই। চলচ্চিত্রটি প্রথম মুক্তি পায় কান চলচ্চিত্র উৎসবে। এখানে জোলির অভিনয়কে দ্য হলিউড রিপোর্টার ‘ভারসাম্যপূর্ণ ও গতিশীল’, এবং চরিত্রচিত্রণকে ‘জটিল চরিত্রটিকে শ্রদ্ধার ও কোমলতার সাথে আঁকড়ে ধরা’ হিসেবে বর্ণনা করে।[৪১] এই চলচ্চিত্রটি তাঁকে তাঁর চতুর্থ গোল্ডেন গ্লোব ও তৃতীয় স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কারের মনোনয়ন এনে দেয়। এছাড়া একই বছরে জোলি মোশন ক্যাপচার কৌশলে চিত্রিত মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র বেউল্‌ফ-এ গ্রেন্ডালের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ২০০৮ সালে জোলি, জেমস ম্যাকঅ্যাভয় ও মরগ্যান ফ্রিম্যানের সাথে একত্রে অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র ওয়ান্টেড-এ অভিনয় করেন। এটি মূলত মার্ক মিলারের গ্রাফিক উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ। চলচ্চিত্রটি সমালোচকসহ সর্বমহলের প্রশংসা লাভ করে, এবং বিশ্বব্যাপী ৩৪.২ কোটি মার্কিন ডলার আয় করে।[৩] এছাড়া তিনি ড্রিম ওয়ার্কসের অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র কুং ফু পান্ডা (২০০৮)-এ মাস্টার টিগ্রেস চরিত্রে কণ্ঠদানও করেছেন। চলচ্চিত্রটি বিশ্বব্যাপী আয় করে ৬৩.২ কোটি মার্কিন ডলার, যা ছিলো তখন পর্যন্ত জোলির অভিনীত সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র।[৩] একই বছরে তিনি ক্লিন্ট ইস্টউডের পরিচালিত নাট্য চলচ্চিত্র চেঞ্জলিং (২০০৮)-এ নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। সে বছরই কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি মুক্তি পায়।[৪২] ১৯২৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসের এক নারীর জীবনের সত্য ঘটনাকে ভিত্তি করে ছবিটির কাহিনী গড়ে উঠেছে। কাহিনীতে দেখা যায়, একজন মায়ের সাথে তাঁর অপহরণকৃত ছেলের পুণর্মিলন ঘটে—শুধুমাত্র এটা জানতে যে, ছেলেটি একটি ভণ্ড। এ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জোলি দ্বিতীয়বারের মতো একাডেমি পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন। এছাড়া তিনি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার, বাফটা পুরস্কার, এবং স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কারের জন্যও মনোনয়ন লাভ করেন।[৪৩] দ্য শিকাগো ট্রিবিউন এ চলচ্চিত্রে জোলির অভিনয়ের প্রসঙ্গ টেনে বলে, “ঐ দৃশ্যগুলোতে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধতার পূর্বে জোলির প্রসন্নতা সত্যিই দ্যুতি ছড়ানোর মতো... যখন পুলিশ কর্তৃপক্ষের সাহায্যকারী লোকটিই তাঁর বিপদের সময় তাঁর মর্যাদা ও অনুভূতিতে আঘাত করে।”[৪৪] ২০১০ সালে সল্ট চলচ্চিত্রের বার্লিন প্রিমিয়ারে জোলি জোলিকে পরবর্তীতে দেখা যায় ২০১০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র সল্ট-এ। পূর্বের ছবির পর সামনের দুই বছরে এটি-ই ছিলো তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রে তিনি লিয়েভ শ্রাইবারের সাথে সিআইএ এজেন্ট এভেলিন সল্টের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এখানে জোলি ছিলেন সিআইএ-তে কর্মরত একজন গোপন কেজিবি এজেন্ট যিনি তাঁর পরিচয় প্রকাশ হওয়ার পর মিশন শুরু করেন। সল্ট চরিত্রটি প্রথমে ছিলো একজন পুরুষের, কিন্তু পরবর্তীতে কলাম্বিয়া পিকচার্স, চলচ্চিত্রটির পরিচালক ফিলিপ নয়েসকে জোলিকে এই ছবিতে নেওয়ার পরামর্শ দিলে চরিত্রটি পরিবর্তন করা হয়। বিশ্বব্যাপী ২৯.৪ কোটি মার্কিন ডলার আয় করা এই চলচ্চিত্রটি ছিলো আন্তর্জাতিকভাবে একটি ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র।[৩] চলচ্চিত্রটি ইতিবাচক সাড়ার সাথে সাথে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার লাভ করে এবং জোলির অভিনয় প্রশংসিত হয়। এম্পায়ার ম্যাগাজিনের বিবৃতিতে, “যখন অসাধারণ, পাগলাটে, ও মৃত্যুঞ্জয়ী পারদর্শীতা বিক্রির সময় আসে, তখন অ্যাকশন ব্যবসায় জোলির কিছু অংশ আছে।”[৪৫] একই বছরে তাঁকে জনি ডেপের সাথে দ্য ট্যুরিস্ট (২০১০) চলচ্চিত্রেও দেখা যায়। এটি ছিলো সমালোচকদের দৃষ্টিতে জোলির এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। জোলির অভিনয় সম্পর্কে চলচ্চিত্র সমালোচক পিটার ট্রেভার্স মন্তব্য করেন, “ডেপ এবং জোলি তাঁদের ক্যারিয়ারের শেষ মাথায় ছুঁয়ে ফেলেছেন, এবং তাঁদের রসায়ন যা সৃষ্টি করেছে তা হচ্ছে উচ্চ ফ্যাশনের জোম্বি।”[৪৬] স্থানীয় বক্স অফিসে ধীরগতিতে লাভের মুখ দেখা শুরু করলেও, পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্রটি ২৭.৮ কোটি ডলার আয় করে।[৩] এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য জোলি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন, যা ছিলো একটি বিতর্কিত মনোনয়ন। কারণ বিতর্ক উঠছিলো যে, পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে তাঁর উচ্চমার্গীয় উপস্থিতি নিশ্চিত করতেই তাঁকে এ পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়।[৪৭][৪৮] ২০১১ সালে জোলি ড্রিমওয়ার্কস ধারাবাহিক কুং ফু পান্ডা ২-এ মাস্টার টিগ্রেসের ভূমিকায় কণ্ঠ প্রদান করেন। আন্তর্জাতিক বক্স অফিসে ৬৬.৩ কোটি ডলার আয় করা এই চলচ্চিত্রটি তাঁর পূর্বের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।[৩] এ বছর তিনি পরিচালক হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। ইন দ্য ল্যান্ড অফ ব্লাড অ্যান্ড হানি (২০১১) নামক চলচ্চিত্রটির কাহিনী গড়ে উঠেছিলো একজন সার্বীয় সৈনিক ও বসনীয় নারী যুদ্ধাবন্দীর প্রেমকাহিনীকে কেন্দ্র করে। ছবিটিতে ১৯৯২-৯৫-এ সংঘটিত বসনিয়ার যুদ্ধের সময়কালকে ফুটিয়ে তোলা হয়। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার শুভেচ্ছাদূত হিসেবে জোলি দুইবার বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা পরিদর্শন করেছিলেন, এবং সমকালীন ইতিহাসে সংঘটিত যুদ্ধগুলোতে টিকে যাওয়া জনগোষ্ঠীর বাস্তবতার দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার লক্ষ্যেই তিনি এই ছবিটি নির্মাণ করেছেন বলে জানান।[৪৯] বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে ছবিটির চিত্রায়ণের সময় অ্যাসোসিয়েশন অফ উইমেন ভিকটিমস অফ ওয়ারের বিক্ষোভের মুখে বসনিয়াতে ছবিটির কাজের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়; কারণ গুজব ওঠে যে, জোলির ছবির চিত্রনাট্যে একজন ধর্ষিতার প্রেম কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যেখানে ধর্ষিতা তাঁর ধর্ষকেরই প্রেমে পড়ে।[৫০] পরবর্তীতে জোলি যখন বসনিয়ার যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা প্রদানকারী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের কাছে সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রটি পরিবেশন করেন তখন তাঁদের প্রতিক্রিয়া ছিলো খুব বেশি মাত্রায় ইতিবাচক।[৫১] প্রায় সাড়ে তিন বছর পর তিনি বড় পর্দায় ফিরেন ম্যালেফিসেন্ট ছবির মাধ্যমে। বিশ্বব্যাপী এটির আয় ছিলো ৭৫.৮ কোটি মার্কিন ডলার।[৫২] এটিই এখন পর্যন্ত তার করা সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। এরপর তিনি পরিচালক হিসেবে তার পরবর্তী চলচ্চিত্র আনব্রোকেনের কাজ সম্পন্ন করেন। মানবহিতৈষী কর্মকাণ্ড[সম্পাদনা] কম্বোডিয়াতে যখন জোলি টুম্ব রেইডার চলচ্চিত্রে কাজ করছিলেন, তখন থেকেই জোলি ব্যক্তিগতভাবে মানবতার অভাবকে উপলব্ধি করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে এসে আন্তর্জাতিকভাবে পীড়িত ও দুঃস্থ অঞ্চলগুলো সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য জোলি ইউএনএইচসিআর-এর দ্বারস্থ হন।[৫৩] মানবতার এই বিপর্যয়কে ভালোভাবে জানা ও বাস্তবতা উপলব্ধির জন্য তৎপরবর্তি কয়েক মাস জোলি বিশ্বের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও দূর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। ফেব্রুয়ারি ২০০১-এ তাঁর প্রথম সফরে জোলি ১৮ দিনের জন্য সিয়েরা লিওন ও তানজানিয়া ভ্রমণ করেন। এ সম্পর্কে তাঁর ব্যাথাতুর উপলব্ধির কথা তিনি পরবর্তীতে গণমাধ্যমকে জানান।[৫৩] পরবর্তী মাসগুলোতে তিনি যেসকল স্থানে সফর করেন তার মধ্যে, দুই সপ্তাহের জন্য কম্বোডিয়া সফর ও পরবর্তীতে পাকিস্তানের আফগান শরণার্থী শিবির পরিদর্শন। ইউএএইচসিআর-এর জরুরি অনুদান প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে তিনি সেখানে আফগান শরণার্থীদের জন্য ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার অনুদান দেন।[৫৪] এসমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর সকল সফরের ব্যয়ভার তিনি নিজেই বহন করেন এবং তিনি ঠিক সেই সুযোগ-সুবিধাটুকুই গ্রহণ করেন, যা ইউএনএইচসিআর-এর একজন মাঠপর্যায়ের কর্মীর জন্য বরাদ্দকৃত।[৫৩] ২০০১ সালের ২৭ আগস্ট জেনেভায় অবস্থিত ইউএনএইচসিআর-এর সদরদপ্তরে জোলিকে ইউএনএইচসিআর শুভেচ্ছাদূত হিসেবে ভূষিত করা হয়।[৫৫] “বাইরে সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ কষ্ট ভোগ করছে; নিজেদেরকে দূরে রেখে বা উপেক্ষা করে এই খবরটা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। আমি সত্যিই সাহায্য করতে চাই। আমি বিশ্বাস করি না আমার ধ্যানধারণা অন্যদের থেকে আলাদা। বরং আমরা সবাই সুবিচার ও সমতা চাই, অর্থপূর্ণ একটি জীবনের নিশ্চয়তা চাই। আমরা সবাই বিশ্বাস করতে চাই যে, যদি আমরা কোনো খারাপ অবস্থায় থাকতাম, তবে কেউ না কেউ আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসতো।” —জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনে নিজের যোগদানের কারণ জানিয়ে জোলি[৫৩] মাঠপর্যায়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জোলি পরিদর্শন করেছেন এবং ২০টিরও বেশি দেশে তিনি শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণভাবে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের সাথে দেখা করেছেন।[৫৬] তিনি এর মাধ্যমে কী বাস্তবায়ন করতে চাইছেন, তা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “এই দুর্দশাগ্রস্থ মানুষদের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে চাই। আমার মনে হয় আমাদের উচিত তাঁদের বেঁচে থাকার এই সংগ্রামের প্রশংসা করা, নাক সিঁটকানো নয়।”[৫৭] ২০০২ সালে জোলি থাইল্যান্ডের থাম হিন শরণার্থী শিবির ও ইকুয়েডরে বসবাসরত কলম্বীয় শরণার্থীদের দেখতে যান।[৫৮] পরবর্তীতে জোলি কসভোতে অবস্থিত বিভিন্ন ইউএনএইচসিআর শিবির পরিদর্শন করেন এবং কেনিয়ার কাকুমা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। কেনিয়ার এই শিবিরের শরণার্থীরা প্রধানত সুদান থেকে আগত। নামিবিয়াতে বিয়ন্ড বর্ডারস চলচ্চিত্রে কাজ করার সময় তিনি সেখানকার অ্যাঙ্গোলান শরণার্থীদের সাথেও দেখা করেন। ২০০৩ সালে জোলি ছয় দিনের সফরে তানজানিয়ার পশ্চিম সীমান্তে যান, যেখানে মূলত কঙ্গোর শরণার্থীরা অবস্থান করেন। এছাড়া তিনি শ্রী লংকাতেও এক সপ্তাহব্যাপী একটি সফর করেন। নর্থ ককেশাস অঞ্চলে ভ্রমণের ইতি টানার জন্য চারদিনের সফরে রাশিয়াও ভ্রমণ করেন। বিয়ন্ড বর্ডারস চলচ্চিত্রের প্রকাশের সাথে সাথে তিনি নোটস ফ্রম মাই ট্রাভেলস নামের একটি দিনলিপি প্রকাশ করেন, যাতে ২০০১-২০০২ বছরে তাঁর বিভিন্ন সফরের ক্রমানুক্রমিক দিনলিপি বিধৃত ছিলো। ব্যক্তিগতভাবে ২০০৩-এর ডিসেম্বরে জর্ডানে সময় কাটানোর সময় তিনি জর্ডানের পূর্ব মরুভূমিতে অবস্থিত ইরাকী শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের আগ্রহ প্রকাশ করেন, এবং তার পরের মাসে তিনি সুদানী শরণার্থীদের সাথে দেখা করতে মিশর যান। জোলি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তাঁর প্রথম জাতিসংঘ সফরের অংশ হিসেবে ২০০৪ সালে অ্যারিজোনা সফর করেন। সেখানকার তিনটি আশ্রয়কেন্দ্র দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের মূল কর্মকাণ্ডগুলোর একটি—ফিনিক্সের উদ্বাস্তু শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। ২০০৪ সালে তিনি শাদের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে পশ্চিম সুদানের দারফুর সংকটের কারণে সৃষ্ট উদ্বাস্তুদের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন। চার মাস পর তিনি সরাসরি দারফুরেই সফর করেন। ২০০৪ সালে তিনি থাইল্যান্ডে অবস্থিত আফগান শরণার্থীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বড়দিনের ছুটিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইউএনএইচসিআর-এর আঞ্চলিক দপ্তর পরিদর্শন করেন। সেই সাথে এ সফরে তিনি বৈরুতের কিছু অল্পবয়সী শরণার্থী ও ক্যান্সার রোগীর সাথে সাক্ষাৎ করেন।[৫৯] ২০০৫ সালে জোলি পাকিস্তানে অবস্থিত আফগান শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন, এবং সেই সাথে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ‍পারভেজ মুশাররফ ও প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ২০০৫ সালের কাশ্মীর ভূমিকম্পের প্রভাব ও ভূমিকম্প পরবর্তী অবস্থা পরিদর্শনের জন্য তিনি থ্যাংকসগিভিং-এর সাপ্তাহিক ছুটিতে ব্র্যাড পিটের সাথে আরেকবার পাকিস্তান সফর করেন। ২০০৬-এ জোলি ও পিট হাইতিতে যান ইয়েলা হাইতি নামের একটি দাতব্য সংগঠনের অর্থায়িত স্কুল পরিদর্শনের জন্য। এই দাতব্য সংগঠনটি প্রতিষ্ঠাতা হিপহপ সঙ্গীতশিল্পী ওয়াইক্লেফ জঁ। ভারতে আ মাইটি হার্ট চলচ্চিত্রের চিত্র ধারণের সময় তিনি নয়া দিল্লীতে আফগান ও বার্মিজ শরণার্থীদের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। ২০০৬ সালের বড়দিন তিনি কোস্টা রিকার স্যান হোসেতে কলম্বীয় শরণার্থীদের সাথে পালন করেছেন। সেখানে তিনি তাঁদের মাঝে উপহারও বিতরণ করেন। ২০০৭-এ জোলি দারফুরের অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি পরিমাপের জন্য দুই দিনের সফরে শাদ সফর করেন। শাদ ও দারফুরের তিনটি ত্রাণ সংগঠনকে জোলি ও পিট ১০ লাখ ডলার করে অনুদান দেন।[৬০] সেই বছরে জোলি প্রথমবারের মতো সিরিয়া সফর করেন, এবং দুইবার ইরাক সফর করেন। ইরাকে তিনি শরণার্থীদের সাথে সাক্ষাতের পাশাপাশি বহুজাতিক সৈন্য ও মার্কিন সৈন্যদের সাথেও সাক্ষাৎ করেন।[৬১] জুন ২০০৫ সালে বিশ্ব শরণার্থী দিবস-এ অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ও কন্ডোলিৎসা রাইস সময়ের সাথে সাথে জোলি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, মানবতার পক্ষে সংশ্লিষ্টতা বাড়ানোর কাজে আরও বেশি সময় দেওয়া শুরু করেন। তিনি নিয়মিত ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে বিশ্ব শরণার্থী দিবসে অংশগ্রহণ করে আসছেন। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে মানবতার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তদ্বির শুরু করেন, এবং ২০০৩ সালে তিনি কমপক্ষে ২০ বার বিভিন্ন কংগ্রেস সদস্যের সাথে দেখা করেন।[৫৫] ফোর্বস ম্যাগাজিনকে এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ওয়াশিংটন দেখার সেরকম কোনো ইচ্ছা আমার ছিলো না, আমি যা করেছি তা শুধু বলটা নড়ানোর জন্যই।”[৫৫] ২০০৫ সালে তিনি ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবের অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নেন, যেখানে তিনি ন্যাশনাল সেন্টার ফর রেফিউজি এন্ড ইমিগ্রান্ট চিলড্রেন নামে একটি সংস্থার গোড়াপত্তনের ঘোষণা দেন। এই সংগঠনের কাজ হবে এতিমখানায় থাকা যেসব শিশুর আইনগত অধিকার পাবার সুযোগ নেই, তাঁদেরকে আইনগত সুবিধাদি প্রদান করা। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম দুই বছরের জন্য জোলি ব্যক্তিগতভাবে পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার অনুদান দেন।[৬২] তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই জোলি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ও শিশুদের বিভিন্ন কাজে এমন অর্থ অনুদান দিয়ে আসছেন।[৫৫] যেহেতু তিনি রাজনীতিতেও সক্রিয়, তাই তার এই পরিচিতিকে তিনি, মানবতার দাবী, গণমাধ্যমের সামনে আনার জন্য ব্যবহার করেন। দ্য ডায়েরি অফ অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এন্ড ড. জেফ্রি স্যাক্স ইন আফ্রিকা নামে এমটিভির জন্য তিনি একটি বিশেষ অনুষ্ঠান তৈরি করেন। এর কাহিনী গড়ে উঠেছে জোলি ও বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. জেফ্রি স্যাক্সের পশ্চিম কেনিয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে সফরকে কেন্দ্র করে। ২০০৬ সালে জোলি দাতব্য সংগঠন ‘জোলি/পিট ফাউন্ডেশন’-এর গোড়াপত্তন করেন, যা গ্লোবাল অ্যাকশন ফর চিলড্রেন এবং ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস নামের দুটি সংগঠনের প্রত্যেককে এক মিলিয়ন ডলার করে অনুদান দেয়।[৬৩] সেই বছরেই জোলি ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের স্থাপিত এজুকেশন পার্টনারশিপ ফর চিলড্রেন অফ কনফ্লিক্ট-এর সহ-চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করেন। এ প্রতিষ্ঠানটির কাজ হচ্ছে বিভিন্ন সংঘর্ষের শিকার শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে অর্থ সহায়তা প্রদান করা।[৬৪] জোলি তাঁর মানবহিতৈষী কর্মকাণ্ডের জন্য বিশ্বব্যাপী একটি ভালো পরিচিতি ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। ২০০৩ সালে ইউনাইটেড নেশন্স করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে নতুন ঘোষিত পুরস্কার সিটিজেন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড পুরস্কার, প্রথমবারের মতো প্রদান করে। ২০০৫ সালে তিনি ইউএনএ-ইউএসএ কর্তৃক গ্লোবাল হিউম্যানিটেরিয়ান পুরস্কার লাভ করেন।[৬৫] কম্বোডিয়ার রাজা নরোডোম শিয়ামনি ১২ আগস্ট ২০০৫-এ তাঁর দেশে পরিবেশ সংরক্ষণমূলক কাজ করার জন্য জোলিকে কম্বোডিয়ার সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করেন। জোলি কম্বোডিয়ার উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ব্যাটামবংয়ে একটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ৫০ লাখ মার্কিন ডলার দেবার প্রতিশ্রুতি দেন, এবং সেখানে বেশকিছু সম্পত্তিও ক্রয় করেন।[৬৬] ২০০৭-এ তিনি কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের একজন সদস্য হন,[৬৭] এবং ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি কর্তৃক ফ্রিডম পুরস্কারে ভূষিত হন।[৬৮] ২০১০ সালে হাইতিতে ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত ক্ষতিগ্রস্থদের উদ্দেশ্যে জোলি ও পিট ১০ লক্ষ ডলার সাহায্য প্রদান করেন। এছাড়া পরবর্তীতে তাঁরা হাইতি ও ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের দূর্গত স্থান পরিদর্শন করেন ও ভবিষ্যত ত্রাণকার্যক্রম সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেন।[৬৯] একই বছরের আগস্ট মাসে পাকিস্তানের একটি খাদ্য সরবরাহকারী ত্রাণ প্রকল্পে সহায়তার জন্য তিনি জাতিসংঘে ১,০০,০০০ ডলার অনুদান দেন।[৭০] ব্যক্তিগত জীবন[সম্পাদনা] সম্পর্ক[সম্পাদনা] মূল নিবন্ধ: ব্রাঞ্জেলিনা ২৮ মার্চ, ১৯৯৬-এ জোলি হ্যাকারস (১৯৯৫) চলচ্চিত্রে তাঁর সহশিল্পী, ব্রিটিশ অভিনেতা জনি লি মিলারকে বিয়ে করেন। বিয়েতে জোলি রাবারের তৈরি কালো প্যান্ট ও সাদা শার্ট পরিহিত অবস্থায় অংশ নেন, এবং সেখানে তিনি নিজের রক্তে বর, মিলারের নাম লিখেছিলেন।[৭১] জোলি ও মিলার ঐ বছরেই আলাদা বসবাস করতে শুরু করেন এবং ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯-এ তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদের নিষ্পত্তি ছিলো শান্তিপূর্ণ, এবং তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক পরবর্তিতে যথেষ্ট ভালো লক্ষ করা গেছে। এ সম্পর্কে জোলির বিবৃতি, “সময়ের সাথে সাথেই এটি শেষ হয়ে যায়। আমার কাছে সে অত্যন্ত ভালো একজন স্বামী, এবং যেকোনো মেয়েই তাঁকে এভাবে পেতে চাইবে। আমি সবসময়ই তাঁকে ভালোবাসবো। আসলে আমাদের বয়সের ব্যবধানটা ঠিক ছিলো না।”[২৩] পুশিং টিন (১৯৯৯) চলচ্চিত্রে কাজ করার সময় তাঁর পরিচয় হয় মার্কিন অভিনেতা বিলি বব থর্নটনের সাথে, পরবর্তীতে ৫ মে ২০০০ তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের সম্পর্কটি বিনোদনমূলক গণমাধ্যমের একটি অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে।[৭২] কিন্তু ২৭ মে ২০০৩ তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তাঁদের বিয়ের এমন হঠাৎ বিচ্ছেদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে জোলি বলেন, “এটা আশ্চর্যজনক ছিলো আমার কাছেও, কারণ রাতের শেষে আমরা দুজনই পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয় আমাদের মধ্যে মিলে যাবার মতো একরকম কিছুই কোনোদিন ছিলো না। ব্যাপারটা ভয় লাগানোর মতো, কিন্তু... আমার ধারণা এটা আপনি তখনই বুঝবেন যখন এটা আপনার জীবনে ঘটবে, এবং আদৌ আপনি নিজের সম্বন্ধে ভালোভাবে জানবেন না।”[৭৩] ২০০৭ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে জোলি এবং সঙ্গী ব্র্যাড পিট জোলি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, তিনি একজন উভকামী, এবং তিনি এও বলেছেন যে, ফক্সফায়ার চলচ্চিত্রে তাঁর সহঅভিনেত্রী জেনি শিমিজুর সাথে তাঁর যৌনসম্পর্ক ছিলো। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমার স্বামীর সাথে বিবাহিত না থাকলে সম্ভবত আমি তাঁকে বিয়ে-ই করতাম। দ্বিতীয়বার দেখার পরই আমি প্রথমবারের মতো তাঁর প্রেমে পড়ে যাই।”[৭৪] ২০০৩ সালে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি উভকামী কিনা, তখন জোলি বলেন, “অবশ্যই। যদি আমি কালকে এক নারীর প্রেমে পড়ি, তাহলে আমার কি এমন অনুভূতি আসবে যে তাঁকে আমি চুমু খেতে বা স্পর্শ করতে চাই? বা আমি তাঁর প্রেমে পড়ে গেছি? হ্যাঁ! অবশ্যই!”[৭৫] ২০০৫ সালের শুরুর দিকে জোলি একটি বড় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিতর্কটি ছিলো অভিনেতা ব্র্যাড পিট ও অভিনেত্রী জেনিফার অ্যানিস্টনের বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কিত এবং জোলি ছিলেন এই বিচ্ছেদের কারণ। এই বিতর্কটি গণমাধ্যমে ব্যপক প্রচারণা পায়। বিবাহবিচ্ছেদের কারণ ছিলো জোলি ও পিটের প্রেমের শুরু, আর এ প্রেম শুরু হয় মি. এন্ড মিসেস. স্মিথ (২০০৫) চলচ্চিত্রে একসাথে কাজ করার সময় থেকে। জোলি বিভিন্ন সময় এর সত্যতা অস্বীকার করেছিলেন, কিন্তু তিনি এটুকু স্বীকার করেন যে, চলচ্চিত্রটিতে কাজ করার সময় তাঁরা ‘ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন’।[৭৬] ২০০৫-এ এক সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “কোনো বিবাহিত পুরুষের সাথে ভালোবাসায় জড়ানো; যেখানে আমার নিজের বাবা আমার মায়ের সাথে প্রতারণা করেছে—এটা এমন কিছু না যা আমি ক্ষমা করতে পারি। এমনটি করলে আমি চাইবো সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নিজেকে যেন আমি আর না দেখি। আমি এমন কোনো পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হবো না, যে কিনা তাঁর স্ত্রীর সাথে প্রতারণা করে।”[৭৫] জোলি ও পিট গণমাধ্যমের কাছে কখনো তাঁদের সম্পর্কের প্রকৃতি বা বিশেষত্ব নিয়ে কোনো মন্তব্য করেন না। ২০০৫ সাল থেকে তাঁরা একসঙ্গে বসবাস করছেন। পাপারাৎসিদের তোলা তাঁদের প্রথম প্রকাশ্যে একসাথে সময় কাটানোর আলোকচিত্রটি প্রকাশ পায় ২০০৫-এর এপ্রিলে, জেনিফার অ্যানিস্টন তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজপত্র জমা দেওয়ার এক মাস পর। ছবিটি তোলা হয়েছিলো কেনিয়ার একটি সমুদ্রসৈকতে, এবং সেখানে জোলি, পিট, ও তাঁদের সন্তান ম্যাডক্সকে একসাথে দেখা যায়। ঐ বছরেরই গ্রীষ্মকালে জোলি ও পিটকে প্রকাশ্যে বিভিন্ন স্থানে দেখা যাবার হার বাড়তে থাকে, এবং গণমাধ্যমও তাঁদেরকে একটি জুড়ি হিসেবে পরিচয় করাতে থাকে। তাঁদের নাম একত্রিত করে এই সম্পর্কের নাম দেওয়া হয় ‘ব্রাঞ্জেলিনা’। অবশেষে ১১ জানুয়ারি ২০০৬-এ পিপল ম্যাগাজিনকে তিনি জানান যে, তিনি পিটের সন্তানের মা হতে যাচ্ছেন, এবং সেখানেই তিনি প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের কাছে তাঁদের সম্পর্ক থাকার ব্যাপারটা নিশ্চিত করেন।[৭২] একসাথে থাকার প্রায় সাত বছর পর ২০১২তে তারা তাদের বাগদানের কথা ঘোষণা করেন,[৭৭] এবং ২৩শে আগস্ট, ২০১৪তে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[৪] ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, জোলি ও পিট যুক্তরাজ্যের ট্যাবলয়েড নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড-এর বিরুদ্ধে তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে যাবার মিথ্যে প্রতিবেদন প্রকাশের অভিযোগে মামলা করেন।[৭৮] পরবর্তীতে ঐ বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে সিএনএন-এর সঞ্জয় গুপ্তকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জোলি বলেন যে, একমাত্র ব্র্যাড পিটের সাথেই তিনি ভালোভাবে কথা বলতে পারেন।[৭৯] স্তন ক্যান্সার এর হাত থেকে রক্ষা পেতে ২০১৩ সাল তিনি তার দুইটি স্তন অপসারন করান। সন্তানাদি[সম্পাদনা] জোলির সন্তানাদি ম্যাডক্স শিভান জোলি-পিট (জন্ম: ৫ আগস্ট ২০০১; কম্বোডিয়া। দত্তকগ্রহণ: ১০ মার্চ ২০০২) প্যাক্স থিয়েন জোলি-পিট (জন্ম: ২৯ নভেম্বর ২০০৩; ভিয়েতনাম। দত্তকগ্রহণ: ১৫ মার্চ ২০০৭) জাহারা মার্লে জোলি-পিট (জন্ম: ৮ জানুয়ারি ২০০৫; ইথিওপিয়া; দত্তকগ্রহণ: ৬ জুলাই ২০০৬) শিলোহ নোভেল জোলি-পিট (জন্ম: ২৭ মে ২০০৬; সোকপমুন্ড, নামিবিয়া) নক্স লিওন জোলি-পিট (জন্ম: ১২ জুলাই ২০০৮; নিস, ফ্রান্স) ভিভিয়েন মার্শেলিন জোলি-পিট (জন্ম: ১২ জুলাই ২০০৮; নিস, ফ্রান্স) জোলি, ১০ মার্চ ২০০২-এ সাত মাস বয়সী ম্যাডক্স শিভানকে দত্তক নেন।[১৫] ম্যাডক্সের জন্ম হয়েছিলো ২০০১ সালে ৫ আগস্ট কম্বোডিয়ার র‌্যাথ ভিবোল-এ, এবং সে প্রথম থেকেই ব্যাটামব্যাঙ্গের একটি স্থানীয় এতিমখানায় বাস করতো। টুম্ব রেইডার চলচ্চিত্রের দৃশ্যধারণ ও ২০০১ সালে ইউএনএইচসিআর-এর মাঠপর্যায়ের কাজ, এই দুই কারণে দুই বার কম্বোডিয়া ভ্রমণের পর জোলি দত্তক গ্রহণের জন্য দরখাস্ত করবেন বলে মনস্থ করেন। দ্বিতীয় স্বামী বিলি বব থর্নটনের সাথে বিচ্ছেদের পর জোলি ম্যাডক্সের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব লাভ করেন। জোলির অন্যান্য সন্তানদের মতোই ম্যাডক্স নিজেও একজন সেলিব্রেটি, এবং প্রায়ই তাঁর সংক্রান্ত খবরাখবর বিভিন্ন ক্রোড়পত্রে স্থান পায়।[৮০] ছয়মাস বয়সী জাহারা মার্লেকে জোলি দত্তক নেন ৬ জুলাই ২০০৫। তার জন্ম হয়েছিলো ৮ জানুয়ারি ২০০৫। জাহারার পূর্ব নাম ছিলো ‘ইয়েম্সর‌্যাচ’, যা তাঁর জন্মদাত্রী মায়ের রাখা,[৮১] কিন্তু এতিমাখানায় এসে তাঁর বৈধ নাম হয় টিনা আদম।[৮২] আদ্দিস আবাবার ওয়াইড হরাইজন্স ফর চিলড্রেন এতিমখানা থেকে জোলি তাঁকে দত্তক নেন। ২০০৭ সালে, তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে সে অপুষ্টি ও পানিশূণ্যতায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরবর্তীতে মিডিয়ায় খবর প্রচারিত হয় যে, জাহারার জন্মদাত্রী মা মেন্টেওয়ারিব ডোয়াইট এখনো জীবিত, এবং তিনি তাঁর মেয়েকে নিজের কাছে ফিরে পেতে চান। অবশ্য জোলি এই খবর অস্বীকার করে বলেন, জাহারার ‘খুবই সৌভাগ্য’ যে, সে জোলির কাছে দত্তক হয়ে এসেছে।[৮১] ব্র্যাড পিট জাহারাকে দত্তক নেওয়ার আইনগত কাজ সমাধা করার সময় জোলির সাথে ছিলেন;[৭২] পরে জোলি সংবাদমাধ্যমকে জানান যে, জোলি ও পিট সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা দুজনে মিলেই জাহারাকে দত্তক নেবেন।[৮৩] ১৯ জানুয়ারি ২০০৬-এ পিটের আবেদনের প্রেক্ষিতে ক্যালিফোর্নিয়ায় একজন বিচারক আইনগতভাবে জোলির দুই সন্তানকে দত্তক নেওয়ার জন্য পিটের আবেদন মঞ্জুর করেন। তখন থেকেই তাঁদের নামের শেষাংশ ‘জোলি-পিট’-এ পরিবর্তিত হয়।[৮৪] ২৭ মে ২০০৬-এ নামিবিয়ার সোকপমুন্ডে সিজারিয়ানের মাধ্যমে জোলির মেয়ে শিলোহ নোভেলের জন্ম হয়। জোলি ও পিটের সদ্যজন্মজাত কন্যা যে নামিবিয়ার নাগরিকত্বধারী, গণমাধ্যমের কাছে পিট তা নিশ্চিত করেন।[৮৫] যেহেতু শিলোহের প্রথম ছবিটি গণমাধ্যমের কাছে যথেষ্ট মূল্যবান, তাই পাপারাৎসিদের কাছে চলে যাবার আগেই জোলি তাঁর মেয়ের প্রথম ছবিটি পরিবেশক প্রতিষ্ঠান গেটি ইমেজেসের মাধ্যমে গণমাধ্যমে বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে ছবিটির উত্তর আমেরিকা স্বত্ত্বের জন্য পিপল ম্যাগাজিন ৪১ লক্ষ মার্কিন ডলার, এবং ব্রিটিশ ম্যাগাজিন হ্যালো! বিশ্বব্যাপী স্বত্ত্বের জন্য প্রায় ৩৫ লক্ষ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করে।[৮৬][৮৭] ছবিটির মাধ্যমে প্রাপ্ত এ বিপুল অর্থ জোলি-পিট দম্পতি একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে দেন।[৮৮] ২০০৭-এর ১৫ মার্চ জোলি ভিয়েতনাম থেকে তিন বছর বয়সী প্যাক্স থিয়েনকে দত্তক নেন।[৮৯] তাঁর জন্ম হয়েছিলো ২৯ নভেম্বর ২০০৩-এ, এবং স্থানীয় একটি হাসপাতালে, যেখানে তাঁর প্রথমে নামকরণ করা হয় ফ্যাম ক্যাং স্যাং।[৯০] হো চি মিন সিটির ট্যাম বিন এতিমখানা থেকে জোলি তাঁকে দত্তক নেন।[৯১] জোলি ছেলেটির নামের প্রথম অংশ রাখেন ‘প্যাক্স’, কারণ মৃত্যুর পূর্বে প্যাক্সের মা এই নামটি রাখার অনুরোধ করে গিয়েছিলেন।[৯২] ট্যাবলয়েডগুলোতে বেশ কয়েক মাসের গুজবের পর ২০০৮ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে জোলি নিশ্চিত করেন যে, সবকিছু ঠিক থাকলে তিনি এবার একটি যমজ সন্তানের জন্ম দিতে যাচ্ছেন। অবশেষে ১২ জুলাই ২০০৮-এ ফ্রান্সের নিসের লেনভাল হাসপাতালে তিনি নক্স লিওন নামে এক পুত্র ও ভিভিয়েন মার্শেলিন নামে এক কন্যার জন্ম দেন।[৯৩] যৌথভাবে পিপল ও হ্যালো! ম্যাগাজিনের কাছে বিক্রি করা এই যমজের প্রথম ছবিটির মূল্যমান ছিলো ১ কোটি ৪০ লক্ষ মার্কিন ডলার—এখন পর্যন্ত (ডিসেম্বর ২০০৯) তারকাদের ছবির মধ্যে সবচেয়ে দামী। এখানেও বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ দাতব্য সংগঠন জোলি-পিট ফাউন্ডেশনে দান করে দেওয়া হয়।[৯৪] গণমাধ্যমে উপস্থিতি[সম্পাদনা] ২০০৫ সালে ওয়াশিংটন, ডি.সি.-তে জোলি অল্প বয়স থেকেই জোলিকে তাঁর বিখ্যাত বাবা ভটের বদৌলতে গণমাধ্যমে দেখা যেতো। সাত বছর বয়সে জোলি যে লুকিন’ টু গেট আউট চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন তাঁর সহ-চিত্রনাট্যকার ও মূল অভিনেতা ছিলেন তাঁর বাবা। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে, তাঁর কিশোরী বয়সেই দুইবার তাঁর বাবার সাথে একাডেমি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। যদিও যখন জোলি তাঁর অভিনয় জীবন শুরু করেন, তখন মঞ্চে তিনি ‘ভট’ নামটি ব্যবহার করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন, কারণ তিনি অভিনেত্রী হিসেবে নিজের পরিচয় নিজেই তৈরি করতে চেয়েছিলেন।[৭২] তাঁর পেশাজীবনের প্রথম বছরেও কিশোরী বয়সে তাঁর ‘পাহাড়ে মেয়ে’ ধরণের ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নিয়ে বা এবিষয়ে কথা বলতে তিনি কখনো অপ্রস্তুত বা লজ্জাবোধ করেননি। ২০০০ সালে একাডেমি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে এক বক্তব্যে জোলি ঘোষণা দেন, “আমি বর্তমানে আমার ভাইয়ের প্রেমে মজে আছি”, সেই সাথে সেই রাতে তাঁর ভাইয়ের প্রতি তাঁর খুব মত্ততার মতো আচরণ প্রকাশ পায়। এর প্রেক্ষিতে গণমাধ্যমগুলো জোলির ভাই জেমস হ্যাভেনের সাথে জোলির অজাচারমূলক সম্পর্ক আছে বলে প্রচার শুরু করে। জোলি দৃঢ়তার সাথে এই গুজবকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরে জোলি ও জোলির ভাই এক যৌথ সাক্ষাৎকারে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, তাঁদের মা-বাবার বিচ্ছেদের পর তাঁরা একজন অপরজনের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, কিন্তু তা ছিলো মানসিক; জোলি সেই অর্থেই কথাটি বলেছিলেন।[৭২] পেশাজীবনের শুরু থেকেই জোলির কোনো মুখপাত্র বা এজেন্ট নেই।[৯৫] নিজের জীবন সম্পর্কে খোলামেলাভাবে বিভিন্ন রকমের আলোচনা করা, সাক্ষাৎকার দেওয়া, এমনকি বিডিএসএম-এর প্রতি তাঁর আগ্রহ ব্যক্ত করা[৯৬]–এসব তাঁকে খুব দ্রুত গণমাধ্যমের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। একবার তিনি দাবি করেছিলেন যে, “তিনি তাঁর এক নারী ভক্তের সাথে যৌনসম্পর্ক করতে চান”।[৭৫] সেই সাথে সবাইকে জানিয়ে বিলি বব থর্নটনকে বিয়ে করা, মানবতার প্রচার ও বিশ্বব্যাপী মানবতার সপক্ষে কথা বলার জন্য তিনি বেশ কয়েকবার পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। ইউএনএইচসিআর-এর একজন শুভেচ্ছাদূত হিসেবে মর্যাদা পাবার পর তিনি তাঁর তারকা ব্যক্তিত্বকে বিশ্বব্যাপী মানুষকে মানবতার সপক্ষে কাজ করার প্রচারে ব্যবহার করা শুরু করেন। ২০০৪ সাল থেকে জোলি উড়োজাহাজ চালনা শিক্ষা করা শুরু করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ চালানোর লাইসেন্স আছে (ইন্সট্রুমেন্টাল রেটিংসহ), এবং তিনি একটি সাইরাস এসআর২২ উড়োজাহাজের মালিক।[৯৭] গণমাধ্যমে প্রায়ই বলা হয় যে, তিনি বৌদ্ধধর্মের অনুসারী, কিন্তু তিনি বলেছেন, তিনি তাঁর ছেলেকে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা দিয়েছেন, কারণ তিনি মনে করেন এটা তাঁর সংস্কৃতির একটি অংশ। জোলি আসলেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কী না, তা তিনি স্পষ্ট করেননি। ২০০০ সালে তাঁকে যখন এবিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন তিনি বলেন, “আমি মনে করি, এটি সেসমস্ত মানুষের জন্য যাঁরা এটিতে বিশ্বাস করে। আমার জন্য কোনো ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই।”[৯৮] ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ ৮১তম একাডেমি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে জোলি ও ব্র্যাড পিট ২০০৫-এ শুরু হওয়া হলিউড অভিনেতা ব্র্যাড পিটের সাথে তাঁর সম্পর্ক এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি তারকাসংক্রান্ত খবরাখবরের উৎস। ২০০৬ সালের শুরুতে জোলি যখন তাঁর গর্ভধারণের খবর প্রকাশ করেন, তখন গণমাধ্যম তাঁদেরকে নিয়ে বিভিন্নভাবে অতিশয়োক্তি করা শুরু করে। দ্য ব্রাঞ্জেলিনা ফিভার’ নিবন্ধে রয়টার্স যেমন বর্ণনা করেছে ‘পাগলামির চূড়া স্পর্শ’ বলে।[৯৯] গণমাধ্যমের মনোযোগ থেকে দূরে থাকতে শিলোহের জন্মদানের জন্য এই জুটি নামিবিয়াকে বেছে নেন। শিলোহ-কে বর্ণনা করা হয় ‘যিশুখ্রিস্টের পর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত শিশু হিসেবে’।[১০০] দুই বছর পর জোলির দ্বিতীয় গর্ভধারণের খবর গণমাধ্যমে আবারো ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত করে। ফ্রান্সের নিসের সমুদ্রতীরবর্তি যে হাসপাতালে জোলি দুই সপ্তাহ অবস্থান করেছেন, হাসপাতালের বাইরে সেই দুই সপ্তাহ সাংবাদিকরা রীতিমতো তাঁবু খাটিয়ে বাচ্চার জন্মের খবর নেবার জন্য অপেক্ষা করেছেন।[১০১] বর্তমানে জোলি, বিশ্বের অন্যতম পরিচিত একজন তারকা ব্যক্তিত্ব। কিউ স্কোরের ভাষ্যমতে ২০০০ সালে অস্কার জয়ের পর জোলি পরিচিত ছিলেন ৩১% আমেরিকানের কাছে; পরবর্তীতে ২০০৬ সালে এসে দেখা যায় ৮১% আমেরিকানের কাছে জোলি এক পরিচিত মুখ।[৫৫] ২০০৬ সালে এসিনিলসেন পরিচালিত বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্রশিল্পের এক জরিপে দেখা যায়, ৪২টি আন্তর্জাতিক বাজারে জোলি-পিট জুটি বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও পণ্যের প্রচারের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় এন্ডোর্সার।[১০২] ২০০৬ ও ২০০৮ সালে জোলি টাইম ১০০-এ বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের তালিকায় ছিলেন।[১০৩][১০৪] ২০০৬ সালে পিপল-এর ‘ওয়ান হানড্রেড মোস্ট বিউটিফুল’ সংখ্যায় তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর নারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।[১] ২০০৭-এ ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল ফোরের টেলিভিশন অনুষ্ঠান দ্য ওয়ান হান্ড্রেড গ্রেটেস্ট সেক্স সিম্বল্‌স-এ তিনি সর্বকালের সেরা সেক্স সিম্বল নির্বাচিত হন।[১০৫] দ্য হলিউড রিপোর্টার জোলিকে ২০০৮ সালের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক গ্রহণকারী অভিনেত্রী হিসেবে উল্লেখ করে; প্রতি ছবিতে তাঁর আয় ছিলো ১.৫ কোটি মার্কিন ডলার।[১০৬] সেই সাথে তিনি ২০০৯ সালের ফোর্বস -এর বার্ষিক সেলিব্রেটি ওয়ান হানড্রেড-এ শীর্ষস্থানে ছিলেন। ২০০৭ ও ২০০৮-এ এই তালিকায় তাঁর অবস্থান ছিলো যথাক্রমে ১৪[১০৭] এবং ৩[১০৮]। জুন ২০০৭-এ নিউ ইয়র্ক সিটিতে জোলি; শরীরে থাকা বিভিন্ন রকমের উল্কি দৃশ্যমান। জোলি তাঁর বাহ্যিক সৌন্দর্যের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মিডিয়া কভারেজ পেয়েছেন। তাঁর শরীরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য দিক, তাঁর ঠোঁটজোড়া গণমাধ্যমে ব্যাপক মনোযোগের কারণ। যেসকল নারী কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে তাঁদের ঠোঁটের পরিবর্তন ঘটাতে চান তাঁদের ক্ষেত্রে এটাকে তিনি ‘পশ্চিমের সৌন্দর্য্যের বর্তমান স্বর্ণমানদন্ড’ হিসেবে বর্ণনা করেন।[১০৯] বিভিন্ন মিডিয়া ম্যাগাজিন ও সাময়িকীর পরিচালিত ভোটে একাধিকবার তিনি বিশ্বের ‘সবচেয়ে সুন্দরী’ বা ‘সেক্সি’ নারী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে, ২০০২ সালে ভোগ,[১১০] ২০০৪ সালে এসকোয়ার,[১১১] ২০০৫-এ আমেরিকান এফএইচএম ও ব্রিটিশ হার্পার’স বাজার,[১১২][১১৩] ২০০৬-এ পিপল ও হ্যালো!,[১][১১৪] ২০০৭-এ এম্পায়ার,[১১৫] এবং ২০০৯ সালে ভ্যানিটি ফেয়ার।[১১৬] জোলির শরীরে থাকা বিভিন্ন রকমের উল্কি প্রায়ই গণমাধ্যমের মনোযোগের কারণ এবং সাক্ষাৎকারপ্রার্থীদের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। জোলি এসম্পর্কে বলেন যে, তিনি চলচ্চিত্রে নগ্নতার বিপক্ষে নন, তাঁর শরীরে থাকা অনেক রকমের এই উল্কিগুলো কোনো নগ্ন বা ভালোবাসার দৃশ্যধারণের সময় নির্মাতাকে আরও বেশি সৃষ্টিশীল করে তোলে।[১১৭] তাঁর অনেক চলচ্চিত্রেই উল্কি আড়াল করার জন্য বাড়তি রূপসজ্জার প্রয়োজন হয়েছে। এখন পর্যন্ত জানামতে জোলির শরীরে তেরোটি উল্কি রয়েছে। তাঁর শরীরে থাকা বিভিন্নরকম উল্কির মধ্যে আছে, উদ্ধৃতিমূলক, ভূ-স্থানাঙ্কমূলক, চিত্রমূলক প্রভৃতি উল্কি। উদ্ধৃতিমূলকের মধ্যে রয়েছে, মার্কিন নাট্যকার টেনেসি উলিয়ামসের রচিত উদ্ধৃতি—“A prayer for the wild at heart, kept in cages” (হৃদয়ের বন্যতার প্রার্থনা, খাচায় বদ্ধ থাকে)। এই উদ্ধৃতিটি তিনি পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের সাথে একত্রে একটি আরবি শব্দগুচ্ছের সাথে; শব্দগুচ্ছটি ছিলো: ‘العزيمة’ (করার স্পৃহা)। এছাড়া আছে ল্যাটিন প্রবাদ “quod me nutrit me destruit” (যা আমাকে লালন করে, তাই আমাকে ধ্বংস করে),[১১৮] এবং তাঁর ছেলে ম্যাডক্স-এর জন্য একটি ইয়ান্ত্রা প্রার্থনা যা লেখা হয়েছে প্রাচীণ খ্‌মের লিপিতে।[১১৯] এছাড়া তাঁর বাম হাতের উপরে ছয়টি ভৌগোলিক স্থানাঙ্কের উল্লেখ আছে, যা নির্দেশ করছে তাঁর ছয় সন্তানের জন্মস্থান।[১২০] সময়ের সাথে সাথে তিনি তাঁর অনেক উল্কি ঢেকে বা মুছে ফেলেছেন। এর মধ্যে আছে তাঁর সাবেক স্বামী বিলি বব থর্নটনের ‘Billy Bob’ (বিলি বব) নামাঙ্কিত উল্কিটি। আরও আছে মৃত্যু প্রকাশক চৈনিক অক্ষর (死), এবং তাঁর পেছন দিকে আঁকা একটি জানালার উল্কি। এই জানালার উল্কিটি মুছে ফেলার কারণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, একসময় বাইরে বেরোনোর আকাঙ্ক্ষায় তিনি তাঁর সম্পূর্ণ সময়টি জানালার ধারে বসে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে আজ তিনি প্রায় পুরো সময়টা বাইরেই কাটাচ্ছেন।[২৪] চলচ্চিত্র তালিকা[সম্পাদনা] অভিনেত্রী হিসেবে[সম্পাদনা] বছর চলচ্চিত্র চরিত্রের নাম টীকা ১৯৮২ লুকিন’ টু গেট আউট টোশ ১৯৯৩ অ্যাঞ্জেলা এন্ড ভিরিলি অ্যাঞ্জেলা ২ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অ্যালিস এন্ড ভিরিলি অ্যালিস ২ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সাইবর্গ ২ ক্যাসেলা ‘ক্যাশ’ রীজ ১৯৯৫ উইদাউট এভিডেন্স জোডি সোয়ারিনজেন হ্যাকারস কেট ‘এসিড বার্ন’ লিবি ১৯৯৬ মোজাভে মুন এলিয়ানর ‘এলি’ রিগবি লাভ ইজ অল দেয়ার ইজ জিনা মালাসিসি ফক্স ফায়ার মার্গারেট ‘লেগস’ স্যাডোভস্কি ১৯৯৭ ট্রু উইমেন জর্জিয়া ভার্জিনিয়া লশি উডস জর্জ ওয়ালেস কর্নেলিয়া ওয়ালেস গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার (সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী - ধারবাহিক, মিনি ধারাবাহিক, বা টেলিচলচ্চিত্র) মনোনীত — প্রাইমটাইম এমি পুরস্কার (সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী - মিনি ধারাবাহিক বা চলচ্চিত্র) প্লেয়িং গড ক্লেয়ার ১৯৯৮ জিয়া জিয়া মারি কারাঞ্জি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী - ধারবাহিক, মিনি ধারাবাহিক, বা টেলিচলচ্চিত্র) স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী - মিনি ধারাবাহিক, বা টেলিচলচ্চিত্র) মনোনীত — প্রাইমটাইম এমি পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী - মিনি ধারাবাহিক বা চলচ্চিত্র) হেল’স কিচেন গ্লোরিয়া ম্যাকনিয়ারি প্লেইং বাই হার্ট জোয়ান ন্যাশনাল বোর্ড অফ রিভিউ পুরস্কার - সাফল্যমণ্ডিত অভিনেত্রী পুশিং টিন ম্যারি বেল ১৯৯৯ দ্য বোন কালেক্টর অ্যামেলিয়া ডোনাঘি গার্ল, ইন্টারাপ্টেড লিসা রো একাডেমি পুরস্কার (সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী) ব্রডকাস্ট ফিল্ম ক্রিটিক্‌স অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার (সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী) গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার (সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী - চলচ্চিত্র) স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কার (সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী - চলচ্চিত্র) মনোনীত — শিকাগো ফিল্মস ক্রিটিক্‌স অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) ২০০০ গন ইন সিক্সটি সেকেন্ডস সারা ‘সোয়ে’ ওয়েল্যান্ড ২০০১ লারা ক্রফ্‌ট: টুম্ব রেইডার লারা ক্রফ্‌ট মনোনীত — এমটিভি মুভি পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — এমটিভি মুভি পুরস্কার (সেরা যুদ্ধকৌশল) অরিজিনাল সিন জুলিয়া রাসেল ২০০২ লাইফ অর সামথিং লাইক ইট লেনি কেরিগ্যান ২০০৩ লারা ক্রফ্‌ট টুম্ব রেইডার: দ্য ক্রেডেল অফ লাইফ লারা ক্রফ্‌ট বিয়ন্ড বর্ডারস সারাহ জর্ডান ২০০৪ টেকিং লাইভস ইলিয়ানা স্কট শার্ক টেল লোলা কণ্ঠদান স্কাই ক্যাপ্টেন এন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অফ টুমরো ফ্রান্সেসকা ‘ফ্র্যাঙ্কি’ কুক পিপল’স চয়েজ পুরস্কার – জনপ্রিয় নারী অ্যাকশন তারকা দ্য ফিভার একজন বিপ্লবী অতিথি উপস্থিতি আলেকজান্ডার অলিম্পাস ২০০৫ মি. এন্ড মিসেস. স্মিথ জেন স্মিথ এমটিভি মুভি পুরস্কার (সেরা যুদ্ধকৌশল) মনোনীত — এমটিভি মুভি পুরস্কার (সেরা চুম্বন) মনোনীত — পিপল’স চয়েজ পুরস্কার – জনপ্রিয় নারী চলচ্চিত্র তারকা মনোনীত — পিপল’স চয়েজ পুরস্কার – জনপ্রিয় নারী অ্যাকশন তারকা মনোনীত — পিপল’স চয়েজ পুরস্কার – জনপ্রিয় পর্দার জুটি (ব্র্যাড পিটের সঙ্গে একত্রে) ২০০৬ দ্য গুড শেপার্ড মার্গারেট রাসেল ২০০৭ আ মাইটি হার্ট মারিয়ান পার্ল মনোনীত — ব্রডকাস্ট ফিল্ম ক্রিটিক্‌স অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — শিকাগো ফিল্ম ক্রিটিক্‌স অ্যাসোসিয়েশন (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী - নাট্য চলচ্চিত্র) মনোনীত — ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্পিরিট পুরস্কার (সেরা মূল নায়িকা) মনোনীত — লন্ডন ফিল্ম ক্রিটিক্‌স সার্কল পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — অনলাইন ফিল্ম ক্রিটিক্‌স পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী - চলচ্চিত্র) বেউল্‌ফ গ্রেন্ডালের মা মনোনীত — এমটিভি মুভি পুরস্কার (সেরা খলনায়ক) ২০০৮ কুং ফু পান্ডা মাস্টার টিগ্রেস কণ্ঠদান ওয়ান্টেড ফক্স পিপল’স চয়েজ পুরস্কার – জনপ্রিয় নারী অ্যাকশন তারকা মনোনীত — পিপল’স চয়েজ পুরস্কার – জনপ্রিয় নারী চলচ্চিত্র তারকা মনোনীত — এমটিভি মুভি পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — এমটিভি মুভি পুরস্কার (সেরা চুম্বন) মনোনীত — এমটিভি মুভি পুরস্কার (সেরা ডব্লিউটিএফ মুহুর্ত) চেঞ্জলিং ক্রিস্টিন কলিন্স স্যাটার্ন পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — একাডেমি পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — বাফটা পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — ব্রডকাস্ট ফিল্ম ক্রিটিক্‌স অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — শিকাগো ফিল্ম ক্রিটিক্‌স অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী - নাট্য চলচ্চিত্র) মনোনীত — লন্ডন ফিল্ম ক্রিটিক্‌স সার্কল পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) মনোনীত — স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী - চলচ্চিত্র) ২০১০ সল্ট এভেলিন সল্ট মনোনীত — পিপল’স চয়েজ পুরস্কার – জনপ্রিয় অ্যাকশন তারকা মনোনীত — পিপল’স চয়েজ পুরস্কার – জনপ্রিয় নারী চলচ্চিত্র তারকা মনোনীত — স্যাটার্ন পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী) দ্য ট্যুরিস্ট এলিস ক্লিফটন-ওয়ার্ড মনোনীত — গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার (সেরা অভিনেত্রী - কমেডি বা সঙ্গীতধর্মী চলচ্চিত্র) ২০১১ কুং ফু পান্ডা ২ মাস্টার টিগ্রেস কণ্ঠ অভিনেত্রী ২০১৪ ম্যালেফিসেন্ট ম্যালেফিসেন্ট ২০১৫ কুং ফু পান্ডা ৩ মাস্টার টিগ্রেস কণ্ঠ অভিনেত্রী %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 বাংলাদেশ উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বাংলাদেশ পতাকা জাতীয় প্রতীক জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা মেনু0:00 বাংলাদেশ সরকারের সিলমোহর বাংলাদেশ সরকার ও মন্ত্রণালয়সমূহের সীল রাজধানী (ও বৃহত্তম নগরী) ঢাকা রাষ্ট্রীয় ভাষাসমূহ বাংলা স্বীকৃত জাতীয় ভাষাসমূহ বাংলা জাতিগত গোষ্ঠী ৯৮% বাঙালি ২% অন্য জাতীয়তাসূচক বিশেষণ বাংলাদেশী সরকার সংসদীয় গণতন্ত্র - রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ - প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইন-সভা জাতীয় সংসদ স্বাধীনতা পাকিস্তান থেকে - স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ ১৯৭১ - বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আয়তন - মোট ১৪৭,৫৭০ বর্গকিমি (৯৪তম) ৫৫,৫৯৯ বর্গমাইল - জলভাগ (%) ৭.০ জনসংখ্যা - ২০১৪ আনুমানিক ১৫৬,৪৯৯,৬৭৩ (জুন ২০১৪)[১] (৭ম) - ২০১১ আদমশুমারি ১৪২,৩১৯,০০০ - ঘনত্ব ১০৯৯ /বর্গ কিমি (৫ম) ২৯১৮ /বর্গমাইল জিডিপি (পিপিপি) ২০০৯ আনুমানিক - মোট $২৪২.১৮ বিলিয়ন[২] (৪৫তম) - মাথাপিছু $১,৪৭০.৩৮ (১৫২তম) জিনি (২০০৫) ৩৩.২[৩] (মধ্যম) মানব উন্নয়ন সূচক (২০১৪) বৃদ্ধি ০.৫৫৮ (মধ্যম) (১৪২তম) মুদ্রা ৳ (টাকা) (BDT) সময় স্থান বাংলাদেশ মান সময় (ইউটিসি+৬) তারিখ বিন্যাস বঙ্গাব্দ দদ-মম-বববব খ্রিস্টাব্দ dd-mm-yyyy ট্রাফিকের দিক বাম ইন্টারনেট টিএলডি .বাংলা .bd ওয়েবসাইট জাতীয় বাতায়ন কলিং কোড +৮৮০ বাংলাদেশ (এই শব্দ সম্পর্কে শুনুন (সাহায্য·তথ্য)) দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনবহুল রাষ্ট্র। বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব সীমান্তে ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মায়ানমার অবস্থিত। এছাড়াও দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। বাংলাদেশের ভূখন্ড ভৌগলিকভাবে একটি উর্বর বদ্বীপের অংশ বিশেষ। বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় দীর্ঘ সময় ধরে বাঙালি জাতি বাস করছে। এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ট অধিবাসীদের মাতৃভাষাবাংলা ভাষা। প্রাচীন "বঙ্গ" ভূন্ডের পূর্বাংশের অংশ পূর্ব বাংলা নামে পরিচিত, যা বর্তমানে বাংলাদেশ নামের দেশ। পৃথিবীতে যে ক'টি রাষ্ট্র জাতিরাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পায় তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের বর্তমান সীমান্ত তৈরি হয়েছিল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাবসানে, বঙ্গ (বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি) এবং ব্রিটিশ ভারত বিভাগ করা হয়েছিল। বিভাগের পরে বর্তমান বাংলাদেশের অঞ্চল তখন পূর্ব বাংলা নামে পরিচিত, যেটি নবগঠিত দেশ পাকিস্তানের পূর্ব অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। পাকিস্তান অধিরাজ্যে থাকারকালীন "পূর্ব বাংলা" থেকে "পূর্ব পাকিস্তান"-এ নামটি পরিবর্তিত করা হয়েছিল। শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ঘটেছে দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ; এছাড়াও প্রলম্বিত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও পুনঃপৌনিক সামরিক অভ্যুত্থান এদেশের রাজনৈতিক সামগ্রিক স্থিতিশীলতা বারংবার ব্যাহত করেছে। গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার ধারাবাহিকতা অদ্যাবধি বর্তমান। সকল প্রতিকূলতা সত্বেও গত দুই দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিক প্রগতি ও সমৃদ্ধি সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম যদিও আয়তনের হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৪তম; ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর নবম। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলেরও কম এই ক্ষুদ্রায়তন দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৫.৫৯ কোটির বেশী অর্থাৎ প্রতি বর্গমাইলে জনবসতি ২৪৯৭ জন। [৪] জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা; শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ ছিল ১১,৯৮,৯২৩ কোটি টাকা (চলতি বাজারমূল্যে) যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বৃদ্ধি লাভ করে ১৩,৫০,৯২০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে জনগণের মাথাপিছু বার্ষিক আয় পূর্ববর্তী বৎসরের ১,০৪৪ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১,১৯০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে মর্মে সরকারী প্রাক্কলন করা হয়েছে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৯২,৫১০ টাকা।[৫] দারিদ্রের হার ২৬.২০ শতাংশ, অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১১.৯০ শতাংশ, এবং বার্ষিক দারিদ্র হ্রাসের হার ১.৫ শতাংশ। এই উন্নয়নশীল দেশটি প্রায় দুই দশক যাবৎ বার্ষিক ৫ থেকে ৬.২ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অর্জনপূর্বক "পরবর্তী একাদশ" অর্থনীতিসমূহের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য শহরের পরিবর্ধন বাংলাদেশের এই উন্নতির চালিকাশক্তিরূপে কাজ করছে। এর কেন্দ্রবিন্দুতে কাজ করেছে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ত্বরিৎ বিকাশ এবং একটি সক্ষম ও সক্রিয় উদ্যোক্তা শ্রেণীর আর্বিভাব। বাংলাদেশের রপ্তানীমুখী পোশাক শিল্প সারা বিশ্বে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। জনশক্তি রপ্তানীও দেশটির অন্যতম অর্থনৈতিক হাতিয়ার। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের উর্বর অববাহিকায় অবস্থিত এই দেশটিতে প্রায় প্রতি বছর মৌসুমী বন্যা হয়; আর ঘূর্ণিঝড়ও খুব সাধারণ ঘটনা। নিম্ন আয়ের এই দেশটির প্রধান সমস্যা পরিব্যাপ্ত দারিদ্র গত দুই দশকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এসেছে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে দ্রুত, জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অর্জিত হয়েছে অভূতপূর্ব সফলতা। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানব সম্পদ উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।[৬], তবে বাংলাদেশে এখনো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে যার মধ্যে রয়েছে পরিব্যাপ্ত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি, বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে তলিয়ে যাবার শঙ্কা। এছাড়া একটি সর্বগ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থার রূপ নিয়ে নতুন ভাবে সামাজিক বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা ও বিমসটেক-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এছাড়া দেশটি জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্ব শুল্ক সংস্থা, কমনওয়েলথ অফ নেশনস, উন্নয়নশীল ৮টি দেশ, জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন, ওআইসি, ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংঘের সক্রিয় সদস্য। পরিচ্ছেদসমূহ [আড়ালে রাখো] ১ ইতিহাস ২ সরকার ব্যবস্থা ৩ পররাষ্ট্র নীতি ৪ সামরিক খাত ৫ প্রশাসনিক বিভাজন ৫.১ প্রধান শহরাঞ্চল ৬ ভূগোল ও জলবায়ু ৬.১ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ৭ জনসংখ্যার উপাত্ত ৮ অর্থনীতি ৮.১ মুদ্রাব্যবস্থা ৯ শিক্ষা ১০ যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ১১ পর্যটন খাত ১২ স্বাস্থ্য খাত ১৩ সংস্কৃতি ১৪ খেলাধূলা ১৫ তথ্যসূত্র ১৬ বহিঃসংযোগ ১৬.১ সরকার ও প্রশাসন সম্বন্ধীয় ১৬.২ অন্যান্য ইতিহাস মূল নিবন্ধগুলি: বাংলাদেশের ইতিহাস এবং বাংলার ইতিহাস নওগাঁর পাহাড়পুরের প্রাচীন বৌদ্ধপীঠের ধ্বংসস্তুপ একাদশ শতাব্দীর বুদ্ধ মূর্তি আহসান মঞ্জিল ঢাকা নবাব পরিবারেরআদি বাসস্থান। লালবাগের কেল্লা,মোঘল আমলে স্থাপিত এই দুর্গ ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। ধারণা করা হয় দ্রাবিড় ও তিব্বতীয়-বর্মী জনগোষ্ঠী এখানে সেসময় বসতি স্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে এই অঞ্চলটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয় এবং স্থানীয় ও বিদেশী শাসকদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে। আর্য জাতির আগমনের পর খ্রিস্টীয় চতুর্থ হতে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্ত রাজবংশ বাংলা শাসন করেছিল। এর ঠিক পরেই শশাঙ্ক নামের একজন স্থানীয় রাজা স্বল্প সময়ের জন্য এ এলাকার ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন। প্রায় একশ বছরের অরাজকতার (যাকে মাৎসন্যায় পর্ব বলে অভিহিত করা হয়) শেষে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশ বাংলার অধিকাংশের অধিকারী হয়, এবং পরবর্তী চারশ বছর ধরে শাসন করে। এর পর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে। দ্বাদশ শতকে সুফি ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলামের প্রবর্তন ঘটে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভিযান এবং যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুসলিম শাসকেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১২০৫-১২০৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী নামের একজন তুর্কী বংশোদ্ভূত সেনাপতি রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে সেন রাজবংশের পতন ঘটান। ষোড়শ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসার আগে পর্যন্ত বাংলা স্থানীয় সুলতান ও ভূস্বামীদের হাতে শাসিত হয়। মোঘল বিজয়ের পর ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপিত হয় এবং এর নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীর নগর। শেখ মুজিবুর রহমান (ডান পাশ থেকে তৃতীয় জন) এবং মওলানা ভাসানী (ডান পাশ থেকে চতুর্থ জন) ১৯৫৩ সালে বাংলায় ইয়োরোপীয় ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে। ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করে।[৭] ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবের পর কোম্পানির হাত থেকে বাংলার শাসনভার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আসে। ব্রিটিশ রাজার নিয়ন্ত্রণাধীন একজন ভাইসরয় প্রশাসন পরিচালনা করতেন।[৮] ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে বহুবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এর মধ্যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষে আনুমানিক ৩০ লাখ লোক মারা যায়।[৯] ১৯০৫ থেকে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের ফলশ্রুতিতে পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হয়েছিল, যার রাজধানী ছিল ঢাকায়।[১০] তবে কলকাতা-কেন্দ্রিক রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের চরম বিরোধিতার ফলে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায় । ভারতীয় উপমহাদেশের দেশভাগের সময় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ধর্ম গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পুনর্বার বাংলা প্রদেশটিকে ভাগ করা হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশভুক্ত হয় ; অন্যদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশভুক্ত হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়।[১১] ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ভূমিস্বত্ব সংস্কারের মাধ্যমে জমিদার ব্যবস্থা রদ করা হয়।[১২] কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত গুরুত্ব সত্ত্বেও পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈরীতার প্রথম লক্ষণ হিসাবে প্রকাশ পায়।[১৩] পরবর্তী দশক জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে নেয়া নানা পদক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। এসময় বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হিসাবে আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটে, এবং দলটি বাঙালি জাতির প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি ৬ দফা আন্দোলনের সূচনা ঘটে যার মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বাধিকার আদায়। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে কারাবন্দী করা হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চাপিয়ে আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়; কিন্তু ঊনসত্তরের তুমুল গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খানের সামরিক জান্তার পতন ঘটে এবং মুজিব মুক্তি পান। জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি স্মারক স্থাপনা ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ১১ নভেম্বর এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে। এ সময় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার অসহযোগিতা ও ঔদাসীন্য প্রকট হযে ওঠে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে।[১৪] মুজিবের সাথে গোলটেবিল বৈঠক সফল না-হওয়ার পর পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ গভীর রাতে মুজিবকে গ্রেপ্তার করেন এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের অংশ হিসাবে বাঙালিদের উপর নির্বিচারে আক্রমণ শুরু করে।[১৫] পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এই নারকীয় হামলাযজ্ঞে রাতারাতি বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে।[১৬] সেনাবাহিনী ও তার স্থানীয় দালালদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিজীবী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। গণহত্যা থেকে নিস্তার পেতে প্রায় ১ কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। (LaPorte [১৭] , p. 103) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মোট জীবনহানির সংখ্যার হিসাব কয়েক লাখ হতে শুরু করে ৩০ লাখ পর্যন্ত অনুমান করা হয়েছে।[১৮] [১৯] আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। এর প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দিন আহমদ। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ৯ মাস পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরূদ্ধে লড়াই করে। মুক্তি বাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভারতের সহায়তায় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে। মিত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পন করেন। প্রায় ৯০,০০০ পাকিস্তানী সেনা যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক হয়; যাদেরকে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়।[২০] শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে প্রথমে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু হয় ও শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।[৯] ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে শুরুতে মুজিব সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করত: দেশে বাকশাল নামীয় রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট তারিখে সেনাবাহিনীর কিয়দংশ ও স্বীয় দলের কিছু রাজনীতিবিদের ষড়যন্ত্রে সংঘটিত অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন। [২১] পরবর্তী ৩ মাসে একাধিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থান চলতে থাকে, যার পরিসমাপ্তিতে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরায় প্রবর্তন করেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রাম সফরের সময় আরেকটি অভ্যুত্থানে নিহত হন।[২১] অত:পর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বাংলাদেশের পরবর্তী শাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রক্তপাতবিহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। রাষ্ট্রপতি এরশাদ ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেশ শাসন করেন। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে তাঁর পতন হয় এবং তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করলে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয় এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেত্রী হিসাবে ১৯৯১ হতে ১৯৯৬ ও ২০০১ হতে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ হতে ২০০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দারিদ্র ও দুর্নীতির সত্বেও বাংলাদেশ বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে তার অবস্থান সমুন্নত রেখেছে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশাল জয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার গঠন করে এবং খালেদা জিয়া পুনরায় প্রধান মন্ত্রী হন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর নানা নাটকীয় পালা বদলের মধ্য দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে ফখরুদ্দিন আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন। এই সরকার প্রায় দুই বৎসর ক্ষমতায় থাকে এবং সেনা সমর্থিত সরকার হিসাবে সমালোচিত হয়। তবে ফখরুদ্দিন সরকার ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক মহাজোট সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা পুনরায় প্রধান মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন। সরকার ব্যবস্থা ঢাকার শের-এ-বাংলানগরে অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন বাংলাদেশ বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকসমূহ [২২] পতাকা লাল-সবুজ প্রতীক শাপলা সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা পশু বেঙ্গল টাইগার পাখি দোয়েল ফুল সাদা শাপলা গাছ আমগাছ ফল কাঁঠাল খেলা কাবাডি পঞ্জিকা বঙ্গাব্দ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত হয়। পরবর্তীতে ২০১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সর্বমোট ১৫টি সংশোধনী আনা হয়েছে।[২৩] বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থার সরকার পদ্ধতি প্রচলিত। রাষ্ট্রযন্ত্রের তিনটি শাখা: সংসদ, প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থা। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ এক কক্ষবিশিষ্ট। এতে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ৩০০ জন সদস্য ছাড়াও মহিলাদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন আছে। প্রতিটি সংসদের নির্ধারিত মেয়াদকাল ৫ বছর। বাংলাদেশের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল হল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। এছাড়াও, জাতীয় পার্টি রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ১৮ বছর বা তারচেয়ে বয়সে বড় সব নাগরিকের ভোটাধিকার রয়েছে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নির্বাচনের পূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পদ্ধতি চালু হয় যা ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে সংশোধনক্রমে সংবিধানে গৃহীত হয়। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ম জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত নির্বাচনের পূর্বে কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। এই ব্যবস্থায় সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হতো। এ সময় সরকারী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয় নির্দলীয় নিরপেক্ষ উপদেষ্টামণ্ডলীর মাধ্যমে। সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন মর্মে সংবিধানে প্রবিধান রয়েছে। সংসদীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।[২৩] ২০১১-এ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সংবিধানের ১৫শ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনপূর্ব নিদর্লীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পদ্ধতি বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রপতি এদেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁর সীমিত ক্ষমতা রয়েছে; কেননা কয়েকটি ক্ষেত্র ব্যতীত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে তিনি সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য। তবে সংসদ নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল ক্ষমতার অধিকারী হলেন প্রধানমন্ত্রী, যিনি "সরকার প্রধান" হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই সংসদ সদস্য হতে হয়। মন্ত্রীসভার মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত এবং রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বাংলাদেশের সরকারী প্রশাসন যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হলো বাংলাদেশ সচিবালয় রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যাবলী পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নিযুক্ত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীরা মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রী পদমর্যাদায় বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছেন। উপদেষ্টাবৃন্দ মন্ত্রী সভার বৈঠকে অংশ গ্রহণ করেন। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে সরকার গঠনের পরও প্রধানমন্ত্রীর চার জন উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেন একজন স্থায়ী সচিব। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে ৪০টি মন্ত্রণালয় রয়েছে। বড় মন্ত্রণালয়, যেমন অর্থ মন্ত্রণালয়, একাধিক “বিভাগ”-এ বিভক্ত যা কার্যতঃ মন্ত্রণালয় বটে। প্রতিটি জেলা এবং উপজেলায় সরকারী প্রশাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ নীতিমালা প্রণয়ন যা বিভিন্ন সংযুক্ত বিভাগ, সংস্থা, বোর্ড, কমিশন, একাডেমী প্রভৃতির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির জন্য পৃথক কার্যালয় রয়েছে। ২০১১-এর হিসাবে দেখা যায়, সরকারি চাকরিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১১ লাখ ৮২ হাজার ৭৬৫।, এর বাইরে শূন্যপদ রয়েছে প্রায় দেড় লাখ। কর্মরতদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর সংখ্যা ১ লাখ ১৯ হাজার ৫২২, দ্বিতীয় শ্রেণীর ৭৩ হাজার ৩২১, তৃতীয় শ্রেণীর ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩১১ এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর সংখ্যা ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬১১ জন।[২৪] সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর দুটি স্তর রয়েছে যথা হাইকোর্ট ডিভিশন ও আপীল ডিভিশন। রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারকদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। দেশের আইন-কানুন অনেকটা প্রচলিত ব্রিটিশ আইনের আদলে প্রণীত; তবে বিবাহ এবং উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইনগুলো ধর্মভিত্তিক। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে প্রশাসন থেকে পৃথক করা হয়েছে। পররাষ্ট্র নীতি বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে জাতিসংঘ সনদের প্রতি বিশ্বস্ততা এবং বিশ্বসম্প্রদায়ভুক্ত একটি জাতি হিসেবে সকল দায়দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশের সংবিধানে পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতিসমূহ সন্নিবেশিত হয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় “মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাংখার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন” করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে। এরই অনুসৃতিতে সংবিধানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অভিমুখ নির্ধারণ করে ৪টি মূল স্তম্ভ উল্লেখ করা হয়েছে: (ক) জাতীয় সমতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা; (খ) শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ প্রয়াস; (গ) নিজস্ব আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনে প্রত্যেক জাতির অধিকারের স্বীকৃতি এবং (ঘ) বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের সমর্থন। ঢাকায় অবস্থিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংযুক্ত বিভাগসমূহ এবং তৎসঙ্গে পৃথিবীর ৪৬টি দেশে অবস্থিত ৫৮টি দূতাবাসের মাধ্যমে পররাষ্ট্র বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন আন্তর্জাতিক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি; বরং এদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাত-সংকুল দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ১৯৮০-এর দশক থেকে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে সাংবিধানিক বাধা না-থাকায় একজন বাংলাদেশী দ্বিতীয় একটি দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারেন। কোন প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিক উত্তর আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা), অস্ট্রেলিয়া অথবা ইউরোপের কোন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে সে-দেশের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য পঠিতব্য শপথ বাক্যে বা স্বাক্ষরিত কোন দলিলে যদি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহারের শপথ না-থাকে, তাহলে তাঁর বাংলাদেশী নাগরিকত্ব বহাল থাকবে। এক্ষেত্রে বিদেশী নাগরিকত্বধারী প্রবাসী বাংলাদেশী তার বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করতে পারবেন। বাংলাদেশী নাগরিক ইসরায়েল ব্যতীত পৃথিবীর যে-কোন দেশে ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশ পাসপোর্ট ব্যবহার করতে পারেন।[২৫] সামরিক খাত মূল নিবন্ধ: বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বানৌজা বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ফিগ্রেট। ২০১২ এর হিসাবে, সেনাবাহিনীর বর্তমান শক্তি ৩০০,০০০ প্রায় রিজার্ভ সহ,<[২৬] এবং নৌবাহিনী ১৯,০০০।[২৭] প্রথাগত প্রতিরক্ষা ভূমিকা ছাড়াও, সামরিক বাহিনীকে দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে ত্রাণ ও অভ্যন্তরীণ নাগরিক নিরাপত্তার জন্য কর্তৃপক্ষ ডাক দিতে পারে। বাংলাদেশ বর্তমানে সক্রিয় কোনো চলমান যুদ্ধে নেই, কিন্তু এটি অপারেশন মরুভূমি ঝড় ১৯৯১ সালে যুদ্ধে ২,৩০০ সৈন্য এবং বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে সারা বিশ্বে একটি শীর্ষ অবদানকারী (১০,৭৩৬) শান্তিরক্ষা বাহিনী। মে ২০০৭ সালে, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, লাইবেরিয়া, সুদান, পূর্ব তিমুর এবং আইভরি কোস্ট এর প্রধান স্থাপনায় ছিল।[২৮][২৯] সরকার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য প্রাগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অস্ত্র ক্রয় করছে। ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে সরকার প্রায় ১৫হাজার ১০৪ কোটি টাকা মূল্যের অস্ত্র-শস্ত্র ক্রয় করেছে।[৩০] বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সার্বিক আধুনিকায়নের লক্ষ্য নিয়ে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে "ফোর্সেস গৌল ২০৩০" শীর্ষক একটি পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। ২০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে চীন থেকে ২টি সাবমেরিন ক্রয়ের সিদ্ধানন্ত গৃহীত হয়েছে। কুতুবদিয়া চ্যানেলে একটি সাবমেরিন পোতাশ্রয় গড়ে তোলা হচ্ছে। রাশিয়া থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের Mi-17 হেলিকপ্টার, প্রশিক্ষণ বিমান, ট্যাংক-বিধ্বংসী মিযাইল, আরমার্ড ক্যারিয়ার ক্রয়ের বিশাল অস্ত্র ক্রয় চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।[৩১] চীন ও রাশিয়া ছাড়াও বাংলাদেশ জার্মাাণী, ফ্রান্স, বেলারুশ, সার্বিয়া, জাপান, ইংল্যাণ্ড ও ইতালী থেকে সমরাশস্ত্র ক্রয় করে থাকে। প্রশাসনিক বিভাজন মূল নিবন্ধ: বাংলাদেশের প্রশাসনিক অঞ্চল একটি ক্লিকযোগ্য মানচিত্র বাংলাদেশের বিভাগসমূহ দেখাচ্ছে। এই চিত্র সম্পর্কে বাংলাদেশ ৭টি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত।[৩২] এগুলো হল: ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট এবং রংপুর। প্রতিটি বিভাগে রয়েছে অনেকগুলো জেলা। বাংলাদেশের জেলার সংখ্যা মোট ৬৪টি। জেলার চেয়ে ক্ষুদ্রতর প্রশাসনিক অঞ্চলকে উপজেলা বা থানা বলা হয়। সারাদেশে উপজেলা রয়েছে ৪৮৯টি।[৩৩] এই থানাগুলো ৪,৪৮৪টি ইউনিয়নে; ৫৯,৯৯০টি মৌজায় এবং ৮৭,৩১৯টি গ্রামে বিভক্ত। বিভাগ, জেলা ও থানা পর্যায়ের প্রশাসনে কোনো নির্বাচিত কর্মকর্তা নেই; সরকার নিযুক্ত প্রশাসকদের অধীনে এসব অঞ্চল পরিচালিত হয়ে থাকে। ইউনিয়ন বা পৌরসভার ওয়ার্ডগুলোতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতি রয়েছে। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পর্যায়ে মহিলাদের জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়।[৩৪] এছাড়া শহরাঞ্চলে ১১টি সিটি কর্পোরেশন (ঢাকা-উত্তর, ঢাকা-দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও কুমিল্লা) এবং ২২৩টি পৌরসভা রয়েছে। এগুলোর সবগুলোতেই জনগণের ভোটে মেয়র ও জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। রাজধানী ঢাকা বাংলাদেশের বৃহত্তম শহর। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শহরের মধ্যে রয়েছে - চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, কক্সবাজার, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, রংপুর, যশোর, টঙ্গী, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ। বিভাগ জনসংখ্যা (২০১১ সাল পর্যন্ত)[৩৫] আয়তন (কিমি২)[৩৫] জনসংখ্যা ঘনত্ব ২০১১ (লোক/কিমি২)[৩৫] বৃহত্তম শহর ঢাকা ৪৭,৪২৪,৪১৮ ৩১,১২০ ১,৫২৩ ঢাকা (৭,০৩৩,০৭৫) চট্টগ্রাম ২৮,৪২৩,০১৯ ৩৩,৭৭১ ৮৪১ চট্টগ্রাম (২,৫৯২,৪৩৯) খুলনা ১৫,৬৮৭,৭৫৯ ২২,২৭২ ৭০৪ খুলনা (৬৬৩,৩৪২) সিলেট ৯,৯১০,২১৯ ১২,৫৯৬ ৭৮০ সিলেট (৪৭৯,৮৩৭) রাজশাহী ১৮,৪৮৪,৮৫৮ ১৮,১৯৭ ১,০১৫ রাজশাহী (৪৪৯,৭৫৬) রংপুর ১৫,৭৮৭,৭৫৮ ১৬,৩১৭ ৯৬০ রংপুর (৩৪৩,১২২) বরিশাল ৮,৩২৫,৬৬৬ ১৩,২৯৭ ৬২৬ বরিশাল (৩২৮,২৭৮) বাংলাদেশ ১৪৪,০৪৩,৬৯৭ ১৪৭,৫৭০ ৯৭৬ প্রধান শহরাঞ্চল অবস্থান শহর জনসংখ্যা (২০১১ সাল পর্যন্ত)[৩৫] ১ ঢাকা ৭,০৩৩,০৭৫ ২ চট্টগ্রাম ২,৫৯২,৪৩৯ ৩ খুলনা ৬৬৩,৩৪২ ৪ নারায়ণগঞ্জ ৫৪৩,০৯০ ৫ সিলেট ৪৭৯,৮৩৭ ৬ টঙ্গী ৪৭৬,৩৫০ ৭ রাজশাহী ৪৪৯,৭৫৬ ৮ বগুড়া ৩৫০,৩৯৭ ৯ বরিশাল ৩২৮,২৭৮ ১০ কুমিল্লা ৩২৬,৩৮৬ [৩৬] ভূগোল ও জলবায়ু মূল নিবন্ধ: বাংলাদেশের ভূগোল উপগ্রহ থেকে তোলা বাংলাদেশের আলোকচিত্র দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম দুটি নদী - গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে সেখানেই কালের পরিক্রমায় গড়ে ওঠা পৃথিবীর বৃহত্তম এই ব-দ্বীপ। এই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র মোহনা অঞ্চলে প্রায় ৩০০০ বছর বা তারও পূর্ব থেকে যে জনগোষ্ঠীর বসবাস, তা-ই ইতিহাসের নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে বর্তমানের স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশরূপে। ভৌগোলিক বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়, ভারত ও মিয়ানমারের মাঝখানে। এর ভূখণ্ড ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। বাংলাদেশের পশ্চিম, উত্তর, আর পূর্ব সীমান্ত জুড়ে রয়েছে ভারত; পশ্চিমে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য; উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় রাজ্য এবং পূর্বে রয়েছে আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরাম। তবে পূর্বে ভারত ছাড়াও মিয়ানমারের (বার্মা) সাথে সীমান্ত রয়েছে; দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের স্থল সীমান্তরেখার দৈর্ঘ্য ৪,২৪৬ কিলোমিটার যার ৯৪ শতাংশ (৯৪%) ভারতের সাথে এবং বাকি ৬ শতাংশ মিয়ানমারের সাথে। বাংলাদেশের সমুদ্রতটরেখার দৈর্ঘ্য ৫৮০ কিলোমিটার। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম অনবচ্ছিন্ন সমূদ্র সৈকতগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের উচ্চতম স্থান দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোডক পর্বত, সমুদ্রতল থেকে যার উচ্চতা ১,০৫২ মিটার (৩,৪৫১ ফুট)।[৩৭] বঙ্গোপসাগর উপকূলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ জুড়ে অনেকটা অংশ জুড়ে সুন্দরবন অবস্থিত, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এখানে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল বাঘ, চিত্রল হরিণ সহ নানা ধরনের প্রাণীর বাস। ১৯৯৭ সালে এই এলাকাকে বিলুপ্তির সম্মুখীন বলে ঘোষণা দেয়া হয়। [৩৮] বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ। আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে ৬টিঋতুতে ভাগ করা হয়েছেঃ-গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। বছরে বৃষ্টিপাতের মাত্রা ১৫০০-২৫০০মি.মি./৬০-১০০ইঞ্চি; পূর্ব সীমান্তে এই মাত্রা ৩৭৫০ মি.মি./১৫০ইঞ্চির বেশী। বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ২৫° সেলসিয়াস। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করেছে। এখানকার আবহাওয়াতে নিরক্ষীয় প্রভাব দেখা যায়। নভেম্বর হতে মার্চ পর্যন্ত হালকা শীত অনুভূত হয়। মার্চ হতে জুন মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল বিরাজ করে। জুন থেকেঅক্টোবর পর্যন্ত চলে বর্ষা মৌসুম। এসময় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, ও জলোচ্ছ্বাস প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশের কোনো না কোনো স্থানে আঘাত হানে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূল নিবন্ধ: বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা সমুদ্র সমতল হতে মাত্র ১০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। সমুদ্র সমতল মাত্র ১ মিটার বৃদ্ধি পেলেই এদেশের ১০% এলাকা নিমজ্জিত হবে বলে ধারণা করা হয়। [৩৯] জনসংখ্যার উপাত্ত মূল নিবন্ধ: বাংলাদেশের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান ২০১১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত আদমশুমারীর প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ।[৪০][৪১][৪২] এই আদমশুমারীর প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.২ শতাংশ।[৪০][৪২] সরকারী সংস্থা পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুযায়ী জুন ২০১৪-এ জনসংখ্যা ১৫৬,৪৯৯,৬৭৩ জন বা ১৫.৬৪ কোটি।[১] অন্য একটি প্রাক্কলন অনুসারে মার্চ ২০১৪-এ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫.৯৫ কোটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলজেন্স এজেন্সির প্রাক্কলন ১৫.৮৫ কোটি। এই হিসাবে বাংলদেশে পৃথিবীর ৮ম জনবহুল দেশ। জনঘনত্ব প্রতি বর্গমাইল এলাকায় ২৪৯৭ জনের বেশী।[৪৩][৪৪] ২০১১-এর আদমশুমারীর প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী পুরুষ ও নারীর সংখ্যা যথাক্রমে ৭ কোটি ১২ লাখ ৫৫ হাজার এবং ৭ কোটি ১০ লাখ ৬৪ হাজার অর্থাৎ নারী ও পুরুষের অনুপাত ১০০:১০৩।[৪০][৪৫] জনসংখ্যার নিরিখে এটি বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম দেশ। এখানে জনবসতির ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১,০৫৫ জন, যা সারা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ (কিছু দ্বীপ ও নগর রাষ্ট্র বাদে)। দেশের অধিকাংশ মানুষ শিশু ও তরুণ বয়সীঃ যেখানে ০–২৫ বছর বয়সীরা মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ, সেখানে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীরা মাত্র ৩ শতাংশ। এদেশে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের গড় আয়ু ৬৩ বছর।[৪২] নোবেল পুরস্কারে ভূষিত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র বিমোচনে বিশেষ অবদান রেখেছেন। জাতিগতভাবে বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ অধিবাসী বাঙালি।[৪৬] বাকি ২ শতাংশ অধিবাসী বিহারী বংশোদ্ভূত এবং বিভিন্ন উপজাতি সদস্য। দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ১৩টি উপজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে চাকমা উপজাতি প্রধান। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরের উপজাতিগুলোর মধ্যে গারো ও সাঁওতাল উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, কক্সবাজার এলাকায় বার্মা থেকে বিতাড়িত স্বল্পসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছে। দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, যা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। সরকারী ও ব্যবসায়ী কাজ-কর্মে ইংরেজিও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে বৈদেশিক যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সরকারী কর্মকাণ্ডে বাংলা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। জনগোষ্ঠির প্রধান ধর্মবিশ্বাস ইসলাম (৮৯ শতাংশ); এরপরেই রয়েছে হিন্দু ধর্ম (৯ শতাংশ)। বাকি ১ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, অথবা অগ্নিউপাসক। মুসলমানদের মধ্যে অধিকাংশ সুন্নি মতাবলম্বী। মোট জনগোষ্ঠীর ২১.৪ শতাংশ শহরে বাস করে; বাকি ৭৮.৬ শতাংশ গ্রামাঞ্চলের অধিবাসী। সরকারী ও বেসরকারী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে দারিদ্র বিমোচন ও জনস্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে। মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক গড়ে দৈনিক মাত্র ১ মার্কিন ডলার আয় করে (২০০৫)।[৪৭] আর্সেনিকজনিত বিষক্রিয়া বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা।[৪৮] ১৯৯০ দশকের শেষভাগে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের হিসাবে বাংলাদেশে স্বাক্ষরতার হার প্রায় ৪১ শতাংশ।[৪৯] ইউনিসেফের ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের হিসাবে পুরুষদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ৩১ শতাংশ।[৫০] তবে সরকার বাস্তবায়িত বিবিধ সাক্ষরতা কর্মসূচীর ফলে দেশে শিক্ষার হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এর মধ্যে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছে।[৫১] দেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। এছাড়া মেয়েদের শিক্ষার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রবর্তিত বৃত্তি প্রদান কর্মসূচী নারীশিক্ষাকে এগিয়ে নিচ্ছে।[৫২] অর্থনীতি মূল নিবন্ধ: বাংলাদেশের অর্থনীতি পাঁট বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল ধানক্ষেতে কৃষক বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। জাতিসঙ্ঘের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী এটি একটি স্বল্পোন্নত দেশ (Least Developed Country)। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে ১০০০ টাকার আন্তজার্তিক মূল্যমান কমবেশী ১৩ মার্কিন ডলার (১ মার্কিন ডলার = ৭৮ টাকা)। দেশে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারের বেশী। ১৯৮০'র দশক থেকে শিল্প ও সেবা খাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ সত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অদ্যাবধি কৃষিনির্ভর কারণ দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষিজীবী। দেশের প্রধান কৃষিজ ফসলের মধ্যে রয়েছে ধান, পাট এবং চা। দেশে আউশ, আমন, বোরো এবং ইরি ধান উৎপন্ন হয়ে থাকে। পাট, যা বাংলাদেশের সোনালী আঁশ নামে পরিচিত, এক সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস ছিলো। [৫৩] বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশ আসে রফতানিকৃত তৈরি পোশাক থেকে, এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বেশীরভাগ ব্যয় হয় একই খাতের জন্য কাঁচামাল আমদানীতে।[৫৪] সস্তা শ্রম ও অন্যান্য সুবিধার কারণে ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকে এই খাতে যথেষ্ট বৈদেশিক ও স্থানীয় বিনিয়োগ হয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবৎসরে তৈরী পোশাক রপ্তানীর পরিমাণ ছিল ১২৫০ কোটি মার্কিন ডলার।[৫৫] কক্সবাজার সৈকতে জেলেদের নৌকা তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাঁদের ৯০%-ই নারী শ্রমিক। [৫৬] বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি বড় অংশ আসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো অর্থ হতে। পরিবর্তিত হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ১০৪৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। [৫৭] নানা অর্থনৈতিক সূচকে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের অবস্থান পিছনের সারিতে, তবে বিশ্ব ব্যাংকের ২০০৫ সালের দেশভিত্তিক আলোচনায় এদেশের শিক্ষা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য সামাজিক খাতে উন্নয়নের প্রশংসা করা হয়েছে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশ গড়ে ৫% থেকে ৬.২% শতাঙশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এসেছে। মধ্যবিত্ত ও ভোক্তা শ্রেণীর প্রসারণ ঘটেছে দ্রুত। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে গোল্ডম্যান স্যাক্স-এর বিশ্লেষণে বাংলাদেশকে আগামী ১১ দেশ এর মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। [৫৮] ২০১৩-১৪ অর্থবৎসরের প্রাক্কলন অনুযায়ী এবছর ৬% জিডিপি প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছে।[৫৯] বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সারা দেশে চালু হওয়া ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচী। গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনুস ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা। ১৯৯০ এর দশকের শেষভাগে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ; ব্র্যাক সহ অন্যান্য সাহায্য সংস্থারও প্রায় ২৫ লাখ সদস্য রয়েছে। [৬০] দেশের শিল্প ও রফতানির উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (Export Processing Zone বা EPZ) স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি বা বেপজা এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের রফতানি ও আমদানি বাণিজ্যর সিংহভাগ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর , মংলা সমুদ্র বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। মুদ্রাব্যবস্থা আরও দেখুন: বাংলাদেশী টাকা বাংলাদেশে দুই ধরনের মুদ্রাব্যবস্থা প্রচলিত আছে, ধাতব মুদ্রা ও কাগুজে নোট। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেডের (SPCBL) অধিনে (শিমুলতলী, গাজীপুর) কাগুজে নোট গুলো মুদ্রিত হয়। নোট গুলো প্রচলন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১০ টাকার নোট SPCBL কর্তৃক মুদ্রিত প্রথম নোট। নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস লিমিটেড, বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠান। ১ টাকা এবং ১০০ টাকার নোট এ দেশে প্রথম মুদ্রিত নোট। বাংলাদেশের প্রথম টাকা ও মুদ্রার নকশাকার কে জি মুস্তফা। বর্তমানে নয়টি(৯) কাগুজে নোট এবং তিনটি(৩) ধাতব মুদ্রা চালু আছে। শিক্ষা মূল নিবন্ধ: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল ভবন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েরপুরকৌশল বিভাগের বিল্ডিং বাংলাদেশে স্বাক্ষরতার হার খুব কম, ২০১০ সালে নারীদের জন্য ৫২.২ % এবং পুরুষদের জন্য ৬১.৩ % ছিল। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা তিন সারির এবং বহুলাংশে ভর্তুকিপুষ্ট। বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বহু বিদ্যালয়ের পরিচালনা ব্যয় সর্বাংশে বহন করে। সরকার অনেক ব্যাক্তিগত স্কুলের জন্য অর্থায়ন করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা খাতে, সরকার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের মাধ্যমে ১৫ টিরও বেশী বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থায়ন দিয়ে থাকে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে সরকার মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সকল ছাত্র-ছাত্রীকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করে আসছে। শিক্ষা বৎসরের প্রধম দিনের মধ্যেই ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে নতুন ক্লাশের বই তুলে দেয়ার ঐতিহ্য প্রবর্তিত হয়েছে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তিন পদ্ধতি প্রচলিত। প্রথমত সাধারণ পদ্ধতির স্কুলগুলোতে সরকারী পাঠ্যক্রম অনুসৃত হয়। এসব স্কুলে শিক্ষাপ্রদানের ভাষা বাংলা। দ্বিতীয়ত রয়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। এগুলোতে পশ্চিমা পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয়। তুলনামূলকভাবে সীমিত সংখ্যক হলেও উচ্চ মানের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এই স্কুলগুলো প্রসিদ্ধ। তৃতীয়ত রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা। শেষোক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা। তবে ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, ব্যবসায় ইত্যাদি সকল বিষয়ও পাঠ্য। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ শুরু হয়। এর ফলে ব্যক্তিখাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হতে শুরু করে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলাদেশে ব্যাক্তিখাতে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৮।[৬১] যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তাই বাংলাদেশের প্রাচীনতম যাতায়াত পথ হিসেবে গণ্য করা হয় নৌপথ বা জলপথকে। নৌপথের নদীপথ এবং সমুদ্রপথ উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবস্থায় নদীপথ গুরুত্বপূর্ণ, তবে বহির্বিশ্বের সাথে যাতায়াত ব্যবস্থায় সমুদ্রপথ ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৮৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ নাব্য জলপথ রয়েছে। এর মধ্যে ৫৪০০ কিলোমিটার সারা বছর নৌচলাচলের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। অবশিষ্ট প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার শুধু বর্ষাকালে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের নদীগুলো নৌচলাচলের জন্য বেশি উপযোগী। এ অঞ্চলেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দরগুলো অবস্থিত: ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, খুলনা প্রভৃতি। নদীপথে চলাচলকারী যাত্রীদের মধ্যে অধিকাংশই (৯৪%) নৌকা ও লঞ্চে এবং বাকিরা (৬%) স্টীমারে যাতায়াত করেন। দেশের সমুদ্রপথ মূলত ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের প্রধান দুইটি সমুদ্র বন্দর, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর এবং মংলা সমুদ্র বন্দর একাজে ব্যবহৃত হয়।[৬২] বাংলাদেশের স্থল যোগাযোগের মধ্যে সড়কপথ উল্লেখযোগ্য। সড়কপথের অবকাঠামো নির্মাণ এদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও ভৌগোলিক অবকাঠামোর মধ্যে বেশ ব্যয়বহুল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশে পাকা রাস্তার পরিমাণ ছিলো ১৯৩১.১৭ কিলোমিটার, ১৯৯৬-১৯৯৭ সালের দিকে তা দাঁড়ায় ১৭৮৮৫৯ কিলোমিটারে।[৬২] ২০১০ খ্রিস্টাব্দে দেশের জাতীয় মহাসড়ক ৩৪৭৮ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক ৪২২২ কিলোমিটার এবং ফিডার/জেলা রোড ১৩২৪৮ কিলোমিটার। দেশের সড়কপথের উন্নয়নের জন্য "বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্পোরেশন" (বিআরটিসি) নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে।[৬৩] সড়কপথে প্রায় সব জেলার সাথে যোগাযোগ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো (ব্রিজ, কালভার্ট) নির্মিত না হওয়ায় ফেরি পারাপারের প্রয়োজন পরে। সড়কপথে জেলাভিত্তিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় বড় যানবাহন যেমন: ট্রাক, বাস ব্যবহৃত হলেও আঞ্চলিক বা স্থানীয় পর্যায়ে ট্যাক্সি, সিএনজি, মিনিবাস, ট্রাক ইত্যাদি যান্ত্রিক বাহন ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও বহু পুরাতন আমলের অযান্ত্রিক বাহন যেমন: রিকশা, গরুর গাড়ি, ঠেলাগাড়িও ব্যবহৃত হয়। এছাড়া স্থলভাগে রেলপথ সবচেয়ে নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা হিসেবে ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় বাংলাদেশে রেলপথ ছিলো ২৮৫৭ কিলোমিটার।[৬২] ২০০৮-২০০৯ সালের হিসাবমতে, বাংলাদেশে রেলপথ রয়েছে ২৮৩৫ কিলোমিটার।[৬৩] এদেশে মিটারগেজ এবং ব্রডগেজ -দু'ধরণের রেলপথ রয়েছে।[৬২] রেলপথ, রেলস্টেশনের দ্বারা পরিচালিত হয় এছাড়া বিভিন্ন স্টেশনকে জংশন হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। রেলপথকে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বাংলাদেশকে ট্রান্স এশিয় রেলওয়ে জালের সংঙ্গ সংযোজনের জন্য চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ অবধি ১২৮ কিলোমিটার রেলসড়ক স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে (২০১৩)।, এই রেলসড়ক মিয়ানমারের গুনদুম রেলস্টেশানের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে।[৬৪] এছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে বাংলাদেশে আকাশপথে বা বিমানপথে যাতায়াতের ব্যবস্থাও রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিমান যাতায়াত ব্যবস্থায় দেশের ভিতরকার বিভিন্ন বিমানবন্দরে যাতায়াত করা যায়, আর আন্তর্জাতিক বিমান যাতায়াত ব্যবস্থায় শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বহির্দেশে গমনাগমন করা যায়।[৬২] ঢাকার কুর্মিটোলায় অবস্থিত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বাংলাদেশের অন্যতম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এছাড়াও চট্টগ্রাম এবং সিলেটেও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা হলো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা মূলত ছিলো ডাক আদান-প্রদানভিত্তিক। কিন্তু কালের আবর্তনে টেলিগ্রাফ, টেলিফোন এবং পরবর্তিতে মোবাইল ফোনের প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সংঘটিত হয়। পর্যটন খাত মূল নিবন্ধ: বাংলাদেশের পর্যটন কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পর্যটন খাত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল। আগস্ট, ১৯৭৫ সালে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় হিসেবে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা হয়। জানুয়ারি, ১৯৭৬ সালে এটি পুণরায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিভাগে পরিণত হয়। ডিসেম্বর, ১৯৭৭ সালে পৃথকভাবে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় খোলা হয়। ২৪ মার্চ, ১৯৮২ সালে এ মন্ত্রণালয়কে বিলুপ্ত করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়। এরপর ১৯৮৬ সাল থেকে উক্ত মন্ত্রণালয়কে পুণঃপ্রতিষ্ঠা অদ্যাবধি তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।[৬৫]এছাড়া আরো একাধিক পর্যটন কেন্দ্র আছে যা খুবি আর্কষনিয়। স্বাস্থ্য খাত মূল নিবন্ধ: শিশু দারিদ্রপীড়িত বাংলাদেশে অপুষ্টি একটি দুরূগ সমস্যা যা স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। অপুষ্টিজনিত কারণে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে পরিচিত শিশুরা বিশ্ব ব্যাংকের জরীপে বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করেছে যা মোটেই কাঙ্খিত নয়।[৬৬][৬৭] মোট জনগোষ্ঠীর ২৬% অপুষ্টিতে ভুগছে।[৬৮] ৪৬% শিশু মাঝারী থেকে গভীরতর পর্যায়ে ওজনজনিত সমস্যায় ভুগছে।[৬৯] ৫ বছর বয়সের পূর্বেই ৪৩% শিশু মারা যায়। প্রতি পাঁচ শিশুর একজন ভিটামিন এ এবং প্রতি দু'জনের একজন রক্তস্বল্পতাজনিত রোগে ভুগছে।[৭০] তবে গত দুই শতকে মানুষের খাদ্যগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে (২০১৩: ২০৪০ গ্রাম দৈনিক) এবং সুষম খাদ্যাভাস গড়ে উঠেছে যার ফলস্বরূপ অকাল মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে এবং জনগণের গড় আয়ু ৬৯ বৎসরে (২০১৩ খ্রি:) উন্নীত হয়েছে। বহু সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল এবং ১৩ হাজার কমিউনিটি হাসাপাতালে মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মান অনেকাংশে উন্নীত হয়েছে। জন্মকালে শিশু মৃত্যু হার (২০১৩: হাজারে ৫৩ জন) ও মাতৃমৃত্যুর হার (২০১৩: হাজারে ১৪৩ জন) উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।[৭১] সংস্কৃতি মূল নিবন্ধ: বাংলাদেশের সংস্কৃতি ঢেঁকি, যা শস্য ভাঙ্গার কাজে ব্যবহৃত হয়, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে একসময় বহুল ব্যবহৃত হত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য হাজার বছরের বেশি পুরনো। ৭ম শতাব্দীতে লেখা বৌদ্ধ দোহার সঙ্কলন চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় কাব্য, লোকগীতি ও পালাগানের প্রচলন ঘটে। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাংলা কাব্য ও গদ্যসাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ বাংলা ভাষায় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলার লোক সাহিত্যও সমৃদ্ধ; মৈমনসিংহ গীতিকায় এর পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সংগীত বাণীপ্রধান; এখানে যন্ত্রসংগীতের ভূমিকা সামান্য। গ্রাম বাংলার লোক সঙ্গীতের মধ্যে বাউল গান, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, গম্ভীরা, কবিগান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গ্রামাঞ্চলের এই লোকসঙ্গীতের সাথে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে মূলত একতারা, দোতারা, ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। নৃত্যশিল্পের নানা ধরন বাংলাদেশে প্রচলিত। এর মধ্যে রয়েছে উপজাতীয় নৃত্য, লোকজ নৃত্য, শাস্ত্রীয় নৃত্য ইত্যাদি। দেশের গ্রামাঞ্চলে যাত্রা পালার প্রচলন রয়েছে। ঢাকা-কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র শিল্প হতে প্রতি বছর প্রায় ৮০ হতে ১০০টি বাংলা চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়।[৭২] বিয়ের সাজে বৌ, বাংলাদেশের হস্তশিল্পের নমুনা বাংলাদেশে মোট প্রায় ২০০টি দৈনিক সংবাদপত্র ও ১৮০০রও বেশি সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তবে নিয়মিতভাবে পত্রিকা পড়েন এরকম লোকের সংখ্যা কম, মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৫%।[৭৩] গণমাধ্যমের মধ্যে রেডিও অঙ্গনে বাংলাদেশ বেতার ও বিবিসি বাংলা জনপ্রিয়। সরকারী টেলিভিশন সংস্থা বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে বেসরকারি ১০টির বেশি উপগ্রহভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল ও ৫টির বেশি রেডিও সম্প্রচারিত হয়। বাংলাদেশের রান্না-বান্নার ঐতিহ্যের সাথে ভারতীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের রান্নার প্রভাব রয়েছে। ভাত, ডাল ও মাছ বাংলাদেশীদের প্রধান খাবার, যেজন্য বলা হয়ে থাকে মাছে ভাতে বাঙালি। দেশে ছানা ও অন্যান্য প্রকারের মিষ্টান্ন, যেমন রসগোল্লা, চমচম, সন্দেশ, কালোজাম বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশের নারীদের প্রধান পোষাক শাড়ি। অল্পবয়স্ক মেয়েদের মধ্যে, বিশেষত শহরাঞ্চলে সালোয়ার কামিজেরও প্রচলন রয়েছে। পুরুষদের প্রধান পোষাক লুঙ্গি, তবে শহরাঞ্চলে পাশ্চাত্যের পোষাক শার্ট-প্যান্ট প্রচলিত। বিশেষ অনুষ্ঠানে পুরুষরা পাঞ্জাবী-পায়জামা পরিধান করে থাকেন। এখানকার প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মুসলমান সম্প্রদায়ের উত্সব ঈদুল ফিত্‌র ও ঈদুল আজহা, এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা। বৌদ্ধদের প্রধান উত্সব বুদ্ধ পূর্ণিমা, আর খ্রীস্টানদের বড়দিন। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব হচ্ছে দুই ঈদ, অর্থাৎ ঈদুল ফিত্‌র ও ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতরের আগের দিনটি বাংলাদেশে ‘চাঁদ রাত’ নামে পরিচিত। ছোট ছোট বাচ্চারা এ দিনটি অনেক সময়ই আতশবাজির মাধ্যমে পটকা ফাটিয়ে উদযাপন করে। ঈদুল আজহার সময় শহরাঞ্চলে প্রচুর কোরবানির পশুর আগমন হয়, এবং এটি নিয়ে শিশুদের মাঝে একটি উৎসবমুখর উচ্ছাস থাকে। এই দুই ঈদেই বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা ছেড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ তাঁদের জন্মস্থল গ্রামে পাড়ি জমায়। এছাড়া বাংলাদেশের সর্বজনীন উত্সবের মধ্যে পহেলা বৈশাখ প্রধান। গ্রামাঞ্চলে নবান্ন, পৌষ পার্বণ ইত্যাদি লোকজ উত্সবের প্রচলন রয়েছে। এছাড়া স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে শহীদ দিবস পালিত হয়। খেলাধূলা ঢাকার শের-এ-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী একটি ক্রিকেট ম্যাচ মূল নিবন্ধ: বাংলাদেশের খেলাধুলাদ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর Dwijendranath Tagore.jpg জন্ম ১১ মার্চ, ১৮৪০ কলকাতা, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) মৃত্যু ১৯ জানুয়ারি, ১৯২৬ শান্তিনিকেতন, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) দম্পতি সর্বসুন্দরী দেবী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (জন্ম: ১১ মার্চ, ১৮৪০ – মৃত্যু: ১৯ জানুয়ারি, ১৯২৬) ছিলেন বিশিষ্ট বাঙালি কবি, সংগীতকার, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ। তিনি বাংলা সংকেত লিপি (শর্ট হ্যান্ড) ও স্বরলিপি রচনার অন্যতম অগ্রপথিক ছিলেন।[১] পারিবারিক পরিচয়ে তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। পরিচ্ছেদসমূহ [আড়ালে রাখো] ১ প্রারম্ভিক জীবন ২ কাব্যচর্চা ৩ দর্শনচর্চা ৪ কর্মজীবন ৫ শান্তিনিকেতনে ৬ রচনাবলি ৭ উত্তরপুরুষ ৮ তথ্যসূত্র ৯ পাদটীকা ১০ বহি:সংযোগ প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা] দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ঠাকুর পরিবারের জোড়াসাঁকো শাখার দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তাঁর বাল্যশিক্ষা মূলত গৃহশিক্ষকের নিকট। যদিও তিনি কলকাতার সেন্ট পল’স স্কুল ও হিন্দু কলেজেও (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) কিছুকাল পড়াশোনা করেছিলেন।[২] দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর পরের ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যদিও দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রকৃতিগত কিছু পার্থক্য ছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন সমাজের প্রচলিত সংস্কারগুলির একনিষ্ঠ অনুগামী। অন্যদিকে সত্যেন্দ্রনাথ এই সংস্কারগুলিকে ভেঙে নব্য আধুনিক সমাজ গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন।[৩] অনাড়ম্বর সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্থ দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন কাব্যামোদী, জ্ঞানতাপস ও পরীক্ষানিরীক্ষা-প্রিয় মানুষ।[১] যৌবনেই তাঁর স্ত্রীবিয়োগ ঘটেছিল। অবশিষ্ট জীবন দ্বিজেন্দ্রনাথ বিপত্নীক অবস্থাতেই অতিবাহিত করেছিলেন।[১] কাব্যচর্চা[সম্পাদনা] বাংলা সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রথম অবদান ছিল ধ্রুপদি সংস্কৃত ভাষায় রচিত কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের বঙ্গানুবাদ। ১৮৬০ সালে, নোবেল পুরস্কার-বিজয়ী কনিষ্ঠ ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের ঠিক এক বছর আগে, এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থ প্রকাশকালে দ্বিজেন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র কুড়ি বছর। এই অনুবাদটিই ছিল মেঘদূতের প্রথম বাংলা অনুবাদ। দ্বিজেন্দ্রনাথ এই গ্রন্থ অনুবাদকালে দু-টি ভিন্ন বাংলা ছন্দশৈলী ব্যবহার করেছিলেন।[১] তাঁর দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ স্বপ্নপ্রয়াণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৫ সালে। এই গ্রন্থ প্রকাশকালে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কিশোর মাত্র। এই কাব্যে এক যুবকের ভ্রমণবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। এই গ্রন্থে বিভিন্ন ছন্দশৈলীর প্রয়োগের উপর তাঁর আশ্চর্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রন্থটি সেই যুগের বাংলা কাব্যের এক দিকনির্দেশক এবং সেই কারণে এর ঐতিহাসিক মূল্যও অনস্বীকার্য।[১] দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন কাব্যচর্চা শুরু করেন, তখন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন স্বীয় সাফল্যের শীর্ষদেশে। ১৮৫৬ সালে মাদ্রাজ (অধুনা চেন্নাই) থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করার পর থেকে ইউরোপ যাত্রার পূর্বে ছয় বছর মাইকেল মধুসূদন একাগ্রতার সহিত তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (১৮৫৯), পদ্মাবতী (১৮৬০), মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১), ব্রজাঙ্গনা কাব্য (১৮৬১), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১), বীরাঙ্গনা কাব্য (১৮৬২) ইত্যাদি কাব্য ও নাটকের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য জগৎকে সমৃদ্ধ ও প্রভাবিত করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বলিষ্ঠ লেখনী বাংলা সাহিত্যকে গৌরবের শিখরদেশে স্থাপন করে’।[৪] সেই যুগে বাংলার প্রত্যেক কবিই অল্পবিস্তর মধুসূদন দ্বারা প্রভাবিত হলেও, দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন এই প্রভাবের ঊর্ধ্বে।[১] বরং মধুসূদনই দ্বিজেন্দ্রনাথকে ভবিষ্যতের কবি হিসাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।[৫] উচ্চ প্রতিভাবান কবি হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তি দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত অগোছালো মানুষ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, স্বপ্নপ্রয়াণ কাব্যের ছেঁড়া পাণ্ডুলিপির পাতা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির যেখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে থাকত। এগুলি সংগ্রহ করে প্রকাশ করা গেলে তা উক্ত গ্রন্থের একটি মূল্যবান সংস্করণ হত।[১] দর্শনচর্চা[সম্পাদনা] দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ‘এক সত্যকারের দার্শনিক’। তিনি ‘ন্যাশানাল সোসাইটি’ ও ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’ নামে দুটি দর্শনচর্চাকারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় সহায়তা করেছিলেন। গীতা-দর্শনের প্রতিও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল।[৬] তাঁর প্রধান দর্শনগ্রন্থ হল তত্ত্ববিদ্যা (তিন খণ্ডে, ১৮৬৬-৬৮)। এই বইটি বাংলা দর্শনচর্চার ইতিহাসে একটি পথপ্রদর্শক গ্রন্থ। বাংলা ভাষায় এই জাতীয় বই পূর্বে প্রকাশিত হয়নি। তাঁর অপর দু-টি দর্শন গ্রন্থ হল অদ্বৈত মতের সমালোচনা (১৮৯৬) ও আর্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের ঘাত-প্রতিঘাত (১৮৯৯)।[১] কর্মজীবন[সম্পাদনা] ১৮৮৪ সাল থেকে সুদীর্ঘ ২৫ বছর তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি হিতবাদী পত্রিকাটিও প্রতিষ্ঠা করেন।[৭] দ্বিজেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশ অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অপর ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতী নামে একটি নতুন পত্রিকা চালু করার প্রস্তাব দেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করলেও, পত্রিকাটি চালাতেন মূলত জ্যোতিরিন্দ্রনাথই।[১] বাংলা সাহিত্যে তাঁর অনবদ্য অবদানের জন্য ১৮৯৭ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত মেয়াদে তাঁকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল। ১৯১৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশনে তিনিই পৌরহিত্য করেছিলেন।[১] ১৮৭৩ সালে পাবনা বিদ্রোহের সময় তাঁর জমিদারির আয় হ্রাস পেলে, তিনি কৃষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে “শান্তিশৃঙ্খলা পুনঃসংস্থাপন” করার সুপারিশ করেছিলেন।[৮] দ্বিজেন্দ্রনাথ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন। তিনি ছিলেন বাংলা সংকেত লিপি বা শর্ট হ্যান্ড প্রবর্তনের এক অগ্রপথিক। তিনি কবিতার আকারে সংকেত লিপিও চালু করেন।[১] বাংলা গানে স্বরলিপির ব্যবহার প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেযুগে রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সহকারী ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী ছাড়া আর কেউ এই কাজ করেননি।[৩] ১৯১৩ সালে বাক্সের গঠন বিষয়ে বাক্সমিতি নামে একটি পুস্তকও রচনা করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ।[২] কাগজ মুড়ে নানা রকম আকৃতি দেওয়া ছিল তাঁর শখ।[৩] ১৮৬৬ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্যের পদ অলংকৃত করেন। ব্রজসুন্দর মিত্রের তত্ত্বাবধানে ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের সূচনাপর্বে তিনি পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঢাকা পরিভ্রমণ করেছিলেন।[৯] দ্বিজেন্দ্রনাথ হিন্দুমেলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। হিন্দুমেলার জন্য তিনি দেশাত্মবোধক গানও রচনা করেছিলেন।[২] গানরচনা ছিল তাঁর স্বভাবগত। তাঁর রচিত ব্রহ্মসংগীত করো তাঁর নাম গান, যতদিন রহে দেহ প্রাণ বহু বছর ৭ পৌষের প্রার্থনায় গীত হয়েছিল। ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ প্রার্থনাতেও তাঁর রচিত ব্রহ্মসংগীতগুলি বহুলভাবে গীত হয়ে থাকে।[১০] হিন্দুমেলার জন্য লেখা তাঁর একটি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান ছিল মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি।[৭] শান্তিনিকেতনে[সম্পাদনা] জীবনের শেষ কুড়ি বছর দ্বিজেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির সাহচর্যে জ্ঞানচর্চা ও লেখালিখির মাধ্যমে অতিবাহিত করেন। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের নিয়ে তিনি হাস্যোদ্দীপক চতুষ্পদী ছড়া রচনা করতেন। এই ছড়াগুলি প্রকাশিত হত শান্তিনিকেতন পত্রিকায়। তাঁর রসবোধ শান্তিনিকেতনে সকলের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল।[৫] শান্তিনিকেতনে চড়াই পাখি, কাঠবিড়ালি আর কাকেদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল প্রবাদপ্রতীম।[৩] ঈশ্বরজ্ঞান লাভের পর মানুষের হৃদয় শিশুর তুল্য হইয়া যায় - উপনিষদ্‌ শাস্ত্রের এই শিক্ষা তিনি মেনে চলতেন। তিনি নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেছিলেন। তবে তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল দর্শন। রবীন্দ্রনাথ সহ অন্যান্য বিদ্বান ব্যক্তিদের নিতে তিনি মজলিশ বসাতেন। এই মজলিশে তিনি তাঁর রচনা পাঠ করে শোনাতেন। কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ক্ষিতিমোহন সেনের সাহায্য নিতেন।[৫] রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বড়োদাদা বলে ডাকতেন। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে মহাত্মা গান্ধী ও চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজ শান্তিনিকেতনে এসে দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁরাও তাঁকে বড়োদাদা সম্বোধন করেন।[৫] দ্বিজেন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠি সংবাদপত্রে প্রকাশের উদ্দেশ্যে দিয়ে মুখবন্ধ হিসাবে মহাত্মা গান্ধী লেখেন, “আপনারা দ্বিজেন্দ্রনাথকে চেনেন। তিনি শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়োদাদা এবং তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই কার্যত সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করে থাকেন।” [১১] রচনাবলি[সম্পাদনা] বাংলা: ভ্রাতৃভাব (১৮৬৩), তত্ত্ববিদ্যা (১৮৬৬-৬৮), সোনার কাঠি রূপার কাঠি (১৮৮৫), সোনায় সোহাগা (১৮৮৫), আর্যামি এবং সাহেবিয়ানা (১৮৯০), সামাজিক রোগের কবিরাজি চিকিৎসা (১৮৯১), অদ্বৈত মতের সমালোচনা (১৮৯৬), ব্রহ্মজ্ঞান ও ব্রহ্মসাধনা (১৯০০), বঙ্গের রঙ্গভূমি (১৯০৭), হারামণির অন্বেষণ (১৯০৮), গীতাপাঠের ভূমিকা (১৯১৫) এবং প্রবন্ধমালা (১৯২০)।[৭] ইংরেজি: বক্সোমেট্রি (বাক্সমিতি) (১৯১৩), অন্টোলজি (১৮৭১) এবং জ্যামিতি-সংক্রান্ত একটি বই।[৭] জ্ঞানাঙ্কুর, প্রতিবিম্ব, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ভারতী, সাধনা, নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, মানসী, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, শান্তিনিকেতন, বুধবার, শ্রেয়সী, প্রবাসী, সবুজপত্র ও সুপ্রভাত পত্রিকাতে তাঁর অজস্র রচনা প্রকাশিত হয়েছিল।[৭] উত্তরপুরুষ[সম্পাদনা] দ্বিজেন্দ্রনাথের পাঁচ পুত্র ছিল — দীপেন্দ্রনাথ, অরুণেন্দ্রনাথ, নীতীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ ও কৃপেন্দ্রনাথ। এঁদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৯-১৯২৯) ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক। তিনি একাধিক কবিতা, উপন্যাস ও ছোটোগল্প রচনা করে গিয়েছেন। ১৮৯১ সালে সাধনা নামে তিনি একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনিই ছিলেন এই পত্রিকার সম্পাদক। পরে এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে তুলে নেন। কালক্রমে পত্রিকাটি ভারতী পত্রিকার সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়।[১] তাঁর পৌত্রদের মধ্যে দীপেন্দ্রনাথের পুত্র দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮২-১৯৩৫) ছিলেন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ। তিনি একবার গান শুনেই তা তুলে নিতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ স্বরচিত গানে সুরারোপ করলেও, সেই সুর মনে রাখতে বা তার স্বরলিপি রচনা করতে গিয়ে তাঁকে সমস্যায় পড়তে হত। এই কাজ করতেন দিনেন্দ্রনাথ। তিনি রবীন্দ্রসংগীতের প্রধান স্বরলিপিকারেদের মধ্যে অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে “সকল গানের কাণ্ডারী” বলতেন।[১] দ্বিজেন্দ্রনাথের অপর পুত্র সুধীন্দ্রনাথের পুত্র সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১০-১৯৭৪) ছিলেন বিশিষ্ট বাগ্মী। ১৯৬০-এর ও ১৯৭০-এর দশকে সাংস্কৃতিক জগতে তাঁর নাম সুপরিচিত ছিল।[১] প্রথম জীবনে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।[১২] দ্বিজেন্দ্রনাথ চলচ্চিত্রাভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরেরও পূর্বপুরুষ। দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্রী লতিকা ছিলেন শর্মিলা ঠাকুরের মাতামহী। %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A6%AD%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 আজি এ প্রভাতে প্রভাতবিহগ কী গান গাইল রে! অতিদূর দূর আকাশ হইতে ভাসিয়া আইল রে! না জানি কেমনে পশিল হেথায় পথহারা তার একটি তান, আঁধার গুহায় ভ্রমিয়া ভ্রমিয়া গভীর গুহায় নামিয়া নামিয়া আকুল হইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া ছুঁয়েছে আমার প্রাণ। আজি এ প্রভাতে সহসা কেন রে পথহারা রবিকর আলয় না পেয়ে পড়েছে আসিয়ে আমার প্রাণের ‘পর! বহুদিন পরে একটি কিরণ গুহায় দিয়েছে দেখা, পড়েছে আমার আঁধার সলিলে একটি কনকরেখা। প্রাণের আবেগ রাখিতে নারি থর থর করি কাঁপিছে বারি, টলমল জল করে থল থল, কল কল করি ধরেছে তান। আজি এ প্রভাতে কী জানি কেন রে জাগিয়া উঠেছে প্রাণ। জাগিয়া দেখিনু, চারিদিকে মোর পাষাণে রচিত কারাগার ঘোর, বুকের উপরে আঁধার বসিয়া করিছে নিজের ধ্যান। না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠেছে প্রাণ। জাগিয়া দেখিনু আমি আঁধারে রয়েছি আঁধা, আপনারি মাঝে আমি আপনি রয়েছি বাঁধা। রয়েছি মগন হয়ে আপনারি কলস্বরে, ফিরে আসে প্রতিধ্বনি নিজেরি শ্রবণ-’পরে। দূর দূর দূর হতে ভেদিয়া আঁধার কারা মাঝে মাঝে দেখা দেয় একটি সন্ধ্যার তারা। তারি মুখ দেখে দেখে আঁধার হাসিতে শেখে, তারি মুখ চেয়ে চেয়ে করে নিশি অবসান। শিহরি উঠে রে বারি,দোলে রে দোলে রে প্রাণ, প্রাণের মাঝারে ভাসি দোলে রে দোলে রে হাসি, দোলে রে প্রাণের ‘পরে আশার স্বপন মম, দোলে রে তারার ছায়া সুখের আভাস-সম। মাঝে মাঝে একদিন আকাশেতে নাই আলো, পড়িয়া মেঘের ছায়া কালো জল হয় কালো। আঁধার সলিল- ‘পরে ঝর ঝর বারি ঝরে ঝর ঝর ঝর ঝর,দিবানিশি অবিরল-- বরষার দুখ-কথা,বরষার আঁখিজল। শুয়ে শুয়ে আনমনে দিবানিশি তাই শুনি একটি একটি ক’রে দিবানিশি তাই গুনি, তারি সাথে মিলাইয়া কল কল গান গাই-- ঝর ঝর কল কল--দিন নাই, রাত নাই। এমনি নিজেরে লয়ে রয়েছি নিজের কাছে, আঁধার সলিল -‘পরে আঁধার জাগিয়া আছে। এমনি নিজের কাছে খুলেছি নিজের প্রাণ, এমনি পরের কাছে শুনেছি নিজের গান। আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত-পাখির গান। না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ। জাগিয়া উঠেছে প্রাণ, ওরে উথলি উঠেছে বারি, ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি। থর থর করি কাঁপিছে ভূধর, শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে, ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল গরজি উঠিছে দারুণ রোষে। হেথায় হোথায় পাগলের প্রায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়, বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার। প্রভাতেরে যেন লইতে কাড়িয়া আকাশেরে যেন ফেলিতে ছিঁড়িয়া উঠে শূন্যপানে---পড়ে আছাড়িয়া করে শেষে হাহাকার। প্রাণের উল্লাসে ছুটিতে চায় ভূধরের হিয়া টুটিতে চায়, আলিঙ্গন তরে ঊর্ধ্বে বাহু তুলি আকাশের পানে উঠিতে চায়। প্রভাতকিরণে পাগল হইয়া জগৎ-মাঝারে লুটিতে চায়। কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন, চারি দিকে তার বাঁধন কেন? ভাঙ্‌ রে হৃদয় ভাঙ্‌ রে বাঁধন, সাধ্‌ রে আজিকে প্রাণের সাধন, লহরীর পরে লহরী তুলিয়া আঘাতের পর আঘাত কর। মাতিয়া যখন উঠিছে পরান কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ ! উথলি যখন উঠিছে বাসনা, জগতে তখন কিসের ডর! সহসা আজি এ জগতের মুখ নূতন করিয়া দেখিনু কেন? একটি পাখির আধখানি তান জগতের গান গাহিল যেন! জগৎ দেখিতে হইব বাহির আজিকে করেছি মনে, দেখিব না আর নিজেরি স্বপন বসিয়া গুহার কোণে। আমি ঢালিব করুণাধারা, আমি ভাঙিব পাষাণকারা, আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া আকুল পাগল-পারা; কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া, রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া, রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া, দিব রে পরান ঢালি। শিখর হইতে শিখরে ছুটিব, ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি। তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া-- যাইব বহিয়া--যাইব বহিয়া-- হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া গাহিয়া গাহিয়া গান, যত দেব প্রাণ বহে যাবে প্রাণ ফুরাবে না আর প্রাণ। এত কথা আছে এত গান আছে এত প্রাণ আছে মোর, এত সুখ আছে এত সাধ আছে প্রাণ হয়ে আছে ভোর। এত সুখ কোথা এত রূপ কোথা এত খেলা কোথা আছে! যৌবনের বেগে বহিয়া যাইব কে জানে কাহার কাছে! অগাধ বাসনা অসীম আশা জগৎ দেখিতে চাই! জাগিয়াছে সাধ চরাচরময় প্লাবিয়া বহিয়া যাই। যত প্রাণ আছে ঢালিতে পারি, যত কাল আছে বহিতে পারি, যত দেশ আছে ডুবাতে পারি, তবে আর কিবা চাই! পরানের সাধ তাই। কী জানি কী হল আজি জাগিয়া উঠিল প্রাণ, দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান-- ‘পাষাণ-বাঁধন টুটি, ভিজায়ে কঠিন ধরা, বনেরে শ্যামল করি, ফুলেরে ফুটায়ে ত্বরা, সারাপ্রাণ ঢালি দিয়া, জুড়ায়ে জগৎ-হিয়া-- আমার প্রাণের মাঝে কে আসিবি আয় তোরা!’ আমি যাব, আমি যাব, কোথায় সে, কোন্‌ দেশ-- জগতে ঢালিব প্রাণ, গাহিব করুণাগান, উদ্‌বেগ-অধীর হিয়া সুদূর সমুদ্রে গিয়া সে প্রাণ মিশাব আর সে গান করিব শেষ। ওরে, চারি দিকে মোর এ কী কারাগার ঘোর ! ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ কারা, আঘাতে আঘাত কর্ ! ওরে,আজ কী গান গেয়েছে পাখি, এয়েছে রবির কর ! %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4_%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 অধিক করি না আশা, কিসের বিষাদ, জনমেছি দু দিনের তরে-- যাহা মনে আসে তাই আপনার মনে গান গাই আনন্দের ভরে। এ আমার গানগুলি দু দণ্ডের গান রবে না রবে না চিরদিন-- পুরব-আকাশ হতে উঠিবে উচ্ছ্বাস, পশ্চিমেতে হইবে বিলীন। তোরা ফুল, তোরা পাখি, তোরা খোলা প্রাণ, জগতের আনন্দ যে তোরা, জগতের বিষাদ-পাসরা। পৃথিবীতে উঠিয়াছে আনন্দলহরী তোরা তার একেকটি ঢেউ, কখন উঠিলি আর কখন মিলালি জানিতেও পারিল না কেউ। নাই তোর নাই রে ভাবনা, এ জগতে কিছুই মরে না। নদীস্রোতে কোটি কোটি মৃত্তিকার কণা ভেসে আসে, সাগরে মিশায়-- জান না কোথায় তারা যায়! একেকটি কণা লয়ে গোপনে সাগর রচিছে বিশাল মহাদেশ, না জানি কবে তা হবে শেষ! মুহূর্তেই ভেসে যায় আমাদের গান, জান না তো কোথায় তা যায়! আকাশের সাগরসীমায়! আকাশ-সমুদ্র-তলে গোপনে গোপনে গীতরাজ্য হতেছে সৃজন, যত গান উঠিতেছে ধরার আকাশে সেইখানে করিছে গমন। আকাশ পুরিয়া যাবে শেষ, উঠিবে গানের মহাদেশ। নাই তোর নাই রে ভাবনা, এ জগতে কিছুই মরে না। কাল দেখেছিনু পথে হরষে খেলিতেছিল দুটি ভাই গলাগলি করি দেখেছিনু জানালায় নীরবে দাঁড়ায়েছিল দুটি সখা হাতে হাতে ধরি, দেখেছিনু কচি মেয়ে মায়ের বাহুতে শুয়ে ঘুমায়ে করিছে স্তনপান, ঘুমন্ত মুখের ‘পরে বরষিছে স্নেহধারা স্নেহমাখা নত দু’নয়ান, দেখেছিনু রাজপথে চলেছে বালক এক বৃদ্ধ জনকের হাত ধরি-- কত কী যে দেখেছিনু, হয়তো সে-সব ছবি আজ আমি গিয়েছি পাসরি। তা বলে নাহি কি তাহা মনে? ছবিগুলি মেশেনি জীবনে? স্মৃতির কণিকা তারা স্মরণের তলে পশি রচিতেছে জীবন আমার-- কোথা যে কে মিশাইল, কেবা গেল কার পাশে চিনিতে পারি নে তাহা আর। হয়তো অনেকদিন দেখেছিনু ছবি এক দুটি প্রাণী বাহুর বাঁধনে-- তাই আজ ছুটাছুটি এসেছি প্রভাতে উঠি সখারে বাঁধিতে আলিঙ্গনে। হয়তো অনেক দিন শুনেছিনু পাখি এক আনন্দে গাহিছে প্রাণ খুলি, সহসা রে তাই আজ প্রভাতের মুখ দেখি প্রাণ মন উঠিছে উথুলি। সকলি মিশেছে আসি হেথা, জীবনে কিছু না যায় ফেলা-- এই-যে যা-কিছু চেয়ে দেখি এ নহে কেবলি ছেলেখেলা। এই জগতের মাঝে একটি সাগর আছে নিস্তব্ধ তাহার জলরাশি, চারি দিক হতে সেথা অবিরাম অবিশ্রাম জীবনের স্রোত মিশে আসি। সূর্য হতে ঝরে ধারা, চন্দ্র হতে ঝরে ধারা, কোটি কোটি তারা হতে ঝরে, জগতের যত হাসি যত গান যত প্রাণ ভেসে আসে সেই স্রোতোভরে-- মেশে আসি সেই সিন্ধু-’পরে। পৃথ্বী হতে মহাস্রোত ছুটিতেছে অবিরাম সেই মহাসাগর-উদ্দেশে, আমরা মাটির কণা জলস্রোত ঘোলা করি অবিশ্রাম চলিয়াছি ভেসে-- সাগরে পড়িব অবশেষে। জগতের মাঝখানে সেই সাগরের তলে রচিত হতেছে পলে পলে অনন্ত-জীবন মহাদেশ, কে জানে হবে কি তাহা শেষ! তাই বলি, প্রাণ ওরে, গান গা পাখির মতো, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ শোক ভুলি-- তুই যাবি, গান যাবে, একসাথে ভেসে যাবে তুই আর তোর গানগুলি। মিশিবি সে সিন্ধুজলে অনন্তসাগরতলে, একসাথে শুয়ে রবি প্রাণ, তুই আর তোর এই গান। %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%97%E0%A6%AE%E0%A6%A8%E0%A7%80_(%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A5_%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE) %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 সুধীরে নিশার আঁধার ভেদিয়া ফুটিল প্রভাততারা। হেথা হোথা হতে পাখিরা গাহিল ঢালিয়া সুধার ধারা। মৃদুল প্রভাতসমীর পরশে কমল নয়ন খুলিল হরষে, হিমালয় শিরে অমল আভায় শোভিল ধবল তুষারজটা। খুলি গেল ধীরে পূরবদ্বার, ঝরিল কনককিরণধার, শিখরে শিখরে জ্বলিয়া উঠিল, রবির বিমল কিরণছটা। গিরিগ্রাম আজি কিসের তরে, উঠেছে নাচিয়া হরষভরে, অচল গিরিও হয়েছে যেমন অধীর পাগল-পারা। তটিনী চলেছে নাচিয়া ছুটিয়া, কলরব উঠে আকাশে ফুটিয়া , ঝর ঝর ঝর করিয়া ধ্বনি ঝরিছে নিঝরধারা। তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া মালা, চলিয়াছে গিরিবাসিনী বালা, অধর ভরিয়া সুখের হাসিতে মাতিয়া সুখের গানে। মুখে একটিও নাহিকো বাণী শবদচকিতা মেনকারানী তৃষিত নয়নে আকুল হৃদয়ে, চাহিয়া পথের পানে। আজ মেনকার আদরিণী উমা আসিবে বরষ-পরে। তাইতে আজিকে হরষের ধ্বনি উঠিয়াছে ঘরে ঘরে। অধীর হৃদয়ে রানী আসে যায়, কভু বা প্রাসাদশিখরে দাঁড়ায়, কভু বসে ওঠে, বাহিরেতে ছোটে এখনো উমা মা এলনা কেন? হাসি হাসি মুখে পুরবাসীগণে অধীরে হাসিয়া ভূধরভবনে, "কই উমা কই' বলে "উমা কই', তিলেক বেয়াজ সহে না যেন! বরষের পরে আসিবেন উমা রানীর নয়নতারা , ছেলেবেলাকার সহচরী যত হরষে পাগল-পারা। ভাবিছে সকলে আজিকে উমায় দেখিবে নয়ন ভ'রে, আজিকে আবার সাজাব তাহায় বালিকা উমাটি ক'রে। তেমনি মৃণালবলয়-যুগলে, তেমনি চিকন-চিকন বাকলে, তেমনি করিয়া পরাব গলায় বনফুল তুলি গাঁথিয়া মালা। তেমনি করিয়া পরায়ে বেশ তেমনি করিয়া এলায়ে কেশ, জননীর কাছে বলিব গিয়ে "এই নে মা তোর তাপসী বালা'। লাজ-হাসি-মাখা মেয়ের মুখ হেরি উথলিবে মায়ের সুখ, হরষে জননী নয়নের জলে চুমিবে উমার সে মুখখানি। হরষে ভূধর অধীর-পারা হরষে ছুটিবে তটিনীধারা, হরষে নিঝর উঠিবে উছসি, উঠিবে উছসি মেনকারানী। কোথা তবে তোরা পুরবাসী মেয়ে যেথা যে আছিস আয় তোরা ধেয়ে বনে বনে বনে ফিরিবি বালা, তুলিবি কুসুম, গাঁথিবি মালা, পরাবি উমার বিনোদ গলে। তারকা-খচিত গগন-মাঝে শারদ চাঁদিমা যেমন সাজে তেমনি শারদা অবনী শশী শোভিবে কেমন অবনীতলে! ওই বুঝি উমা, ওই বুঝি আসে, দেখো চেয়ে গিরিরানী! আলুলিত কেশ, এলোথেলো বেশ, হাসি-হাসি মুখখানি। বালিকারা সব আসিল ছুটিয়া দাঁড়াল উমারে ঘিরি। শিথিল চিকুরে অমল মালিকা পরাইয়া দিল ধীরি। হাসিয়া হাসিয়া কহিল সবাই উমার চিবুক ধ'রে, "বলি গো স্বজনী, বিদেশে বিজনে আছিলি কেমন করে? আমরা তো সখি সারাটি বরষ রহিয়াছি পথ চেয়ে -- কবে আসিবেক আমাদের সেই মেনকারানীর মেয়ে! এই নে, সজনী, ফুলের ভূষণ এই নে, মৃণাল বালা, হাসিমুখখানি কেমন সাজিবে পরিলে কুসুম-মালা।' কেহ বা কহিল,"এবার স্বজনি, দিব না তোমায় ছেড়ে ভিখারি ভবের সর্বস্ব ধন আমরা লইব কেড়ে। বলো তো স্বজনী, এ কেমন ধারা এয়েছ বরষ-পরে, কেমনে নিদিয়া রহিবে কেবল তিনটি দিনের তরে।' কেহ বা কহিল,"বলো দেখি,সখী, মনে পড়ে ছেলেবেলা? সকলে মিলিয়া এ গিরিভবনে কত-না করেছি খেলা! সেই মনে পড়ে যেদিন স্বজনী গেলে তপোবন-মাঝে-- নয়নের জলে আমরা সকলে সাজানু তাপসী-সাজে। কোমল শরীরে বাকল পরিয়া এলায়ে নিবিড় কেশ লভিবারে পতি মনের মতন কত-না সহিলে ক্লেশ। ছেলেবেলাকার সখীদের সব এখনো তো মনে আছে, ভয় হয় বড়ো পতির সোহাগে ভুলিস তাদের পাছে!' কত কী কহিয়া হরষে বিষাদে চলিল আলয়-মুখে, কাঁদিয়া বালিকা পড়িল ঝাঁপায়ে আকুল মায়ের বুকে। হাসিয়া কাঁদিয়া কহিল রানী, চুমিয়া উমার অধরখানি, "আয় মা জননি আয় মা কোলে, আজ বরষের পরে। দুখিনী মাতার নয়নের জল তুই যদি, মা গো, না মুছাবি বল্‌ তবে উমা আর ,কে আছে আমার এ শূন্য আঁধার ঘরে? সারাটি বরষ যে দুখে গিয়াছে কী হবে শুনে সে ব্যথা, বল্‌ দেখি, উমা, পতির ঘরের সকল কুশল-কথা।' এত বলি রানী হরষে আদরে উমারে কোলেতে লয়ে, হরষের ধারা বরষি নয়নে পশিল গিরি-আলয়ে। আজিকে গিরির প্রাসাদে কুটিরে উঠিল হরষ-ধ্বনি, কত দিন পরে মেনকা-মহিষী পেয়েছে নয়নমণি! ভারতী, আশ্বিন, ১২৮৪ %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B2_%E0%A6%86%E0%A6%B9%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A8 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু বা কাবাডি। এই খেলার মতোই বাংলাদেশের অধিকাংশ নিজস্ব খেলাই উপকরণহীন কিংবা উপকরণের বাহুল্যবর্জিত। উপকরণবহুল খুব কম খেলাই বাংলাদেশের নিজস্ব খেলা। উপকরণহীন খেলার মধ্যে এক্কাদোক্কা, দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, কানামাছি, বরফ-পানি, বউচি, ছোঁয়াছুঁয়ি ইত্যাদি খেলা উল্লেখযোগ্য। উপকরণের বাহুল্যবর্জিত বা সীমিত সহজলভ্য উপকরণের খেলার মধ্যে ডাঙ্গুলি, সাতচাড়া, রাম-সাম-যদু-মধু বা চোর-ডাকাত-পুলিশ, মার্বেল খেলা, রিং খেলা ইত্যাদির নাম করা যায়। সাঁতার, বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায় ছাড়া, সাধারণ্যের কাছে আলাদা ক্রীড়া হিসেবে তেমন একটা মর্যাদা পায় না, যেহেতু বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবশ্যকীয়ভাবে সাঁতার শিখতে হয়। গৃহস্থালী খেলার মধ্যে লুডু, সাপলুডু, দাবা বেশ প্রচলিত। এছাড়া ক্রিকেট ও ফুটবলের মতো বিভিন্ন বিদেশী খেলাও এদেশে বেশ জনপ্রিয়। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল আইসিসি ট্রফি জয় করে, যার ফলে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো তাঁরা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। সেবার প্রথম পর্বে বাংলাদেশ স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে পরাজিত করে। এছাড়া ২০০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্ট ক্রিকেট খেলার মর্যাদা লাভ করে। ক্রিকেট দলের মধ্যে ধারাবাহিক সাফল্যের অভাব থাকলেও তাঁরা বিশ্বের প্রধান ক্রিকেট দলগুলোকে, যেমন: অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, নিউ জিল্যান্ড, শ্রীলংকাকে হারিয়ে এসেছে। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি দল ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে এবং ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংলেন্ডকে নাটকীয় ভাবে পরাজিত করে বিশ্বক্রিকেটে বিশেষ আলোচনার ঝড় তোলে। টেস্ট ক্রিকেট খেলার মর্যাদা লাভ করার পর এপর্যন্ত বাংলাদেশ তিনটি টেস্ট সিরিজ জয় করেছে। প্রথমটি জিম্বাবুয়ের সাথে ২০০৪-'০৫ খ্রিস্টাব্দে, দ্বিতীয়টি জুলাই ২০০৯-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপরীতে এবং তৃতীয়টি ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে জিম্বাবুয়েকে।[৭৪] অন্যান্য খেলার মধ্যে হকি, হ্যান্ডবল, সাঁতার, কাবাডি এবং দাবা উল্লেখযোগ্য। এযাবৎ ৫ জন বাংলাদেশী - নিয়াজ মোর্শেদ, জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, আবদুল্লাহ আল রাকিব এবং এনামুল হোসেন রাজীব - দাবায় গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাব লাভ করেছেন।[৭৫][৭৬][৭৭][৭৮] বাংলাদেশের খেলাধূলা নিয়ন্ত্রণ বোর্ড ২৯টি খেলাধূলা সংক্রান্ত ভিন্ন ভিন্ন ফেডারেশন নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশ, ২০১১ খ্রিস্টাব্দে যৌথভাবে ভারত ও শ্রীলংকার সাথে আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ এককভাবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজন করে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রাম ও চা-শিল্পের জন্য বিখ্যাত সিলেটে খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হয়। %%%% https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A5_%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B0 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 অভিমান ক'রে কোথায় গেলি, আয় মা ফিরে, আয় মা ফিরে আয়। দিন রাত কেঁদে কেঁদে ডাকি আয় মা ফিরে, আয় মা ফিরে আয়। সন্ধে হল, গৃহ অন্ধকার, মা গো, হেথায় প্রদীপ জ্বলে না। একে একে সবাই ঘরে এল, আমায় যে মা, "মা' কেউ বলে না। সময় হল বেঁধে দেব চুল, পরিয়ে দেব রাঙা কাপড়খানি। সাঁজের তারা সাঁজের গগনে -- কোথায় গেল, রানী আমার রানী! ও মা, রাত হল, আঁধার করে আসে, ঘরে ঘরে প্রদীপ নিবে যায়। আমার ঘরে ঘুম নেইকো শুধু -- শূন্য শেজ শূন্যপানে চায়। কোথায় দুটি নয়ন ঘুমে ভরা, সেই নেতিয়ে-পড়া ঘুমিয়ে-পড়া মেয়ে। শ্রান্ত দেহ ঢুলে ঢুলে পড়ে, তবু মায়ের তরে আছে বুঝি চেয়ে। আঁধার রাতে চলে গেলি তুই, আঁধার রাতে চুপি চুপি আয়। কেউ তো তোরে দেখতে পাবে না, তারা শুধু তারার পানে চায়। পথে কোথাও জনপ্রাণী নেই, ঘরে ঘরে সবাই ঘুমিয়ে আছে। মা তোর শুধু একলা দ্বারে বসে, চুপি চুপি আয় মা, মায়ের কাছে। আমি তোরে নুকিয়ে রেখে দেব, রেখে দেব বুকের মধ্যে করে -- থাক্‌, মা, সে তার পাষাণ হৃদি নিয়ে অনাদর যে করেছে তোরে। মলিন মুখে গেলি তাদের কাছে -- তবু তারা নিলে না মা কোলে? বড়ো বড়ো আঁখি দুখানি রইলি তাদের মুখের পানে তুলে? এ জগৎ কঠিন -- কঠিন -- কঠিন, শুধু মায়ের প্রাণ ছাড়া। সেইখানে তুই আয় মা ফিরে আয় -- এত ডাকি দিবি নে কি সাড়া? হে ধরণী, জীবের জননী, শুনেছি যে মা তোমায় বলে। তবে কেন তোর কোলে সবে কেঁদে আসে কেঁদে যায় চলে। তবে কেন তোর কোলে এসে সন্তানের মেটে না পিপাসা। কেন চায় -- কেন কাঁদে সবে, কেন কেঁদে পায় না ভালোবাসা। কেন হেথা পাষাণ পরান কেন সবে নীরস নিষ্ঠুর! কেঁদে কেঁদে দুয়ারে যে আসে কেন তারে করে দেয় দূর! কেঁদে যে-জন ফিরে চলে যায়, তার তরে কাঁদিস নে কেহ -- এই কি মা জননীর প্রাণ! এই কি মা জননীর স্নেহ! ফুলের দিনে সে যে চলে গেল, ফুল ফোটা সে দেখে গেল না। ফুলে ফুলে ভরে গেল বন, একটি সে তো পরতে পেল না। ফুল ফোটে, ফুল ঝরে যায় -- ফুল নিয়ে আর সবাই পরে। ফিরে এসে সে যদি দাঁড়ায়, একটিও রবে না তার তরে! তার তরে মা কেবল আছে, আছে শুধু জননীর স্নেহ, আছে শুধু মা'র অশ্রুজল -- কিছু নাই, নাই আর কেহ। খেলত যারা তারা খেলতে গেছে, হাসত যারা তারা আজও হাসে, তার তরে কেহ ব'সে নেই, মা শুধু রয়েছে তারি আশে! হায় বিধি, এ কি ব্যর্থ হবে! ব্যর্থ হবে মা'র ভালোবাসা! কত জনের কত আশা পুরে, ব্যর্থ হবে মার প্রাণের আশা! বালক , আশ্বিন-কার্তিক, ১২৯২ %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 লতার লাবণ্য যেন কচি কিশলয়ে ঘেরা , সুকুমার প্রাণ তার মাধুরীতে ঢেকেছে- কোমল মুকুলগুলি চারি দিকে আকুলিত তারি মাঝে প্রাণ যেন লুকিয়ে রেখেছে । ওরে যেন ভালো করে দেখা যায় না , আঁখি যেন ডুবে গিয়ে কূল পায় না । সাঁঝের আভা নেমে এল , জ্যোৎস্না পাশে ঘুমিয়ে প ' ল , ফুলের গন্ধ দেখতে এসেছে , তারাগুলি ঘিরে বসেছে । পূরবী রাগিণীগুলি দূর হতে চলে আসে ছুঁতে তারে হয় নাকো ভরসা- কাছে কাছে ফিরে ফিরে মুখপানে চায় তারা , যেন তারা মধুময়ী দুরাশা । ঘুমন্ত প্রাণেরে ঘিরে স্বপ্নগুলি ঘুরে ফিরে গাঁথে যেন আলোকের কুয়াশা , ঢেকে তারে আছে কত , চারি দিকে শত শত অনিমিষ নয়নের পিয়াসা । ওদের আড়াল থেকে আবছায়া দেখা যায় অতুলন প্রাণের বিকাশ , সোনার মেঘের মাঝে কচি উষা ফোটে ফোটে পুরবেতে তাহারি আভাস । আলোকবসনা যেন আপনি সে ঢাকা আছে আপনার রূপের মাঝার , রেখা রেখা হাসিগুলি আশেপাশে চমকিয়ে রূপেতেই লুকায় আবার । আঁখির আলোকছায়া আঁখিরে রয়েছে ঘিরে , তারি মাঝে দৃষ্টি পথহারা , যেথা চলে স্বর্গ হতে অবিরাম পড়ে যেন লাবণ্যের পুষ্পবারিধারা । ধরণীরে ছুঁয়ে যেন পা দুখানি ভেসে যায় , কুসুমের স্রোত বহে যায় , কুসুমেরে ফেলে রেখে খেলাধুলা ভুলে গিয়ে মায়ামুগ্ধ বসন্তের বায় । ওরে কিছু শুধাইলে বুঝি রে নয়ন মেলি দু দণ্ড নীরবে চেয়ে রবে , অতুল অধর দুটি ঈষৎ টুটিয়ে বুঝি অতি ধীরে দুটি কথা কবে । আমি কি বুঝি সে ভাষা , শুনিতে কি পাব বাণী সে যেন কিসের প্রতিধ্বনি — মধুর মোহের মতো যেমনি ছুঁইবে প্রাণ ঘুমায়ে সে পড়িবে অমনি । হৃদয়ের দূর হতে সে যেন রে কথা কয় তাই তার অতি মৃদুস্বর , বায়ুর হিল্লোলে তাই আকুল কুমুদসম কথাগুলি কাঁপে থর থর । কে তুমি গো উষাময়ী , আপন কিরণ দিয়ে আপনারে করেছ গোপন , রূপের সাগর-মাঝে কোথা তুমি ডুবে আছ একাকিনী লক্ষ্মীর মতন! ধীরে ধীরে ওঠো দেখি , একবার চেয়ে দেখি স্বর্ণজ্যোতি-কমল-আসন , সুনীল সলিল হতে ধীরে ধীরে উঠে যথা প্রভাতের বিমল কিরণ । সৌন্দর্যকোরক টুটে এস গো বাহির হয়ে অনুপম সৌরভের প্রায় , আমি তাহে ডুবে যাব সাথে সাথে বহে যাব উদাসীন বসন্তের বায় । %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%9C_%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0_%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A6%A4%E0%A6%BF_%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A6%A3_%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8B,_%E0%A6%AA%E0%A7%83%E0%A6%A5%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A7%80 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো, পৃথিবী, শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে। মহাবীর্যবতী, তুমি বীরভোগ্যা, বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে, মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি পুরুষে নারীতে; মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দুঃসহ দ্বন্দ্বে। ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা বাম হাতে পূর্ণ কর পাত্র, তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রূপে; দুঃসাধ্য কর বীরের জীবনকে মহৎজীবনে যার অধিকার। শ্রেয়কে কর দুর্মূল্য, কৃপা কর না কৃপাপাত্রকে। তোমার গাছে গাছে প্রচ্ছন্ন রেখেছ প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম, ফলে শস্যে তার জয়মাল্য হয় সার্থক। জলে স্থলে তোমার ক্ষমাহীন রণরঙ্গভূমি, সেখানে মৃত্যুর মুখে ঘোষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা। তোমার নির্দয়তার ভিত্তিতে উঠেছে সভ্যতার জয়তোরণ, ত্রুটি ঘটলে তার পূর্ণ মূল্য শোধ হয় বিনাশে। তোমার ইতিহাসের আদিপর্বে দানবের প্রতাপ ছিল দুর্জয়, সে পরুষ, সে বর্বর, সে মূঢ়। তার অঙ্গুলি ছিল স্থূল, কলাকৌশলবর্জিত; গদা-হাতে মুষল-হাতে লন্ডভন্ড করেছে সে সমুদ্র পর্বত; অগ্নিতে বাষ্পেতে দুঃস্বপ্ন ঘুলিয়ে তুলেছে আকাশে। জড়রাজত্বে সে ছিল একাধিপতি, প্রাণের 'পরে ছিল তার অন্ধ ঈর্ষা। দেবতা এলেন পরযুগে-- মন্ত্র পড়লেন দানবদমনের, জড়ের ঔদ্ধত্য হল অভিভূত; জীবধাত্রী বসলেন শ্যামল আস্তরণ পেতে। উষা দাঁড়ালেন পূর্বাচলের শিখরচূড়ায়, পশ্চিমসাগরতীরে সন্ধ্যা নামলেন মাথায় নিয়ে শান্তিঘট। নম্র হল শিকলে-বাঁধা দানব, তবু সেই আদিম বর্বর আঁকড়ে রইল তোমার ইতিহাস। ব্যবস্থার মধ্যে সে হঠাৎ আনে বিশৃঙ্খলতা, তোমার স্বভাবের কালো গর্ত থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসে এঁকেবেঁকে। তোমার নাড়ীতে লেগে আছে তার পাগলামি। দেবতার মন্ত্র উঠছে আকাশে বাতাসে অরণ্যে দিনে রাত্রে উদাত্ত অনুদাত্ত মন্দ্রস্বরে। তবু তোমার বক্ষের পাতাল থেকে আধপোষা নাগদানব ক্ষণে ক্ষণে উঠছে ফণা তুলে, তার তাড়নায় তোমার আপন জীবকে করছ আঘাত, ছারখার করছ আপন সৃষ্টিকে। শুভে অশুভে স্থাপিত তোমার পাদপীঠে, তোমার প্রচণ্ড সুন্দর মহিমার উদ্দেশে আজ রেখে যাব আমার ক্ষতচিহ্নলাঞ্ছিত জীবনের প্রণতি। বিরাট প্রাণের, বিরাট মৃত্যুর গুপ্তসঞ্চার তোমার যে মাটির তলায় তাকে আজ স্পর্শ করি, উপলব্ধি করি সর্ব দেহে মনে। অগণিত যুগযুগান্তরের অসংখ্য মানুষের লুপ্ত দেহ পুঞ্জিত তার ধুলায়। আমিও রেখে যাব কয় মুষ্টি ধূলি আমার সমস্ত সুখদুঃখের শেষ পরিণাম-- রেখে যাব এই নামগ্রাসী,আকারগ্রাসী,সকল-পরিচয়-গ্রাসী নিঃশব্দ মহাধূলিরাশির মধ্যে। অচল অবরোধে আবদ্ধ পৃথিবী, মেঘলোকে উধাও পৃথিবী, গিরিশৃঙ্গমালার মহৎ মৌনে ধ্যানমগ্না পৃথিবী, নীলাম্বুরাশির অতন্দ্রতরঙ্গে কলমন্দ্রমুখরা পৃথিবী, অন্নপূর্ণা তুমি সুন্দরী, অন্নরিক্তা তুমি ভীষণা। এক দিকে আপক্কধান্যভারনম্র তোমার শস্যক্ষেত্র, সেখানে প্রসন্ন প্রভাতসূর্য প্রতিদিন মুছে নেয় শিশিরবিন্দু কিরণ-উত্তরীয় বুলিয়ে দিয়ে। অস্তগামী সূর্য শ্যামশস্যহিল্লোলে রেখে যায় অকথিত এই বাণী-- "আমি আনন্দিত'। অন্য দিকে তোমার জলহীন ফলহীন আতঙ্কপান্ডুর মরুক্ষেত্রে পরিকীর্ণ পশুকঙ্কালের মধ্যে মরীচিকার প্রেতনৃত্য। বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুৎচঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল কালো শ্যেনপাখির মতো তোমার ঝড়, সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন কেশর-ফোলা সিংহ, তার লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু ক'রে হতাশ বনস্পতি ধুলায় পড়ল উবুড় হয়ে। হাওয়ার মুখে ছুটল ভাঙা কুঁড়ের চাল শিকল-ছেঁড়া কয়েদি-ডাকাতের মতো। আবার ফাল্গুনে দেখেছি তোমার আতপ্ত দক্ষিনে হাওয়া ছড়িয়ে দিয়েছে বিরহমিলনের স্বগতপ্রলাপ আম্রমুকুলের গন্ধে। চাঁদের পেয়ালা ছাপিয়ে দিয়ে উপচিয়ে পড়েছে স্বর্গীয় মদের ফেনা। বনের মর্মরধ্বনি ঝঞ্ঝাবায়ুর স্পর্ধায় ধৈর্য হারিয়েছে অকস্মাৎ কল্লোচ্ছ্বাসে। স্নিগ্ধ তুমি, হিংস্র তুমি, পুরাতনী, তুমি নিত্যনবীনা, অনাদি সৃষ্টির যজ্ঞহুতাগ্নি থেকে বেরিয়ে এসেছিলে সংখ্যাগণনার অতীত প্রত্যুষে, তোমার চক্রতীর্থের পথে পথে ছড়িয়ে এসেছ শতশত ভাঙা ইতিহাসের অর্থলুপ্ত অবশেষ-- বিনা বেদনায় বিছিয়ে এসেছ তোমার বর্জিত সৃষ্টি অগণ্য বিস্মৃতির স্তরে স্তরে। জীবপালিনী, আমাদের পুষেছ তোমার খণ্ডকালের ছোটো ছোটো পিঞ্জরে। তারই মধ্যে সব খেলার সীমা, সব কীর্তির অবসান। আজ আমি কোনো মোহ নিয়ে আসি নি তোমার সম্মুখে, এতদিন যে দিনরাত্রির মালা গেঁথেছি বসে বসে তার জন্যে অমরতার দাবি করব না তোমার দ্বারে। তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্যপ্রদক্ষিণের পথে যে বিপুল নিমেষগুলি উন্মীলিত নিমীলিত হতে থাকে তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোনো একটি আসনের সত্যমূল্য যদি দিয়ে থাকি, জীবনের কোনো একটি ফলবান খণ্ডকে যদি জয় করে থাকি পরম দুঃখে তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে; সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে যে রাত্রে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে। হে উদাসীন পৃথিবী, আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে তোমার নির্মম পদপ্রান্তে আজ রেখে যাই আমার প্রণতি। শান্তিনিকেতন, ১৬ অক্টোবর ১৯৩৫ %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0_%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BF %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 আতার বিচি নিজে পুঁতে পাব তাহার ফল, দেখব ব'লে ছিল মনে বিষম কৌতূহল। তখন আমার বয়স ছিল নয়, অবাক লাগত কিছুর থেকে কেন কিছুই হয়। দোতলাতে পড়ার ঘরের বারান্দাটা বড়ো, ধুলো বালি একটা কোণে করেছিলুম জড়ো। সেথায় বিচি পুঁতেছিলুম অনেক যত্ন করে, গাছ বুঝি আজ দেখা দেবে, ভেবেছি রোজ ভোরে। জানলাটার পূর্বধারে টেবিল ছিল পাতা, সেইখানেতে পড়া চলত; পুঁথিপত্র খাতা রোজ সকালে উঠত জমে দুর্ভাবনার মতো; পড়া দিতেন, পড়া নিতেন মাস্টার মন্মথ। পড়তে পড়তে বারে বারে চোখ যেত ঐ দিকে, গোল হত সব বানানেতে, ভুল হত সব ঠিকে। অধৈর্য অসহ্য হত, খবর কে তার জানে কেন আমার যাওয়া-আসা ঐ কোণটার পানে। দু মাস গেল, মনে আছে, সেদিন শুক্রবার-- অঙ্কুরটি দেখা দিল নবীন সুকুমার। অঙ্ক-কষার বারান্দাতে চুনসুরকির কোণে অপূর্ব সে দেখা দিল, নাচ লাগালো মনে। আমি তাকে নাম দিয়েছি আতা গাছের খুকু, ক্ষণে ক্ষণে দেখতে যেতেম, বাড়ল কতটুকু। দুদিন বাদেই শুকিয়ে যেত সময় হলে তার, এ জায়গাতে স্থান নাহি ওর করত আবিষ্কার; কিন্তু যেদিন মাস্টার ওর দিলেন মৃত্যুদণ্ড, কচিকচি পাতার কুঁড়ি হল খণ্ড খণ্ড, আমার পড়ার ত্রুটির জন্যে দায়ী করলেন ওকে, বুক যেন মোর ফেটে গেল, অশ্রু ঝরল চোখে। দাদা বললেন, কী পাগলামি, শান-বাঁধানো মেঝে, হেথায় আতার বীজ লাগানো ঘোর বোকামি এ যে। আমি ভাবলুম সারা দিনটা বুকের ব্যথা নিয়ে, বড়োদের এই জোর খাটানো অন্যায় নয় কি এ। মূর্খ আমি ছেলেমানুষ, সত্য কথাই সে তো, একটু সবুর করলেই তা আপনি ধরা যেত। শ্রাবণ, ১৩৪৪ %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%A3 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 আমি এ কেবল মিছে বলি, শুধু আপনার মন ছলি। কঠিন বচন শুনায়ে তোমারে আপন মর্মে জ্বলি। থাক্‌ তবে থাক্‌ ক্ষীণ প্রতারণা, কী হবে লুকায়ে বাসনা বেদনা, যেমন আমার হৃদয়-পরান তেমনি দেখাব খুলি। আমি মনে করি যাই দূরে, তুমি রয়েছ বিশ্ব জুড়ে। যত দূরে যাই ততই তোমার কাছাকাছি ফিরি ঘুরে। চোখে চোখে থেকে কাছে নহ তবু, দূরেতে থেকেও দূর নহ কভু, সৃষ্টি ব্যাপিয়া রয়েছ তবুও আপন অন্তঃপুরে। আমি যেমনি করিয়া চাই, আমি যেমনি করিয়া গাই, বেদনাবিহীন ওই হাসিমুখ সমান দেখিতে পাই। ওই রূপরাশি আপনা বিকাশি রয়েছে পূর্ণ গৌরবে ভাসি, আমার ভিখারি প্রাণের বাসনা হোথায় না পায় ঠাঁই। শুধু ফুটন্ত ফুল-মাঝে দেবী, তোমার চরণ সাজে। অভাবকঠিন মলিন মর্ত কোমল চরণে বাজে। জেনে শুনে তবু কী ভ্রমে ভুলিয়া আপনারে আমি এনেছি তুলিয়া, বাহিরে আসিয়া দরিদ্র আশা লুকাতে চাহিছে লাজে। তবু থাক্‌ পড়ে ওইখানে, চেয়ে তোমার চরণ-পানে। যা দিয়েছি তাহা গেছে চিরকাল আর ফিরিবে না প্রাণে। তবে ভালো করে দেখো একবার দীনতা হীনতা যা আছে আমার, ছিন্ন মলিন অনাবৃত হিয়া অভিমান নাহি জানে। তবে লুকাব না আমি আর এই ব্যথিত হৃদয়ভার। আপনার হাতে চাব না রাখিতে আপনার অধিকার। বাঁচিলাম প্রাণে তেয়াগিয়া লাজ, বদ্ধ বেদনা ছাড়া পেল আজ, আশা-নিরাশায় তোমারি যে আমি জানাইনু শত বার। %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A3%E0%A7%80 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 একটুখানি সোনার বিন্দু , একটুখানি মুখ , একা একটি বনফুল ফোটে-ফোটে হয়েছে , কচি কচি পাতার মাঝে মাথা থুয়ে রয়েছে । চার দিকে তার গাছের ছায়া , চার দিকে তার নিষুতি, চার দিকে তার ঝোপেঝাপে আঁধার দিয়ে ঢেকেছে— বনের সে যে স্নেহের ধন আদরিণী মেয়ে , তারে বুকের কাছে লুকিয়ে যেন রেখেছে । একটুখানি রূপের হাসি আঁধারেতে ঘুমিয়ে আলা , বনের স্নেহ শিয়রেতে জেগে আছে । সুকুমার প্রাণটুকু তার কিছু যেন জানে না , চোখে শুধু সুখের স্বপন লেগে আছে । একটি যেন রবির কিরণ ভোরের বেলা বনের মাঝে খেলাতেছিল নেচে নেচে , নিরালাতে গাছের ছায়ে , আঁধারেতে শ্রান্তকায়ে সে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে । বনদেবী করুণ-হিয়ে তারে যেন কুড়িয়ে নিয়ে যতন করে আপন ঘরেতে । থুয়ে কোমল পাতার'পরে মায়ের মতো স্নেহভরে ছোঁয় তারে কোমল করেতে । ধীরি ধীরি বাতাস গিয়ে আসে তারে দোলা দিয়ে , চোখেতে চুমো খেয়ে যায় । ঘুরে ফিরে আশেপাশে বার বার ফিরে আসে , হাতটি বুলিয়ে দেয় গায় । একলা পাখি গাছের শাখে কাছে তোর বসে থাকে , সারা দুপুরবেলা শুধু ডাকে , যেন তার আর কেহ নাই , সারা দিন একলাটি তাই স্নেহভরে তোরে নিয়েই থাকে । ও পাখির নাম জানি নে , কোথায় ছিল কে তা জানে , রাতের বেলায় কোথায় চলে যায় , দুপুরবেলা কাছে আসে- সারা দিন বসে পাশে একটি শুধু আদরের গান গায় । রাতে কত তারা ওঠে , ভোরের বেলা চলে যায়- তোরে তো কেউ দেখে না , জানে না । এক কালে তুই ছিলি যেন ওদেরই ঘরের মেয়ে , আজকে রে তুই অজানা অচেনা । নিত্যি দেখি রাতের বেলা একটি শুধু জোনাই আসে , আলো দিয়ে মুখপানে তোর চায় । কে জানে সে কী যে করে! তারা-জন্মের কাহিনী তোর কানে বুঝি স্বপন দিয়ে যায় । ভোরের বেলা আলো এল , ডাকছে রে তোর নামটি ধরে , আজকে তবে মুখখানি তোর তোল্‌ , আজকে তবে আঁখিটি তোর খোল্‌ , লতা জাগে , পাখি জাগে গায়ের কাছে বাতাস লাগে , দেখি রে — ধীরে ধীরে দোল্‌ দোল্‌ দোল্‌ । %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AA-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%B0_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A5%E0%A6%AE_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 য়ুরোপ-প্রবাসীর প্রথম পত্র বিশে সেপ্টেম্বরে আমরা ‘পুনা’ স্টীমারে উঠলেম। পাঁচটার সময় জাহাজ ছেড়ে দিলে। আমরা তখন জাহাজের ছাতে দাঁড়িয়ে। আস্তে আস্তে আমাদের চোখের সামনে ভারতবর্ষের শেষ তটরেখা মিলিয়ে গেল। চারিদিকের লোকের কোলাহল সইতে না পেরে আমি আমার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেম। গোপন করবার বিশেষ প্রয়োজন দেখছিনে, আমার মনটা বড়োই কেমন নির্জীব, অবসন্ন, ম্রিয়মান হয়ে পড়েছিল, কিন্তু দূর হোক্ গে-ও-সব করুণরসাত্মক কথা লেখবার অবসরও নেই ইচ্ছেও নেই; আর লিখলেও হয় তোমার চোখের জল থাকবে না, নয় তোমার ধৈর্য থাকবে না। সমুদ্রের পায়ে দণ্ডবৎ। ২০শে থেকে ২৬শে পর্যন্ত যে করে কাটিয়েছি তা আমিই জানি। ‘সমুদ্রপীড়া’ কাকে বলে অবিশ্যি জানো কিন্তু কী রকম তা জান না। আমি সেই ব্যামোয় পড়েছিলেম, সে-কথা বিস্তারিত করে লিখলে পাষাণেরও চোখে জল আসবে। ছটা দিন, মশায়, শয্যা থেকে উঠি নি। যে ঘরে থাকতেম, সেটা অতি অন্ধকার, ছোটো, পাছে সমুদ্রের জল ভিতরে আসে তাই চারদিকের জানলা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। অসূর্যম্পশ্যরূপ ও অবায়ুস্পর্শদেহ হয়ে ছয়টা দিন কেবল বেঁচে ছিলেম মাত্র। প্রথম দিন সন্ধ্যেবেলায় আমাদের একজন সহযাত্রী আমাকে জোর করে বিছানা থেকে উঠিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে গেলেন। যখন উঠে দাঁড়ালেম তখন আমার মাথার ভিতর যা-কিছু আছে সবাই মিলে যেন মারামারি কাটাকাটি আরম্ভ করে দিলে, চোখে দেখতে পাই নে, পা চলে না, সর্বাঙ্গ টলমল করে! দু-পা গিয়েই একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লেম। আমার সহযাত্রীটি আমাকে ধরাধরি করে জাহাজের ডেক-এ অর্থাৎ হাতে নিয়ে গেলেন। একটা রেলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেম। তখন অন্ধকার রাত। আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন। আমাদের প্রতিকূলে বাতাস বইছে। সেই অন্ধকারের মধ্যে সেই নিরাশ্রয় অকূল সমুদ্রে দুই দিকে অগ্নি উৎক্ষিপ্ত করতে করতে আমাদের জাহাজ একলা চলেছে; যেখানে চাই সেইদিকেই অন্ধকার, সমুদ্র ফুলে ফুলে উঠছে—সে এক মহা গম্ভীর দৃশ্য। সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারলেম না। মাথা ঘুরতে লাগল। ধরধরি করে আবার আমার ক্যাবিনে এলেম। সেই যে বিছানায় পড়লেম, ছ-দিন আর এক মুহূর্তের জন্যও মাথা তুলি নি। আমাদের যে স্টুঅর্ড ছিল (যাত্রীদের সেবক)—কারণ জানি নে—আমার উপর তার বিশেষ কৃপাদৃষ্টি ছিল। দিনের মধ্যে যখন-তখন সে আমার জন্যে খাবার নিয়ে উপস্থিত করত; না খেলে কোনোমতেই ছাড়ত না। সে বলত, না খেলে আমি ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়ব (weak as a rat)। সে বলত, সে আমার জন্যে সব কাজ করতে পারে। আমি তাকে যথেষ্ট সাধুবাদ দিতেম, এবং জাহাজ ছেড়ে আসবার সময় সাধুবাদের চেয়ে আরো কিঞ্চিৎ সারবান পদার্থ দিয়েছিলেম। ছ-দিনের পর আমরা যখন এডেনের কাছাকাছি পৌঁছলেম, তখন সমুদ্র কিছু শান্ত হল। সেদিন আমার স্টুঅর্ড এসে নড়ে চড়ে বেড়াবার জন্যে আমাকে বার বার অনুরোধ করতে লাগল। আমি তার পরামর্শ শুনে বিছানা থেকে তো উঠলেম, উঠে দেখি যে সত্যিই ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছি। মাথা যেন ধার-করা, কাঁধের সঙ্গে তার ভালো রকম বনে না; চুরি-করা কাপড়ের মতো শরীরটা যেন আমার ঠিক গায়ে লাগছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতের উপর গিয়ে একটা কেদারায় হেলান দিয়ে পড়লেম। অনেক দিনের পর বাতাস পেয়ে বাঁচলেম। দুপুরবেলা দেখি একটা ছোটো নৌকা সেই সমুদ্র দিয়ে চলেছে। চারদিকে অনেক দূর পর্যন্ত আর ডাঙা নেই, জাহাজসুদ্ধ লোক অবাক। তারা আমাদের স্টীমারকে ডাকতে আরম্ভ করলে, জাহাজ থামল। তারা একটি ছোটো নৌকায় করে কতকগুলি লোক জাহাজে পাঠিয়ে দিলে। এরা সকলে আরবদেশীয়, এডেন থেকে মস্কটে যাচ্ছে। পথের মধ্যে দিক্‌ভ্রম হয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে যা জলের পিপে ছিল, তা ভেঙে গিয়ে জল সমস্ত নষ্ট হয়ে গেছে, অথচ যাত্রী অনেক। আমাদের জাহাজের লোকেরা তাদের জল দিলে। একটি ম্যাপ খুলে কোন্‌ দিকে ও কত দূরে মস্কট, তাদের দেখিয়ে দিলে, তারা আবার চলতে লাগল। সে নৌকো যে মস্কট পর্যন্ত পৌঁছবে তাতে সকলেই সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগল। ২৮শে সেপ্টেম্বর শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি, আমাদের সম্মুখে সব পাহাড়-পর্বত উঠেছে। অতি সুন্দর পরিষ্কার প্রভাত, সূর্য সবেমাত্র উঠেছে, সমুদ্র অতিশয় শান্ত। দূর থেকে সেই পর্বতময় ভূভাগের প্রভাতদৃশ্য এমন সুন্দর দেখাচ্ছে যে কী বলব। পর্বতের উপর রঙিন মেঘগুলি এমন নত হয়ে পড়েছে যে, মনে হয় যেন অপরিমিত সূর্যকিরণ পান করে তাদের আর দাঁড়াবার শক্তি নেই, পর্বতের উপরে যেন অবসন্ন হয়ে পড়েছে। আয়নার মতো পরিষ্কার শান্ত সমুদ্রের উপর ছোটা ছোটো পাল তোলা নৌকোগুলি আবার কেমন ছবির মতো দেখাচ্ছে। এডেনে পৌঁছে বাড়ীতে চিঠি লিখতে আরম্ভ করলেম কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখি যে এই ক-দিন নাড়াচাড়া খেয়ে মাথার ভিতরে যেন সব উল্‌টোপাল্‌টা হয়ে গেছে, বুদ্ধির রাজ্যে একটা অরাজকতা ঘটেছে। কী করে লিখব, ভালো মনে আসছে না। ভাবগুলো যেন মাকড়সার জালের মতো, ছুঁতে গেলেই অমনি ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে। কিসের পর কী লিখব, তার একটা ভালোরকম বন্দোবস্ত করতে পারছি নে। এই অবস্থায় লিখতে আরম্ভ করলেম, এমন বিপদে পড়ে তোমাকে যে লিখতে পারি নি তাতে তোমার ক্ষোভের কারণ কিছুই নেই। দেখো, সমুদ্রের উপর আমার কতকটা অশ্রদ্ধা হয়েছে। কল্পনায় সমুদ্রকে যা মনে করতেম, সমুদ্রে এসে দেখি তার সঙ্গে অনেক বিষয় মেলে না। তীর থেকে সমুদ্রকে খুব মহান বলে মনে হয়, কিন্তু সমুদ্রের মধ্যে এলে আর ততটা হয় না। তার কারণ আছে; আমি যখন বম্বের উপকূলে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতেম, তখন দেখতেম দূরদিগন্তে গিয়ে নীল জল নীল আকাশে মিশিয়ে গিয়েছে, কল্পনায় মনে করতেম যে, এক বার যদি ঐ দিগন্তের আবরণ ভেদ করতে পারি, ও দিগন্তের যবনিকা ওঠাতে পারি, অমনি আমার সুমুখে এক অকূল অনন্ত সমুদ্র একেবার উথলে উঠবে। ঐ দিগন্তের পরে যে কী আছে তা আমার কল্পনাতেই থাকত; তখন মনে হত না, ঐ দিগন্তের পরে আর-এক দিগন্ত আসবে। কিন্তু যখন সমুদ্রের মধ্যে এসে পড়ি, তখন মনে হয় যে, জাহাজ যেন চলছে না, কেবল একটি দিগন্তের গণ্ডির মধ্যে বাঁধা আছে। আমাদের কল্পনার পক্ষে সে দিগন্তের সীমা এত সংকীর্ণ যে কেমন তৃপ্ত হয় না। কিন্তু দেখো, এ কথা বড়ো গোপনে রাখা উচিত; বাল্মীকি থেকে বায়রন পর্যন্ত সকলেরই যদি এই সমুদ্র দেখে ভাব লেগে থাকে, তবে আমার না লাগলে দশজনে যে হেসে উঠবে; গ্যালিলিওর সময়ে এ-কথা বললে হয়তো আমাকে কয়েদ যেতে হত। এত কবি সমুদ্রের স্তুতিবাদ করেছেন যে আজ আমার এই নিন্দায় তাঁর বোধ হয় বড়ো একটা গায়ে লাগবে না। যখন তরঙ্গ ওঠে, তখন বোধ করি সমুদ্র বেশ দেখায়, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যক্রমে সমুদ্রের তরঙ্গ উঠলেই আমার এমন মাথা ঘুরতে থাকে যে আমার দেখাশুনো সব ঘুরে যায়। আমি যখন ঘর থেকে বেরোতে আরম্ভ করলেম, তখন জাহাজের যাত্রীদের উপর আমার নজর পড়ল ও আমার উপর জাহাজের যাত্রীদের নজর পড়ল। আমি স্বভাবতই ‘লেডি’ জাতিকে বড়ো ডরাই। তাঁদের কাছে ঘেঁষতে গেলে এত প্রকার বিপদের সম্ভাবনা যে, চাণক্য পণ্ডিত থাকলে লেডিদের কাছ থেকে দশ সহস্র হস্ত দূরে থাকতে পরামর্শ দিতেন। এক তো মনোরাজ্যে নানাপ্রকার শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা—তা ছাড়া সর্বদাই ভয় হয় পাছে কী কথা বলতে কী কথা বলে ফেলি, আর আমাদের অসহিষ্ণু লেডি তাঁদের আদবকায়দার তিলমাত্র ব্যতিক্রম সইতে না পেরে দারুণ ঘৃণায় ও লজ্জায় একেবারে অভিভূত হন। পাছে তাঁদের গাউনের অরণ্যের মধ্যে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই, পাছে আহারের সময় তাঁদের মাংস কেটে দিতে হয়, পাছে মুরগির মাংস কাটতে গিয়ে নিজের আঙুল কেটে বসি—এইরকম সাত-পাঁচ ভেবে আমি জাহাজের লেডিদের কাছ থেকে অতি দূরে থাকতেম। আমাদের জাহাজে লেডির অভাব ছিল না, কিন্তু জেন্টলম্যানেরা সর্বদা খুঁত খুঁত করতেন যে, তার মধ্যে অল্পবয়স্কা বা সুশ্রী এক জনও ছিল না। পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল। ব—মহাশয়ের সঙ্গে আমাদের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তাঁর কথা অনর্গল, হাসি অজস্র, আহার অপরিমিত। সকলের সঙ্গেই তাঁর আলাপ, সকলের সঙ্গেই তিনি হাসিতামাশা করে বেড়ান। তাঁর একটা গুণ আছে, তিনি কখনো বিবেচনা করে, মেজে ঘষে কথা কন না; ঠাট্টা করেন, সকল সময়ে তার মানে না থাকুক, তিনি নিজে হেসে আকুল হন। তিনি তাঁর বয়সের ও পদমানের গাম্ভীর্য বুঝে হিসাব করে কথা কন না, মেপে জুকে হাসেন না ও দু-দিক বজায় রেখে মত প্রকাশ করেন না, এই সকল কারণে তাঁকে আমার ভালো লাগত। কত প্রকার যে ছেলেমানুষি করেন তার ঠিক নেই। বৃদ্ধত্বের বুদ্ধি ও বালকত্বের সাদাসিদা নিশ্চিন্ত ভাব একত্রে দেখলে আমার বড়ো ভালো লাগে। আমাকে তিনি ‘অবতার’ বলতেন, গ্রেগরি সাহেবকে ‘গড়গড়ি’ বলতেন, আর-এক যাত্রীকে ‘রুহি মৎস্য’ বলে ডাকতেন; সেবেচারির অপরাধ কী তা জান? সাধারণ মানুষদের চেয়ে তার ঘাড়ের দিকটা কিছু খাটো ছিল, তার মাথা ও শরীরের মধ্যে একটা স্বতন্ত্র যোজক পদার্থ ছিল না বললেও হয়। এই জন্যে ব—মহাশয় তাকে মৎস্যশ্রেণীভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু আমি যে কেন অবতারশ্রেণীর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেম, তার কারণ সহজে নির্দেশ করা যায় না। আমাদর জাহাজের T—মহাশয় কিছু নূতন রকমের লোক। তিনি ঘোরতম ফিলজফর মানুষ। তাঁকে কখনো চলিত ভাষায় কথা কইতে শুনি নি। তিনি কথা কইতেন না, বক্তৃতা দিতেন। একদিন আমরা দু-চার জনে মিলে জাহাজের ছাতে দু-দণ্ড আমোদপ্রমোদ করছিলেম, এমন সময়ে দুর্ভাগ্যক্রমে ব—মহাশয় তাঁকে বললেন, ‘কেমন সুন্দর তারা উঠেছে’। এই আমাদের ফিলজফর তারার সঙ্গে মানুষ্য-জীবনের সঙ্গে একটা গভীর সম্বন্ধ বাধিয়ে দিয়ে বক্তৃতা শুরু করলেম—আমরা “মূর্খেতে চাহিয়া থাকে ফ্যাল ফ্যাল করিয়া” রইলেম। আমাদের জাহাজে একটি আস্ত জনবুল ছিলেন। তাঁর তালবৃক্ষের মতো শরীর, ঝাঁটার মতো গোঁফ, শজারুর কাঁটার মতো চুল, হাঁড়ির মতো মুখ, মাছের চোখের মতো ম্যাডমেড়ে চোখ, তাঁকে দেখলেই আমার গা কেমন করত, আমি পাঁচ হাত তফাতে সরে যেতেম। এক-এক জন কোনো অপরাধ না করলেও তার মুখশ্রী যেন সর্বদা অপরাধ করতে থাকে। প্রত্যহ সকালে উঠেই শুনতে পেতেম তিনি ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, হিন্দুস্থানি প্রভৃতি যত ভাষা জানেন সমস্ত ভাষায় জাহাজের সমস্ত চাকরবাকরদের অজস্র গাল দিতে আরম্ভ করেছেন, ও দশ দিকে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে কখনো হাসতে দেখি নি; কারো সঙ্গে কথা নেই বার্তা নেই, আপনার ক্যাবিনে গোঁ হয়ে বসে আছেন। কোনো কোনো দিন ডেক-এ বেড়াতে আসতেন, বেড়াতে বেড়াতে যার দিকে একবার কৃপাকটাক্ষে নেত্রপাত করতেন, তাকে যেন পিঁপড়াটির মতো মনে করতেন। প্রত্যহ খাবার সময় ঠিক আমার পাশে B—বসতেন। তিনি একটি ইয়ুরাশীয়। কিন্তু তিনি ইংরেজের মতো শিস দিতে, পকেটে হাত দিয়ে পা ফাঁক করে দাঁড়াতে সম্পূর্ণরূপে শিখেছেন। তিনি আমাকে বড়োই অনুগ্রহের চোখে দেখতেন। একদিন এসে মহাগম্ভীর স্বরে বললেন, “ইয়ং ম্যান্‌, তুমি অক্সফোর্ড যাচ্ছ? অক্সর্ফোড য়ুনিভার্সিটি বড়ো ভালো বিদ্যালয়।” আমি একদিন ট্রেঞ্চ সাহেবের “Proverbs and Their Lessons” বইখানি পড়ছিলেম, তিনি এসে বইটি নিয়ে শিস দিতে দিতে দু-চার পাত উলটিয়ে পালটিয়ে বললেন, “হাঁ, ভালো বই বটে।” ট্রেঞ্চের শুভাদৃষ্ট! আমার উপর তাঁর কিছু মুরব্বিয়ানা ব্যবহার ছিল। এডেন থেকে সুয়েজে যেতে দিন পাঁচক লেগেছিল। যারা ব্রিন্দিসি-পথ দিয়ে ইংলণ্ডে যায় তাদের জাহাজ থেকে নেবে সুয়েজে রেলওয়ের গাড়িতে উঠে আলেকজান্দ্রিয়াতে যেতে হয়; আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দরে তাদের জন্যে একটা স্টীমার অপেক্ষা করে—সেই স্টীমারে চচড়ে ভূমধযসাগর পার হয়ে ইটালিতে পৌঁছতে হয়। আমরা overland-পেরোনো যাত্রী, সুতরাং আমাদের সুয়েজে নাবতে হল। আমরা তিনজন বাঙালি ও একজন ইংরেজ একখানি আরব নৌকো ভাড়া করলেম। মানুষের “divine” মুখশ্রী কতদূর পশুত্বের দিকে নাবতে পারে, তা সেই নৌকোর মাঝিটার মুখ দেখলে জানতে পারতে। তার চোখ দুটো যেন বাঘের মতো, কাল কুচকুচে রং, কপাল নিচু, ঠোঁট পুরু, সবসুদ্ধ মুখের ভাব অতি ভয়ানক। অন্যান্য নৌকোর সঙ্গে দরে বনল না, সে একটু কম দামে নিয়ে যেতে রাজি হল। ব—মহাশয় তো সে নৌকোয় বড়ো সহজে যেতে রাজি নন; তিনি বললেন আরবদের বিশ্বাস করতে নেই—ওরা অনায়াসে গলায় ছুরি দিতে পারে। তিনি সুয়েজের দুই-একটা ভয়ানক ভয়ানক অরাজকতার গল্প করলেন। কিন্তু যা হক, আমরা সেই নৌকোয় তো উঠলেম। মাঝিরা ভাঙা ভাঙা ইংরেজি কয়, ও অল্পস্বল্প ইংরেজি বুঝতে পারে। আমরা তো কতক দূর নির্বিবাদে গেলেম। আমাদের ইংরেজ যাত্রীটির সুয়েজের পোস্ট আপিসে নাববার দরকার ছিল। পোস্ট আপিস অনেক দূর এবং যেতে অনেক বিলম্ব হবে, তাই মাঝি একটু আপত্তি করলে; কিন্তু শীঘ্রই সে আপত্তি ভঞ্জন হল। তার পরে আবার কিছু দূরে গিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলে “পোস্ট আপিসে যেতে হবে কি? সে দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে যাওয়া অসম্ভব।”—আমাদের রুক্ষস্বভাব সাহেবটি মহা ক্ষাপা হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “your grandmother”। এই তো আমাদের মাঝি রুখে উঠলেন, “what? mother? mother? What mother, don’t say mother”। আমরা মনে করলুম সাহেবটাকে ধরে বুঝি জলে ফেলে দিলে, আবার জিজ্ঞাসা করলে, “ what did say? (কী বললি?)” সাহেব তাঁর রোখ ছাড়ালেন না। আবার বললেন “your grandmother”। এই তো আর রক্ষা নেই, মাঝিটা মহা তেড়ে উঠল। সাহেব গতিক ভালো নয় দেখে নরম হয়ে বললেন, “you don’t seem to understand what I say!” অর্থাৎ তিনি তখন grandmother বলাটা যে গালি নয় তাই প্রমাণ করতে ব্যস্ত। তখন সে মাঝিটা ইংরেজি ভাষা ছেড়ে ধমক দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল “বস—চুপ।” সাহেব থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন, আর তাঁর বাক্যস্ফুর্তি হল না। আবার খানিক দূর গিয়ে সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন “কত দূর বাকি আছে?” মাঝি অগ্নিশর্মা হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “Two shilling give, ask what distance!” আমরা এই রকম বুঝে গেলেম যে, দু-শিলিং ভাড়া দিলে সুয়েজ-রাজ্যে এই রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা আইনে নেই! মাঝিটা যখন আমাদের এইরকম ধমক দিচ্ছে তখন অন্য অন্য দাঁড়িদের ভারি আমোদ বোধ হচ্ছে, তারা তো পরস্পর মুখচাওয়াচাওয়ি করে মুচকি মুচকি হাসি আরম্ভ করলে। মাঝিমহাশয়ের বিষম বদমেজাজ দেখে তাদের হাসি সামলানো দায় হয়ে উঠেছিল। একদিকে মাঝি ধমকাচ্ছে, একদিকে দাঁড়িগুলো হাসি জুড়ে দিয়েছে, মাঝিটির উপর প্রতিহিংসা তোলবার আর কোনো উপায় না দেখে আমরাও তিনজনে মিলে হাসি জুড়ে দিলেম—এ রকম সুবুদ্ধি অনেক স্থলে দায়ে পড়ে খাটাতে হয়। মানে মানে সুয়েজ শহরে গিয়ে তো পৌঁছলেম। সুয়েজ শহর সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার অধিকার নেই, কারণ আমি সুয়েজের আধ মাইল জায়গার বেশি আর দেখি নি। শহরের চারদিকে একবার প্রদক্ষিণ করবার বাসনা ছিল, কিন্তু আমার সহযাত্রীদের মধ্যে যাঁরা পূর্বে সুয়েজ দেখেছিলেন, তাঁরা বললেন, “এ পরিশ্রমে শ্রান্তি ও বিরক্তি ছাড়া অন্য কোনা ফললাভের সম্ভাবনা নেই।” তাতেও আমি নিরুৎসাহ হই নি কিন্তু শুনলেম গাধায় চড়ে বেড়ানো ছাড়া শহরে বেড়াবার আর কোনো উপায় নেই। শুনে শহরে বেড়াবার দিকে টান আমার অনেকটা কমে গেল, তার পরে শোনা গেল, এ-দেশের গাধাদের সঙ্গে চালকদের সকল সময়ে মতের ঐক্য হয় না, তারও একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন ইচ্ছে আছে; এইজন্যে সময়ে সময়ে দুই ইচ্ছের বিরোধ উপস্থিত হয়, কিন্তু প্রায় দেখা যায়, গাধার ইচ্ছে পরিণামে জয়ী হয়। সুয়েজে একপ্রকার জঘন্য চোখের ব্যামোর অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব—রাস্তায় অমন শত শত লোকের চোখ ঐরকম রোগগ্রস্ত দেখতে পাবে। এখানকার মাছিরা ঐ রোগ চারদিকে বিতরণ করে বেড়ায়। রোগগ্রস্ত চোখ থেকে ঐ রোগের বীজ আহরণ করে তারা অরুগ্ন চোখে গিয়ে বসে, চারিদিকে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। সুয়েজে আমরা রেলগাড়িতে উঠলেম। এ রেলগাড়ির অনেকপ্রকার রোগ আছে, প্রথমত শোবার কোনো বন্দোবস্ত নেই, কেন না বসবার জায়গাগুলি অংশে অংশে বিভক্ত, দ্বিতীয়ত এমন গজগামিনী রেলগাড়ি সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায় না। সমস্ত রাত্রিই গাড়ি চলেছে, দিনের বেলা যখন জেগে উঠলেম তখন দেখলেম ধুলোয় আমাদের কেবল গোর হয় নি, আর সব হয়েছে। চুলে হাত দিতে গিয়ে দেখি, চুলে এমন এক স্তর মাটি জমেছে যে, মাথায় অনায়াসে ধান চাষ করা যায়। এইরকম ধুলোমাখা সন্ন্যাসীর বেশে আমরা আলেকজান্দ্রিয়াতে গিয়ে পৌঁছলেম। রেলের লাইনের দুধারে সবুজ শস্যক্ষেত্র। জায়গায় জায়গায় খেজুরের গাছে থোলো থোলো খেজুর ফলে রয়েছে। মাঠের মাঝে মাঝে কুয়ো। মাঝে মাঝে দুই-একটা কোঠাবাড়ি—বাড়িগুলো চৌকোনা, থাম নেই, বারান্দা নেই—সমস্তটাই দেয়ালের মতো, সেই দেয়ালের মধ্যে মধ্যে দুই-একটা জানলা। এই সকল কারণে বাড়িগুলোর যেন শ্রী নেই। যা হোক আমি আগে আফ্রিকার মাথা থেকে পা পর্যন্ত যে রকম অনুর্বর মরুভূমি মনে করে রেখেছিলুম, চারদিক দেখে তা কিছুই মনে হল না। বরং চার দিককার সেই হরিৎ ক্ষেত্রের উপর খেজুরকুঞ্জের মধ্যে প্রভাতটি আমার অতি চমৎকার লেগেছিল। আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে আমাদের জন্য ‘মঙ্গোলিয়া’ স্টীমার অপেক্ষা করছিল। এইবার আমরা ভূমধ্যসাগরের বক্ষে আরোহণ করলেম। আমার একটু শীত-শীত করতে লাগল। জাহাজে গিয়ে খুব ভাল করে স্নান করলেম, আমার তো হাড়ে হাড়ে ধুলো প্রবেশ করেছিল। স্নান করার পর আলেকজান্দ্রিয়া শহর দেখতে গেলেম। জাহাজ থেকে ভাঙা পর্যন্ত যাবার জন্যে একটা নৌকো ভাড়া হল। এখানকার এক-একটা মাঝি সার উইলিম জোন্‌সের দ্বিতীয় সংস্কণর বললেই হয়। তারা গ্রীক, ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি প্রভৃতি অনেক ভাষায় চলনসই রকম কথা কইতে পারে। শুনলেম ফ্রেঞ্চ ভাষাই এখানকার সাধারণ ভাষা। রাস্তাঘাটের নাম, সাইনবোর্ডে দোকানগুলির আত্মপরিচয়, অধিকাংশই ফরাসি ভাষায় লেখা। আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি সমৃদ্ধিশালী মনে হল। এখানে যে কত জাতের লোক ও কত জাতের দোকানবাজার আছে তার ঠিকানা নেই। রাস্তাগুলি পাথর দিয়ে বাঁধানো, তাতে বেশ পরিষ্কার থাকে, কিন্তু গাড়ির শব্দ বড়ো বেশি রকম হয়। খুব বড়ো বড়ো বাড়ি, বড়ো বড়ো দোকান, শহরটি খুব জমকালো বটে। আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দর খুব প্রকাণ্ড। বিস্তর জাহাজ এখানে আশ্রয় পায়। য়ুরোপীয়, মুসলমান, সকল প্রকার জাতিরই জাহাজ এ বন্দরে আছে, কেবল হিন্দুদের জাহাজ নেই। চার-পাঁচ দিনে আমরা ইটালিতে গিয়ে পৌঁছলেম, তখন রাত্রি একটা-দুটো হবে। গরম বিছানা ত্যাগ করে, জিনিসপত্র নিয়ে আমরা জাহাজের ছাতে গিয়ে উঠলেম। জ্যোৎস্নারাত্রি, খুব শীত; আমার গায়ে বড়ো একটা গরম কাপড় ছিল না, তাই ভারি শীত করছিল। আমাদের সুমুখে নিস্তব্ধ শহর, বাড়িগুলির জানলা দরজা সমস্ত বন্ধ—সমস্ত নিদ্রামগ্ন। আমাদের যাত্রীদের মধ্যে ভারি গোল পড়ে গেল, কখনো শুনি ট্রেন পাওয়া যাবে, কখনো শুনি পাওয়া যাবে না। জিনিসপত্রগুলো নিয়ে কী করা যাবে ভেবে পাওয়া যায় না, জাহাজে থাকব কি বেরোব কিছুই স্থির নেই। একজন ইটালিয়ান অফিসার এসে আমাদের গুনতে আরম্ভ করলে—কিন্তু কেন গুনতে আরম্ভ করলে তা ভেবে পাওয়া গেল না। জাহাজের মধ্যে এইরকম একটা অস্ফুট জনশ্রুতি প্রচারিত হল যে, এই গণনার সঙ্গে আমাদের ট্রেনে চড়ার একটা বিশেষ যোগ আছ। কিন্তু সে-রাত্রে মূলেই ট্রেন পাওয়া গেল না। শোনা গেল, তার পরদিন বেলা তিনটের আগে ট্রেন পাওয়া যাবে না। যাত্রীরা মহা বিরক্ত হয়ে উঠল। অবশেষে সে-রাত্রে ব্রিন্দিসির হোটেলে আশ্রয় নিতে হল। এই তো প্রথম য়ুরোপের মাটিতে আমার পা পড়ল। কোনো নূতন দেশে আসবার আগে আমি তাকে এমন নূতনতর মনে করে রাখি যে, এসে আর তা নূতন বলে মনেই হয় না। য়ুরোপ আমার তেমন নূতন মনে হয় নি শুনে সকলেই অবাক। আমরা রাত্রি তিনটের সময় ব্রিন্দিসির হোটেলে গিয়ে শুয়ে পড়লেম। সকালে একটা আধমরা ঘোড়া ও আধভাঙা গাড়ি চড়ে শহর দেখতে বের হলেম। সারথির সঙ্গে গাড়িঘোড়ার এমন অসামঞ্জস্য যে কী বলব! সারথির বয়স চোদ্দো হবে—কিন্তু ঘোড়াটির বয়স পঞ্চাশ হবে—আর গাড়িটি পৌরাণিক যুগের মনে হল। ছোটোখাটো শহর যেমন হয়ে থাকে ব্রিন্দিসিও তাই। কতকগুলি কোঠাবাড়ি, দোকানবাজার, রাস্তাঘাট আছে। ভিক্ষুকেরা ভিক্ষা করে ফিরছে, দু-চার জন লোক মদের দোকানে বসে গল্পগুজব করছে, দু-চার জন রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে হাসিতামাশা করছে; লোকজনেরা অতি নিশ্চিন্তমুখে গজেন্দ্রগমনে গমন করছে; যেন কারও কোনো কাজ নেই, কারও কোনো ভাবনা নেই—যেন শহরসুদ্ধ ছুটি। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার সমারোহ নেই, লোকজনের সমাগম নেই। আমরা খানিক দূর যেতেই এক জন ছোকরা আমাদের গাড়ি থামিয়ে হাতে একটা তরমুজ নিয়ে গাড়োয়ানের পাশে গিয়ে বসল। ব—মহাশয় বললেন, “বিনা আয়াসে এর কিছু রোজগার করবার বাসনা আছে।” লোকটা এসে হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে মাঝে মাঝে আমাদের দেখিয়ে দিতে লাগল, “ঐটে চার্চ, ঐটে বাগান, ঐটে বাগন, ঐটে মাঠ” ইত্যাদি। তার টীকাতে আমাদের কিছুমাত্র জ্ঞানবৃদ্ধি হয় নি, আর তারটীকা না হলেও আমাদের কিছুমাত্র জ্ঞানের ব্যাঘাত হত না। তাকে কেউ আমাদের গাড়িতে উঠতে বলে নি, কেউ তাকে কোনো বিষয় জিজ্ঞাসাও করে নি, কিন্তু তবু এই অযাচিত অনুগ্রহের জন্য তার যাচ্ঞা পূর্ণ করতে হল। তারা আমাদের একটা ফলের বাগানে নিয়ে গেল। সেখানে যে কত প্রকার ফলের গাছ, তার সংখ্যা নেই। চারিদিকে থোলো থোলো আঙুর ফলে রয়েছে। দু-রকম আঙুর আছে, কালো আর সাদা। তার মধ্যে কালোগুলিই আমার বেশি মিষ্টি লাগল। বড়ো বড়ো গাছে আপেল পিচ প্রভৃতি অনেক প্রকার ফল ধরে আছে। একজন বুড়ি (বোধ হয় উদ্যানপালিকা) কতকগুলি ফলমূল নিয়ে উপস্থিত করলে। আমরা সেদিকে নজর করলেম না; কিন্তু ফল বিক্রয় করবার উপায় সে বিলক্ষণ জানে। আমরা ইতস্তত বেড়াচ্ছি, এমন সময়ে দেখি একটি সুন্দরী মেয়ে কতকগুলি ফল আর ফুলের তোড়া নিয়ে আমাদের সম্মুখে হাজির হল, তখন আর অগ্রাহ্য করবার সাধ্য রইল না। ইটালির মেয়েদের বড়ো সুন্দর দেখতে। অনেকটা আমাদের দেশের মেয়ের ভাব আছে। সুন্দর রং, কালো কালো চুল, কালো ভুরু, কালো চোখ, আর মুখের গড়ন চমৎকার। তিনটের ট্রেনে বৃন্দিসি ছাড়লেম। রেলোয়ে পথের দু-ধারে আঙুরের খেত, চমৎকার দেখতে। পর্বত, নদী, হ্রদ, কুটির, শস্যক্ষেত্র, ছোটো ছোটো গ্রাম প্রভৃতি। যত কিছু কবির স্বপ্নের ধন সমস্ত চারদিকে শোভা পাচ্ছে। গাছপালার মধ্যে থেকে যখন কোনো একটি দূরস্থ নগর, তার প্রাসাদচূড়া, তার চার্চের শিখর, তার ছবির মতো বাড়িগুলো আস্তে আস্তে চোখে পড়ে তখন বড়ো ভালো লাগে। সন্ধ্যেবেলায় একটি পাহাড়ের নিচে অতি সুন্দর একটি হ্রদ দেখেছিলেম, তা আর আমি ভুলতে পারব না, তার চারি দিকে গাছপালা, জলে সন্ধ্যার ছায়া সে অতি সুন্দর, তা আমি বর্ণনা করতে চাই নে। রেলোয়ে করে যেতে যেতে আমরা Mont Cenis-এর বিখ্যাত সুরঙ্গ দেখলেম। এই পর্বতের এ-পাশ থেকে ফরাসিরা ও-পাশ থেকে ইটালিয়নরা, এক সঙ্গে খুদতে আরম্ভ করে, কয়েক বৎসর খুদতে খুদতে দুই যন্ত্রিদল ঠিক মাঝামাঝি এসে পরস্পরের সুমুখাসুমুখি হয়। এই গুহা অতিক্রম করতে রেলগাড়ির ঠিক আধ ঘণ্টা লাগল। সে অন্ধকারে আমরা যেন হাঁপিয়ে উঠছিলেম। এখানকার রেলগাড়ির মধ্যে দিনরাত আলো জ্বালাই আছে, কেন না এক-এক স্থানে প্রায় পাঁচ মিনিট অন্তর এক-একটা পর্বতগুহা ভেদ করতে হয়—সুতরাং দিনের আলো খুব অল্পক্ষণ পাওয়া যায়। ইটালি থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা—নির্ঝর নদী পর্বত গ্রাম হ্রদ দেখতে দেখতে আমরা পথের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেম। সকালবেলায় প্যারিসে গিয়ে পৌঁছলেম। কী জমকালো শহর। অভ্রভেদী প্রাসাদের অরণ্যে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। মনে হয় প্যারিসে বুঝি গরীব লোক নেই। মনে হল, এই সাড়ে তিন হাত মানুষের জন্যে এমন প্রকাণ্ড জমকালো বাড়িগুলোর কী আবশ্যক। হোটেলে গেলেম, এমন প্রকাণ্ড কাণ্ড যে, ঢিলে কাপড় পরে যেমন সোয়াস্তি হয় না, সে হোটেলেও বোধ করি তেমনি অসোয়াস্তি হয়। সমরণস্তম্ভ, উৎস, বাগান, প্রাসাদ, পাথরে বাঁধানো রাস্তা, গাড়ি, ঘোড়া, জনকোলাহল প্রভৃতিতে অবাক হয়ে যেতে হয়। প্যারিসে পৌঁছিয়েই আমরা একটা ‘টার্কিশ-বাথে’ গেলেম। প্রথমত একটা খুব গরম ঘরে গিয়ে বসলেম, সে-ঘরে অনেকক্ষণ থাকতে থাকতে কারো কারো ঘাম বেরতে লাগল, কিন্তু আমার তো বেরল না, আমাকে তার চেয়ে আর-একটা গরম ঘরে নিয়ে গেল, সে-ঘরটা আগুনের মতো, চোখ মেলে থাকলে চোখ জ্বালা করতে থাকে, মিনিট কতক থেকে সেখানে আর থাকতে পারলেম না, সেখান থেকে বেরিয়ে খুব ঘাম হতে লাগল। তার পরে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমাকে শুইয়ে দিলে। ভীমকায় এক ব্যক্তি এসে আমার সর্বাঙ্গ ডলতে লাগল। তার সর্বাঙ্গ খোলা, এমন মাংসপেশল চমৎকার শরীর কখনো দেখি নি। “ব্যূঢ়োরস্কো বৃষস্কন্ধঃ শালপ্রাংশুর্মহাভুজঃ।” মনে মনে ভাবলেম ক্ষীণকায় এই মশকটিকে দলন করার জন্যে এমন প্রকাণ্ড কামানের কোনো আবশ্যক ছিল না। সে আমাকে দেখে বললে, আমার শরীর বেশ লম্বা আছে, এখন পাশের দিকে বাড়লে আমি একজন সুপুরুষের মধ্যে গণ্য হব; আধ ঘণ্টা ধরে সে আমার সর্বাঙ্গ অবিশ্রান্ত দলন করলে, ভূমিষ্ঠকাল থেকে যত ধুলো মেখেছি, শরীর থেকে সব যেন উঠে গেল। যথেষ্টরূপে দলিত করে আমাকে আর-একটি ঘরে নিয়ে গেল, সেখানে গরম জল দিয়ে, সাবান দিয়ে, স্পঞ্জ দিয়ে শরীরটা বিলক্ষণ করে পরিষ্কার করলে। পরিষ্করণ-পর্ব শেষ হলে আর-একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে একটা বড়ো পিচকিরি করে গায়ে গরম জল ঢালতে লাগল, হঠাৎ গরম জল দেওয়া বন্ধ করে বরফের মতো ঠাণ্ডা জল বর্ষণ করতে লাগল; এইরকম কখনো গরম কখনো ঠাণ্ডা জলে স্নান করে একটা জলযন্ত্রের মধ্যে গেলেম, তার উপর থেকে নিচে থেকে চার পাশ থেকে বাণের মতো জল গায়ে বিঁধতে থাকে। সেই বরফের মতো ঠাণ্ডা বরুণ-বাণ-বর্ষণের মধ্যে খানিকক্ষণ থেকে আমার বুকের রক্ত পর্যন্ত যেন জমাট হয়ে গেল—রণে ভঙ্গ দিতে হল, হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে এলেম। তার পরে এক জায়গায় পুকুরের মতো আছে, আমি সাঁতার দিতে রাজি আছি কি না জিজ্ঞাসা করলে। আমি সাঁতার দিলেম না, আমার সঙ্গী সাঁতার দিলেন। তাঁর সাঁতার দেওয়া দেখে তারা বলাবলি করতে লাগল “দেখো, দেখো, এরা কী অদ্ভুত রকম করে সাঁতার দেয়, ঠিক কুকুরের মতো।” এতক্ষণে স্নান শেষ হল। আমি দেখলেম টার্কিশ-বাথে স্নান করা আর শরীটাকে ধোপার বাড়ি দেওয়া এক কথা। তার পরে সমস্ত দিনের জন্যে এক পাউণ্ড দিয়ে এক গাড়ি ভাড়া করা গেল। প্যারিস এক্‌সিবিশন দেখতে গেলেম। তুমি এইবার হয়তো খুব আগ্রহের সঙ্গে কান খাড়া করেছ, ভাবছ আমি প্যারিস এক্‌সিবিশনের বিষয় কী জানি বর্ণনা করব। কিন্তু দুঃখের বিষয় কী বলব, কলকাতার য়ুনিভার্সিটিতে বিদ্যা শেখার মতো প্যারিস এক্‌সিবিশনের সমস্ত দেখেছি কিন্তু কিছুই ভালো করে দেখি নি। একদিনের বেশি আমাদের প্যারিসে থাকা হল না—সে বৃহৎ কাণ্ড একদিনে দেখা কারও সাধ্য নয়। সমস্ত দিন আমরা দেখলেম-কিন্তু সে-রকম দেখায়, দেখবার একটা তৃষ্ণা জন্মাল কিন্তু দেখা হল না। সে একটা নগরবিশেষ। এক মাস থাকলে তবে তা বর্ণনা করবার দুরাশা করতেম। প্যারিস এক্‌সিবিশনের একটা স্তূপাকার ভাব মনে আছে, কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাব কিছুই মনে নেই। সাধারণত মনে আছে যে চিত্রশালায় গিয়ে অসংখ্য অসংখ্য চমৎকার ছবি দেখেছি, স্থাপত্যশালায় গিয়ে অসংখ্য অসংখ্য প্রস্তরমূর্তি দেখেছি, নানা দেশবিদেশের নানা জিনিস দেখেছি; কিন্তু বিশেষ কিছু মনে নেই। তার পর প্যারিস থেকে লণ্ডনে এলেম—এমন বিষণ্ন অন্ধকার-পুরী আর কখনো দেখি নি—ধোঁয়া, মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশা, কাদা আর লোকজনের ব্যস্তসমস্ত ভাব। আমি দুই-এক ঘণ্টামাত্র লণ্ডনে ছিলেম, যখন লণ্ডন পরিত্যাগ করলেম তখন নিশ্বাস পরিত্যাগ করে বাঁচলেম। আমার বন্ধুরা আমাকে বললেন, লণ্ডনের সঙ্গে প্রথম দৃষ্টিতেই ভালোবাসা হয় না, কিছু দিন থেকে তাকে ভালো করে চিনলে তবে লণ্ডনের মাধুর্য বোঝা যায়। %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AA-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%B0_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0/%E0%A6%A4%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A6%AF%E0%A6%BC_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 য়ুরোপ-প্রবাসীর তৃতীয় পত্র আমরা সেদিন ফ্যান্সি-বলে অর্থাৎ ছদ্মবেশী নাচে গিয়েছিলেম—কত মেয়ে পুরুষ নানারকম সেজেগুজে সেখানে নাচতে গিয়েছিল। প্রকাণ্ড ঘর, গ্যাসের আলোয় আলোকাকীর্ণ, চার দিকে ব্যাণ্ড বাজছে—ছ-সাত-শ সুন্দরী, সুপুরষ। ঘরে ন স্থানং তিল ধারয়েৎ—চাঁদের হাট তো তাকেই বলে। এক-একটা ঘরে দলে দলে স্ত্রী পুরুষে হাত ধরাধরি করে ঘুরে ঘুরে নাচ আরম্ভ করেছে, যেন জোড়া জোড়া পাগলের মতো। এক-একটা ঘরে এমন সত্তর-আশি জন যুগলমূর্তি, এমন ঘোঁষাঘেঁষি যে, কে কার ঘাড়ে পড়ে তার ঠিক নেই। একটা ঘরে শ্যাম্পেনের কুরুক্ষেত্র পড়ে গিয়েছে, মদ্যমাংসের ছড়াছড়ি, সেখানে লোকারণ্য; এক-একটা মেয়ের নাচের বিরাম নেই, দু-তিন ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত তার পা চলছে। এক জন মেম তুষার-কুমারী সেজে গিয়েছিলেন, তার সমস্তই শুভ্র, সর্বাঙ্গে পুঁতির সজ্জা, আলোতে ঝকমক করছে। এক জন মুসলমানিনী সেজেছিলেন; একটা লাল ফুলো ইজের, উপরে একটা রেশমের পেশোয়াজ, মাথায় টুপির মতো—এ কাপড়ে তাঁকে বেশ মানিয়ে গিয়েছিল—এক জন সেজেছিলেন আমাদের দিশি মেয়ে, একটা শাড়ি আর একটা কাঁচুলি তাঁর প্রধান সজ্জা, তার উপরে একটা চাদর, তাতে ইংরেজি কাপড়ের চেয়ে তাঁকে ঢের ভালো দেখাচ্ছিল। একজন সেজেছিলেন বিলিতি দাসী। আমি বাংলার জমিদার সেজেছিলেম, জরি দেওয়া মখমলের কাপড়, জরি দেওয়া মখমলের পাগড়ি প্রভৃতি পরেছিলেম। আমাদের মধ্যে ব্যক্তিবিশেষ অযোধ্যার তালুকদার সেজে গিয়েছিলেন, সাদা রেশমের ইজের খচিত, সাদা রেশমের চাপকান, সাদা রেশমের জোব্বা, জরিতে ঝকমকায়মান পাগড়ি, জরির কোমরবন্ধ-তাঁর সজ্জা। অযোধ্যার তালুকদারেরা যে এই রকম কাপড় পরে তা হয়তো নয়, কিন্তু ধরা পড়বার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। আমাদের মধ্যে এক ব্যক্তি আফগান সেনাপতি সেজেছিলেন। গত মঙ্গলবারে আমরা এক ভদ্রলোকের বাড়িতে নাচের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেম। সন্ধ্যেবেলায় কোথাও নিমন্ত্রণে যেতে হলে শীতের জন্য সচরাচর মোটা কাপড় পরতে হয়, কিন্তু ঈভনিং পার্টি প্রভৃতিতে পাতলা কালো বনাতের কাপড় পরাই রীতি। সান্ধ্য পরিচ্ছদের কামিজটি একেবারে নিষ্কলঙ্ক ধবধবে সাদা হওয়া চাই, তার উপরে প্রায় সমস্ত-বুক খোলা এক বনাতের ওয়েস্টকোট, কালো ওয়েস্টকোটের মধ্যে সাদা কামিজের সুমুখ দিকটা বেরিয়ে থাকে, গলায় সাদা ফিতে (নেকটাই) বাঁধা, সকলের উপর একটি টেল-কোট (লাঙুল-কোট); টেলকোটের সুমুখ দিকটা কোমর পর্যন্ত কাটা, আমাদের চাপকান প্রভৃতি পোষাকগুলি যেমন হাঁটু পর্যন্ত পেড়, এ তা নয়। এর সুমুখ দিকটার সীমা কোমর পর্যন্ত, কিন্তু পিছন দিকটা কাটা নয়, সুতরাং কতকটা লেজের মতো ঝুলতে থাকে। ইংরেজদের হনুকরণে এই লেজকোট পরতে হল। নাচ-পার্টিতে যেতে হলে হাতে একজোড়া সাদা দস্তানা পরা চাই, কারণ যে মহিলাদের হাতে হাত দিয়ে নাচতে হবে, খালি হাত লেগে তাঁদের হাত ময়লা হয়ে যেতে পারে কিংবা তাঁদের হাতে যদি দস্তানা থাকে সেটা ময়লা হবার ভয় আছে। অন্য কোনো জায়গায় লেডিদের সঙ্গে শেক্‌হ্যাণ্ড করতে গেলে হাতের দস্তানা খুলে ফেলতে হয়, কিন্তু নাচের ঘরে তার উল্‌টো। যা হক, আমরা তো সাড়ে নটার সময় তাঁদের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেম। তখনো নাচ আরম্ভ হয় নি। ঘরের দুয়ারের কাছে গৃহকর্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বিশেষ পরিচিতদের সঙ্গে শেক্‌হ্যাণ্ড করছেন, অপরিচিতদের প্রতি শিরঃকম্পন ও সকলকে অভ্যর্থনা করছেন। এ গোরাদের দেশে নিমন্ত্রণসভা গৃহকর্তার বড়ো উঁচু পদ নেই, তিন সভায় উপস্থিত থাকুন বা শয়নগৃহে নিদ্রা দিন, তাতে কারও বড়ো কিছু এসে যায় না। আমরা ঘরে প্রবেশ করলেম, গ্যাসের আলোয় ঘর উজ্জ্বল, শত শত রমণীর রূপের আলোকে গ্যাসের আলো ম্রিয়মান; রূপের উৎসব পড়ে গিয়েছে, ঘরের ভিতরে প্রবেশ করবামাত্রই চোখে ধাঁধা লেগে যায়। ঘরের একপাশে পিয়ানো, বেহালা, বাঁশি বাজছে, ঘরের চারিধারে কৌচ চৌকি সাজানো, ইতস্তত দেয়ালের আয়নার উপর গ্যাসের আলো ও রূপের প্রতিবিম্ব পড়ে ঝকমক করছে। নাচবার ঘরের মেজে কাঠের, তার উপর কার্পেট প্রভৃতি কিছু পাতা নেই সে কাঠের মেজে এমন পালিশ করা যে, পা পিছলে যায়। ঘর যত পিছল হয় ততই নাচবার উপযুক্ত হয়, কেননা পিছল ঘরে নাচের গতি সহজে হয়, পা কোনো বাধা পায় না, আপনা-আপনি পিছলে আসে। ঘরের চারিদিকে আশেপাশে যে-সকল বারান্দার মতো আছে, তাই একটু ঢেকেঢুকে, গাছপালা দিয়ে, দু-একটি কৌচ চৌকি রেখে তাকে প্রণয়ীদের কুঞ্জ নামে অভিহিত করা হয়েছে। সেইখানে নাচে শ্রান্ত হয়ে বা কোলাহলে বিরক্ত হয়ে যুবকযুবতী নিরিবিলি মধুরালাপ মগ্ন থাকতে পারেন। ঘরে ঢোকবার সময় সকলের হাতে সোনার অক্ষরে ছাপ এক-একখানি কাগজ দেওয়া হয়, সেই কাগজে কী কী নাচ হবে তাই লেখা থাকে। ইংরেজি নাচ দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, একরকম হচ্ছে স্ত্রীপুরুষে মিলে ঘুরে ঘুরে নাচা, তাতে কেবল দু-জন লোক একসঙ্গে নাচে; আর-একরকম নাচে চারটি জুড়ি নর্তকনর্তকী চতুষ্কোণ হয়ে সুমুখাসুমুখি দাঁড়ায় ও হাতধরাধরি করে নানা ভঙ্গীতে চলাফেরা করে বেড়ায়, কোনো কোনো সময় চার জুড়ি না হয়ে আট জুড়িও হয়। ঘুরে ঘুরে নাচকে রাউণ্ড ডান্স্‌ বলে ও চলাফেরা করে নাচার নাম স্কোয়ার ডান্স। নাচ আরম্ভ হবার পূর্বে গৃহকর্ত্রী মহিলা ও পুরুষদের মধ্যে আলাপ করিয়ে দেন অর্থাৎ পুরুষ-অভ্যাগতকে সঙ্গে করে কোনো এক অভ্যাগত-মহিলার কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, “মিস অমুক, ইনি মিস্টার অমুক।” অমনি মিস ও মিস্টার শিরঃকম্পন করেন। কোনো মিসের সঙ্গে পরিচয় হবার পর নাচবার ইচ্ছে করলে পকেট থেকে সেই সোনার জলে ছাপানো প্রোগ্রামটি বের করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে হয়, “আপনি কি অমুক নৃত্যে বাগদত্তা হয়ে আছেন?” তিনি যদি ‘না’ বলেন তা হলে তাঁকে বলতে হবে, “তবে আমি কি আপনার সঙ্গে নাচবার সুখভোগ করতে পারি?” তিনি ‘থ্যাঙ্ক য়ু’ বললে বোঝা যাবে কপালে তাঁর সঙ্গে নাচবার সুখ আছে। অমনি সেই কাগজটিতে সেই নাচের পাশে তাঁর নাম এবং তাঁর কাগজে আবেদনকারীর নাম লিখে দিতে হয়। নাচ আরম্ভ হল। ঘুর-ঘুর-ঘুর। একটা ঘরে, মনে করো, চল্লিশ-পঞ্চাশ জুড়ি নাচছে; ঘেঁষাঘেঁষি, ঠেলাঠেলি, কখনো বা জুড়িতে জুড়িতে ধাক্কাধাক্তি। তবু ঘুর-ঘুর-ঘুর। তালে তালে বাজনা বাজছে, তালে তালে পা পড়ছে, ঘর গরম হয়ে উঠেছে। একটা নাচ শেষ হল, বাজনা থেমে গেল; নর্তক মহাশয় তাঁর শ্রান্ত সহচরীকে আহারের ঘরে নিয়ে গেলেন, সেখানে টেবিলের উপর ফলমূল মিষ্টান্ন মদিরার আয়োজন; হয়তো আহার-পান করলেন না-হয় দুজনে নিভৃত কুঞ্জে বসে রহস্যালাপ করতে লাগলেন। আমি নতুন লোকের সঙ্গে বড়ো মিলে মিশে নিতে পারি নে, যে-নাচে আমি একেবারে সুপণ্ডিত, সে-নাচও নতুন লোকের সঙ্গে নাচতে পারি নে। সত্যি কথা বলতে কি, নাচের নেমন্তন্নগুলো আমার বড়ো ভালো লাগে না। যাদের সঙ্গে বিশেষ আলাপ আছে, তাদের সঙ্গে নাচতে মন্দ লাগে না। যেমন তাস খেলবার সময় খারাপ জুড়ি পেলে তার ‘পরে তার দলের লোক চটে যায়, তেমনি নাচের সময় খারাপ জুড়ির ‘পরে মেয়েরা ভারি চটে যায়। আমার নাচের সহচরী বোধ হয় নাচার সময় মনে মনে আমার মরণ কামনা করেছিলেন। নাচ ফুরিয়ে গেল, আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, তিনিও নিস্তার পেলেন। প্রথমে নাচের ঘরে ঢুকেই আমি একেবারে চমকে উঠেছিলেম, দেখি যে শত শ্বেতাঙ্গিনীদের মধ্যে আমাদের একটি ভারতবর্ষীয়া শ্যামাঙ্গিনী রয়েছেন। দেখেই তো আমার বুকটা একেবারে নেচে উঠেছিল। তার সঙ্গে কোনোমতে আলাপ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেম। কতদিন শ্যামলা মুখ দেখি নি! আর, তার মুখে আমাদের বাঙালি মেয়েদের ভালোমানুষি নম্রভাব মাখানো। আমি অনেক ইংরেজ মেয়েদের মুখে ভালোমানুষি নরম ভাব দেখেছি কিন্তু এর সঙ্গে তার কী একটা তফাত আছে বলতে পারি নে। তার চুল বাঁধা আমাদের দেশের মতো। সাদা মুখ আর উগ্র অসংকোচ সৌন্দর্য দেখে দেখে আমার মনটা ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল, এতদিন তাই বুঝতে পারলেম। হাজার হক, ইংরেজ মেয়েরা সম্পূর্ণ আলাদা জাত, আমি এতদূর ইংরেজি কায়দ শিখি নি যে, তাদের সঙ্গে বেশ খোলাখুলিভাবে কথাবার্তা কইতে পারি। পরিচিত বাঁধি গতের সীমা লঙ্ঘন করতে সাহস হয় না। আজ ব্রাইটনের অনেক তপস্যার ফলে সূর্য উঠেছেন। এদেশে রবি যেদিন মেঘের অন্তঃপুর থেকে বের হন সেদিন একটি লোকও কেউ ঘরে থাকে না। সেদিন সমুদ্রের ধারে বেড়াবার রাস্তায় লোক কিলবিল করতে থাকে। এদেশে যদিও ‘বাড়ির ভিতর’ নেই, তবু এদেশের মেয়েরা যেমন অসূর্যম্পশ্যরূপা এমন আমাদের দেশে নয়। সাড়ে আটটার কমে আমাদের বিছানা থেকে ওঠা হয় না, ছ-টার সময় বিছানা থেকে উঠলে এখানকার লোকেরা আশ্চর্য হয়। তার পরে উঠেই আমি রোজ ঠাণ্ডা জলে স্নান করি। এদেশে যাকে স্নান বলে, আমি সে-রকম সনানের বিড়ম্বনা করি নে। আমি মাথায় জল ঢেলে স্নান করি, গরম জল নয়—এখানকার এই বরফের মতো ঠাণ্ডা জল। ন-টার সময় আমাদের খাবার আসে। এখানকার ন-টা আর সেখানকার ছ-টা সমান। আমাদের আর-একটি খাওয়া দেড়টার সময়, সেইটিই প্রধান খাওয়া—মধ্যাহ্নভোজন। মধ্যে একবার চা রুটি প্রভৃতি আসে, তার পরে রাত আটটার সময় আর-একটি সুপ্রশস্ত ভোজনের আয়াজন হয়ে থাকে; এইরকম আমাদের দিনের প্রধান বিভাগগুলি খাওয়া নিয়ে। অন্ধকার হয়ে আসছে, চারটে বাজে বলে, চারটে বাজলে পরে আলো না জ্বেলে পড়া পুষ্কর। এখানে প্রকৃতপক্ষে ন-টার সময় দিন আরম্ভ হয়, কেননা গড়ে রোজ আটটার কমে ওঠা হয় না। তার পর আবার বৈকাল চারটের সময়েই এখানকার দিনের আলো নিভে যায়। দিনগুলো যেন দশটা চারটে আপিস করতে আসে। ট্যাঁক-ঘড়ির ডালা খুলতে খুলতেই এদেশে দিন চলে যায়। এখানকার রাত্তির তেমনি ঘোড়ায় চড়ে আসে, আর পায় হেঁটে ফেরে। মেঘ, বৃষ্টি, বাদল, অন্ধকার, শীত—এ আর একদণ্ডের তরে ছাড়া নেই। আমাদের দেশে যখন বৃষ্টি হয়, তখন মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ, মেঘ, বজ্র, বিদ্যুৎ, ঝড়—তাতে একটা কেমন উল্লাসের ভাব আছে; এখানে এ তা নয়, এ টিপ টিপ করে সেই একঘেয়ে বৃষ্টি ক্রমাগতই অতিনিঃশব্দ পদসঞ্চারে চলছে তো চলছেই। রাস্তায় সাদা, পত্রহীন গাছগুলো স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে, কাঁচের জানলার উপর টিপ টিপ করে জল ছিটিয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে স্তরে স্তরে মেঘ করে; এখানে আকাশ সমতল, মনে হয় না যে মেঘ করেছে, মনে হয় কোনো কারণে আকাশের রংটা ঘুলিয়ে গিয়েছে, সমস্তটা জড়িয়ে স্থাবরজঙ্গমের একটা অবসন্ন মুখশ্রী। লোকের মুখে সময়ে সময়ে শুনতে পাই বটে যে, কাল বজ্র ডেকেছিল, কিন্তু বজ্রের নিজের এমন গলার জোর নেই যে তার মুখ থেকেই সে খবরটা পাই। সূর্য তো এখানে গুজবের মধ্যে হয়ে পড়েছে। যদি অনেক ভাগ্যবলে সকালে উঠে সূর্যের মুখ দেখতে পাই, তবে তখনই আবার মনে হয়— এমন দিন না রবে , তা জানো । দিনে দিনে শীত খুব ঘনিয়ে আসছে; লোকে বলছে, কাল পরশুর মধ্যে হয়তো আমরা বরফ পড়া দেখতে পাব। তাপমান যন্ত্র ত্রিশ ডিগ্রি পর্যন্ত নেবে গিয়েছে—সেই তো হচ্ছে ফ্রীজিং পয়েন্ট। অল্পস্বল্প ফ্রস্ট দেখা দিয়েছে। রাস্তার মাটি খুব শক্ত। কেননা তার মধ্যে যা জল ছিল সমস্ত জমাট হয়ে গিয়েছে। রাস্তার মাঝে মাঝে কাঁচের টুকরোর মতো শিশির খুব শক্ত হয়ে জমেছে। দুই-এক জায়গায় ঘাসের মধ্যে কে যেন চুন ছড়িয়ে দিয়েছে, বরফের এই প্রথম সূত্রপাত। খবু শীত পড়েছে, এক এক সময়ে হাত-পা এমন ঠাণ্ডা হয়ে যায় যে জ্বালা করতে থাকে। সকালে লেপ থেকে বেরোতে ভাবনা হয়। আমাদের দিশি কাপড় দেখে রাস্তার এক-এক জন সত্যি সত্যি হেসে ওঠে, এক-এক জন এত আশ্চর্য হয়ে যায় যে, তাদের আর হাসবার ক্ষমতা থাকে না। কত লোক হয়তো আমাদের জন্য গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছে। প্যারিসে আমাদের গাড়ির পিছনে পিছনে এক দল ইস্কুলের ছোকরা চীৎকার করতে করতে ছুটেছিল, আমরা তাদের সেলাম করলেম। এক-এক জন আমাদের মুখের উপর হেসে ওঠে, এক-এক জন চেঁচাতে থাকে—”Jack look at the blackies!” %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AA-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%B0_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0/%E0%A6%AA%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%AE_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 য়ুরোপ-প্রবাসীর পঞ্চম পত্র বিলেতে নতুন এসেই বাঙালিদের চোখে কোন্‌ জিনিস ঠেকে, বিলিতি সমাজে নতুন মিশে প্রথমে বাঙালিদের কী রকম লাগে, সে-সকল বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আপাতত কিছু বলব না। কেননা, এ-সকল বিষয় আমার বিচার করবার অধিকার নেই, যাঁরা পূর্বে অনেক কাল বিলেতে ছিলেন ও বিলেত যাঁরা খুব ভালো করে চেনেন তাঁরা আমাকে সঙ্গে করে এনেছেন, আর তাঁদের সঙ্গেই আমি বাস করছি। বিলেতের আসবার আগেই বিলেতের বিষয় তাঁদের কাছে অনেক শুনতে পেতেম, সুতরাং এখানে এসে খুব অল্প জিনিস নিতান্ত নতুন মনে হয়েছে। এখানকার লোকের সঙ্গে মিশতে গিয়ে প্রতি পদে হুঁচট খেয়ে খেয়ে আচার-ব্যবহার আমাকে শিখতে হয়নি। তাই ভাবছি যে, আমার নিজের অভিজ্ঞতার বিষয় আপাতত তোমাদের কিছু বলব না। এখানকার দুই-এক জন বাঙালির মুখে তাঁদের যে-রকম বিবরণ শুনেছি তাই তোমাদের লিখছি। জাহাজে তো তাঁরা উঠলেন। যাত্রীদের সেবার জন্যে জাহাজে অনেক ইংরেজ চাকর থাকে, তাদের নিয়েই প্রথম গোল বাধে। এঁরা অনেকে তাদের “সার” “সার” বলে সম্বোধন করতেন, তাদের কোনো কাজ করতে হুকুম দিতে তাঁদের বাধো-বাধো করত। জাহাজে তাঁরা অত্যন্ত সসংকোচ ভাবে থাকতেন। তাঁরা বলেন, সকল বিষয়েই তাঁদের যে ও-রকম সংকোচ বোধ হত, সেটা কেবল ভয়ে নয়, তার সঙ্গে কতকটা লজ্জাও আছে। যে-কাজ করতে যান, মনে হয় পাছে বেদস্তুর হয়ে পড়ে। জাহাজে ইংরেজদের সঙ্গে মেশা বড়ো হয়ে ওঠে না। তারা টাটকা ভারতবর্ষ থেকে আসছে, ‘হুজুর ধর্মাবতার’গণ দেশী লোক দেখলে নাক তুলে, ঘাড় বেঁকিয়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে ভদ্র ইংরেজ দেখতে পাবে, তাঁরা তোমাকে নিতান্ত সঙ্গিহীন দেখে তোমার সঙ্গে মিশতে চেষ্টা করবেন, তাঁরা যথার্থ ভদ্র, অর্থাৎ ভদ্র ও উচ্চ পরিবারের লোক। এখানকার গলিতে গলিতে যে ‘জন-জোন্‌স্‌-টমাস’গণ কিলবিল করছে, তারা ভারতবর্ষের যে-অঞ্চলে পদার্পণ করেন, সে-অঞ্চলে ঘরে ঘরে তাদের নাম রাষ্ট্র হয়ে যায়, যে-রাস্তায় তারা চাবুক হস্তে ঘোড়ায় চড়ে যায় (হয়তো সে চাবুক কেবলমাত্র ঘোড়ার জন্যেই নয়) সে রাস্তাসুদ্ধ লোক শশব্যস্ত হয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়, তাদের এক-একটা ইঙ্গিতে ভারতবর্ষের এক-একটা রাজার সিংহাসন কেঁপে ওঠে এ-রকম অবস্থায় তাদের যে বিকৃতি ঘটে আমি তো তাতে বিশেষ অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাই নে। কোনো জন্মে যে-মানুষ ঘোড়া চালায় নি, তাকে ঘোড়া চালাতে দাও, ঘোড়াকে চাবুক মেরে মেরেই জর্জরিত করবে; সে জানে না যে, একটু লাগাম টেনে দিলেই তাকে চালানো যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে এক-একটি ভদ্র সাহেবকে দেখা যায়, তাঁরা অ্যাংগ্লো-ইণ্ডিয়ানত্বের ঘোরতর সংক্রামক রোগের মধ্যে থেকেও বিশুদ্ধ থাকেন, অপ্রতিহত প্রভুত্ব ও ক্ষমতা পেয়েও উদ্ধত গর্বিত হয়ে ওঠেন না। সমাজ-শৃঙ্খল ছিন্ন হয়ে, সহস্র সেবকদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে ভারতবর্ষে থাকা উন্নত ও ভদ্র মনের একপ্রকার অগ্নিপরীক্ষা। যা হক, এত ক্ষণে জাহাজ সাউদ্যাম্পটনে এসে পৌঁচেছে। বঙ্গীয় যাত্রীরা বিলেতে এসে পৌঁছলেন। লণ্ডন উদ্দেশে চললেন। ট্রেন থেকে নাববার সময় কেজন ইংরেজ গার্ড এসে উপস্থিত। বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে, তাঁদের কী প্রয়োজন আছে, কী করে দিতে হবে। তাঁদের মোট নাবিয়ে দিলে, গাড়ি ডেকে দিলে, তাঁরা মনে মনে বললেন, “বাঃ! ইংরেজরা কী ভদ্র!” ইংরেজরা যে এত ভদ্র হতে পারে, তা তাঁদের জ্ঞান ছিল না। তার হস্তে একটি শিলিং গুঁজে দিতে হল বটে। তা হক একজন নবাগত বঙ্গ-যুবক একজন যে -কোনো শ্বেতাঙ্গের কাছ থেকে একটি মাত্র সেলাম পেতে অকাতরে এক শিলিং ব্যয় করতে পারেন। আমি যাঁদের কাছ থেকে সব কথা শুনতে পাই, তাঁরা অনেক বৎসর বিলেতে আছেন, বিলেতের নানাপ্রকার ছোটোখাটো জিনিস দেখে তাঁদের প্রথম কী রকম মনে হয়েছিল, তা তাঁদের স্পষ্ট মনে নেই। যে-সব বিষয়ে তাঁদের বিশেষ মনে লেগেছিল, তাই এখনো তাঁদের মনে আছে। তাঁরা বিলেতে অসবার পূর্বে তাঁদের বিলিতি বন্ধুরা এখানে তাঁদের জন্যে ঘর ঠিক করে রেখেছিলেন। ঘরে ঢুকে দেখেন, ঘরে কার্পেট পাতা, দেয়ালে ছবি টাঙানো, একটা বড়ো আয়না এক জায়গায় ঝোলানো, কৌচ, কতকগুলি চৌকি, দুই-একটা কাঁচের ফুলদানি, এক পাশে একটি ছোটো পিয়ানো। কী সর্বনাশ! তাঁদের বন্ধুদের ডেকে বললেন, “আমরা কি এখেনে বড়োমানুষি করতে এসেছি? আমাদের বাপু বেশি টাকাকড়ি নেই, এ রকম ঘরে থাকা আমাদের পোষাবে না!” বন্ধুরা অত্যন্ত আমোদ পেলেন, কারণ তখন তাঁরা একেবারে ভুলে গেছেন যে বহুপূর্বে তাঁদেরও একদিন এইরকম দশা ঘটেছিল। নবাগতদের নিতান্ত অন্নজীবী বাঙালি মনে করে অত্যন্ত বিজ্ঞতার স্বরে বললেন, “এখানকার সকল ঘরই এইরকম!” নবাগত ভাবলেন, আমাদের দেশে সেই একটা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে একটা তক্তা ও তার উপরে একটা মাদুর পাতা, ইতস্তত হুঁকোর বৈঠক, কোমরে একটুখানি কাপড় জড়িয়ে জুতোজোড়া খুলে দু-চার জন মিলে শতরঞ্চ খেলা চলছে, বাড়ির উঠোনে একটা গোরু বাঁধা, দেয়ালে গোবর দেওয়া, বারান্দা থেকে ভিজে কাপড় শুকোচ্ছে ইত্যাদি। তাঁরা বলেন, প্রথম প্রথম দিনকতক চৌকিতে বসতে, কৌচে শুতে, টেবিলে খেতে, কার্পেটে বিচরণ করতে অত্যন্ত সংকোচ বোধ হত। সোফায় অত্যন্ত আড় হয়ে বসতেন, ভয় হত, পাছে সোফা ময়লা হয়ে যায় বা তার কোনোপ্রকার হানি হয়। মনে হত সোফাগুলো কেবল ঘর সাজাবার জন্যেই রেখে দেওয়া, এগুলো ব্যবহার করতে দিয়ে মাটি করা কখনোই ঘরের কর্তার অভিপ্রেত হতে পারে না। ঘরে এসে প্রথম মনের ভাব তো এই, তার পরে আর-একটি প্রধান কথা বলা বাকি। বিলেতে ছোটোখাটো বাড়িতে “বাড়িওআলা” বলে একটা জীবের অস্তিত্ব আছে হয়তো, কিন্তু যাঁরা বাড়িতে থাকেন, “বাড়িওআলী”র সঙ্গেই তাঁদের সমস্ত সম্পর্ক। ভাড়া চুকিয়ে দেওয়া, কোনোপ্রকার বোঝাপড়া, আহারাদির বন্দেবস্ত করা, সে সমস্তই বাড়িওআলীর কাছে। আমার বন্ধুর যখন প্রথম পদার্পণ করলেন, দেখলেন, এক ইংরজনী এসে অতি বিনীত স্বরে তাঁদের ‘সুপ্রভাত’ অভিবাদন করলে, তাঁরা নিতান্ত শশব্যস্ত হয়ে ভদ্রতার যথাযোগ্য প্রতিদান দিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু যখন তাঁরা দেখলেন, তাঁদের অন্যান্য ইঙ্গবঙ্গ বন্ধুগণ তার সঙ্গে অতি অসংকুচিত স্বরে কথাবার্তা আরম্ভ করে দিলেন, তখন আর তাঁদের বিসময়ের আদি অন্ত রই না। মনে করো এক সজীব বিবিসাহেব জুতো-পরা, টুপি-পরা, গাউন-পরা! তখন ইঙ্গবঙ্গ বন্ধুদের উপর সেই নবাগত বঙ্গযুবকদের ভক্তির উদয় হল, কোনো কালে যে এই অসমসাহসিকদের মতো তাঁদেরও বুকের পাটা জন্মাবে, তা তাঁদের সম্ভব বোধ হল না। যা হক, এই নবাগতদের যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে ইঙ্গবঙ্গ বন্ধুগণ স্ব স্ব আলয়ে গিয়ে সপ্তাহকাল ধরে তাঁদের অজ্ঞতা নিয়ে অপর্যাপ্ত হাস্যকৌতুক করলেন। পূর্বোক্ত গৃহকর্ত্রী প্রত্যহ নবাগতদের অতি বিনীতভাবে, কী চাই, কী না চাই, জিজ্ঞাসা করতে আসত। তাঁরা বলেন, এই উপলক্ষে তাঁদের অত্যন্ত আহ্লাদ হত। তাঁদের মধ্যে একজন বলেন, প্রথম দিন যেদিন তিনি এই ইংরেজ মেয়েকে একটুখানি ধমকাতে পেরেছিলেন, সেদিন সমস্ত দিন তাঁর মন অত্যন্ত প্রফুল্ল ছিল। অথচ সেদিন সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে নি, পর্বত চলাফেরা করে বেড়ায় নি, বহ্নিও শীতলতা প্রাপ্ত হয় নি। কার্পেট-মোড়া ঘরে তাঁরা সুখে বাস করছেন। তাঁরা বলেন, “আমাদের দেশে নিজের ঘর বলে একটা স্বতন্ত্র পদার্থ ছিল না; যে-ঘরে বসতেম, সে-ঘরে বাড়ির দশজনে যাতায়াত করছেই। আমি একপাশে লিখছি, দাদা একপাশে একখানা বই হাতে করে ঢুলছেন, আর-এক দিকে মাদুর পেতে গুরুমশায় ভুলুকে উচ্চৈঃস্বরে সুর করে করে নামতা পড়াচ্ছেন। এখানে আমার নিজের ঘর; সুবিধামতো করে বইগুলি এক দিকে সাজালেম, লেখবার সরঞ্জাম একদিকে গুছিয়ে রাখলেম, কোনো ভয় নেই যে, একদিন পাঁচটা ছেলে মিলে সমস্ত ওলট-পালট করে দেবে, আর-এক দিন দুটোর সময় কলেজ থেকে এসে দেখব, তিনটে বই পাওয়া যাচ্ছে না, অবশেষে অনেক খোঁজ-খোঁজ করে দেখা যাবে বইগুলি নিয়ে আমার ছোটো ভাগ্নীটি তাঁর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সহচরীদের ডেকে ছবি দেখতে ঘোরতর ব্যস্ত। এখানে নিজের ঘরে বসে থাকো, দরজাটি ভেজানো, সট করে না বলে কয়ে কেউ ঘরে মধ্যে এসে পড়ে না, ঘরে ঢোকবার আগে দরজায় হব্দ করে, ছেলেপিলেগুলো চারিদিকে চেঁচামেচি কান্নাকাটি জুড়ো দেয় নি, নিরিবিলি নিরালা, কোনো হাঙ্গামা নেই।” দেশের সম্বন্ধে মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে। প্রায় দেখা যায় আমাদের দেশের পুরুষেরা এখানকার পুরুষ-সমাজে বড় মেশেন না। কারণ এখানকার পুরুষসমাজে মিশতে গেলে একরকম বলিষ্ঠ স্ফূর্ত্তির ভাব থাকা চাই, বাধো-বাধো মিঠে সুরে দু-চারটে সসংকোচ ‘হাঁ না’ দিয়ে গেলে চলে না। বাঙালি অভ্যাগত ডিনার টেবিলে তাঁর পার্শ্বস্থ মহিলাটির কানে কানে মিষ্টি মিষ্টি টুকরো টুকরো দুই-একটি কথা মৃদু ধীর স্বরে কইতে পারেন, আর সে মহিলার সহবাসে তিনি যে স্বর্গ-সুখ উপভোগ করছেন, তা তাঁর মাথার চুল থেকে বুট জুতোর আগা পর্যন্ত প্রকাশ হতে থাকে, সুতরাং মেয়ে-সমাজে বাঙালিরা পসার করে নিতে পারেন। আমাদের দেশে ঘোমটাচ্ছন্ন-মুখচন্দ্রশোভী অনালোকিত অন্তঃপুর থেকে এখানকার রূপের মুক্ত জ্যোৎস্নায় এসে আমাদের মন-চকোর প্রাণ খুলে গান গেয়ে ওঠে। এক দিন আমাদের নবাগত বঙ্গযুবক তাঁর প্রথম ডিনারের নিমন্ত্রণে গিয়েছেন। নিমন্ত্রণসভায় বিদেশীর অত্যন্ত সমাদর। তিনি গৃহস্বামীর যুবতী কন্যা মিস অমুকের বাহু গ্রহণ করে আহারের টেবিলে গিয়ে বসলেন। আমাদের দেশের স্ত্রীলোকদের সঙ্গে মুক্তভাবে মিশতে পাই নে, তার পরে নতুন নতুন এসে এখানকার স্ত্রীলোকদের ভাবও ঠিক বুঝতে পারি নে। কোনো সামাজিকতার অনুরোধে তারা আমাদের মনোরঞ্জন করবার জন্যে যেসেকল কথাবার্তা হাস্যালাপ করে, আমরা তার ঠিক মর্ম-গ্রহণ করতে পারি নে, আমরা হঠাৎ মনে করি, আমাদের উপরেই এই মহিলাটির বিশেষ অনুকূল দৃষ্টি। আমাদের বঙ্গযুবকটি মিসকে ভারতবর্ষ সংক্রান্ত অনেক কথা জানালেন। বললেন তাঁর বিলেত অত্যন্ত ভালো লাগে, ভারতবর্ষে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না, ভারতবর্ষে অনেক প্রকার কুসংস্কার আছে। শেষকালে দুই-একটি সাজানো কথাও বললেন। যথা, তিনি সুন্দরবনে বাঘ শিকার করতে গিয়ে একবার মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন। মিসটি অতি সহজে বুঝতে পারলেন যে, এই যুবকের তাঁকে অত্যন্ত ভালো লেগেছে। তিনি যথেষ্ট সন্তুষ্ট হলেন ও তাঁর মিষ্টতম বাক্যবাণ যুবকের প্রাণে হানতে লাগলেন। “আহা, কী গোছালো কথা! কোথায় আমাদের দেশের মেয়েদের মুখের সেই নিতান্ত শ্রমলভ্য দুই-একটি ‘হাঁ না’ যা এত মৃদু যে ঘোমটার সীমার মধ্যেই মিলিয়ে যায়; আর কোথায় এখানকার বিম্বৌষ্ঠ-নিঃসৃত অজস্র মধুধারা, যা অযাচিতভাবে মদিরার মতো শিরায় শিরায় প্রবেশ করে!” হয়তো বুঝতে পারছে, কী কী মসলার সংযোগে বাঙালি বলে একটা পদার্থ ক্রমে ইঙ্গবঙ্গ নামে একটা খিচুড়িতে পরিণত হয়। সমস্ত প্রক্রিয়াটা বিস্তারিত করে লিখতে পারি নি। এত সব ছোটো ছোটো বিষয়ের সমষ্টি মানুষের মনে অলক্ষিত পবির্তন উপস্থিত করে যে, সে-সকল খুঁটিনাটি করে বর্ণনা করতে গেলে পুঁথি বেড়ে যায়। ইঙ্গবঙ্গদের ভালো করে চিনতে গেলে তাঁদের তিন রকম অবস্থায় দেখতে হয়। তাঁরা ইংরেজদের সম্মুখে কী রকম ব্যবহার করেন, বাঙালিদের সম্মুখে কী রকম ব্যবহার করেন ও তাঁদের স্বজাত ইঙ্গবঙ্গদের সম্মুখে কী রকম ব্যবহার করেন। একটি ইঙ্গবঙ্গকে একজন ইংরেজের সম্মুখে দেখো, চক্ষু জুড়িয়ে যাবে। ভদ্রতার ভারে প্রতি কথায় ঘাড় নুয়ে নুয়ে পড়ছে, তর্ক করবার সময় অতিশয় সাবধানে নরম করে প্রতিবাদ করেন ও প্রতিবাদ করতে হল বলে অপর্যাপ্ত দুঃখ প্রকাশ করেন, অসংখ্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কথা কন আর না কন, একজন ইংরেজের কাছে একজন ইঙ্গবঙ্গ চুপ করে বসে থাকলেও তাঁর প্রতি অঙ্গভঙ্গী, প্রতি মুখের ভাবে বিনয়ের পরাকাষ্ঠা প্রকাশ হতে থাকে। কিন্তু তাঁকেই আবার তাঁর স্বজাতিমণ্ডলে দেখো, দেখবে তাঁর মেজাজ। বিলেতে যিনি তিন বৎসর আছেন, এক বৎসরের বিলেতবাসীর কাছে তাঁর অত্যন্ত পায়া ভারি। এই তিন বৎসর ও এক বৎসরের মধ্যে যদি কখনো তর্ক ওঠে, তা হলে তুমি “তিন বৎসরের” প্রতাপটা একবার দেখতে পাও। তিনি প্রতি কথা এমন ভাবে, এমন স্বরে বলেন যে, যেন সেই কথাগুলি নিয়ে সরস্বতীর সঙ্গে তাঁর বিশেষ বোঝাপড়া হয়ে একটা স্থিরসিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। যিনি প্রতিবাদ করছেন, তাঁকে তিনি স্পষ্টাক্ষরে বলেন ‘ভ্রান্ত’ কখনো বা মুখের উপর বলেন ‘মূর্খ’। সেদিন এক জন গল্প করছিলেন, যে তাঁকে আর-এক জন বাঙালি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, “মশায়ের কী কাজ করা হয়?” এই গল্প শুনবামাত্র আমাদের একজন ইঙ্গবঙ্গ বন্ধু নিদারুণ ঘৃণার সঙ্গে বলে উঠলেন, “দেখুন দেখি, কী বার্বারাস!” ভাবটা এই যে, যেমন মিথ্যে কথা না বলা, চুরি না করা নীতি-শাস্ত্রের কতকগুলি মূল নিয়ম, তেমনি অন্য মানুষকে তার জীবিকার কথা জিজ্ঞাসা না করাও একটা মূল নিয়মের মধ্যে। সেদিন এক জায়গায় আমাদের দেশের শ্রাদ্ধের কথা হচ্ছিল, বাপ-মার মৃত্যুর পর আমরা হবিষ্য করি, বেশভূষা করি নে ইত্যাদি। শুনে একজন ইঙ্গবঙ্গ যুবক অধীর ভাবে আমাকে বলে উঠলেন যে, “আপনি অবিশ্যি, মশায়, এ-সকল অনুষ্ঠান ভালো বলেন না।” আমি বললেম, “কেন নয়? আমি দেখছি ইংরেজরা যদি আত্মীয়ের মৃত্যু উপলক্ষ্যে হবিষ্যান্ন খেত, আর আমাদের দেশের লোকরা না খেত, তা হলে হবিষান্ন খায় না বলে আমাদের দেশের লোকের উপর তোমার দ্বিগুণতর ঘৃণা হত, ও মনে করতে, হবিষ্যান্ন খায় না বলেই আমাদের দেশের এত দুর্দশা।” তুমি হয়তো জানো ইংরেজরা এক টেবিলে তেরো জন খাওয়া অলক্ষণ মনে করে, তাদের বিশ্বাস, তা হলে এক বৎসরের মধ্যে তাদের একজনের মৃত্যু হবেই। এক জন ইঙ্গবঙ্গ যখন নিমন্ত্রণ করেন তখন কোনোমতে তেরো জন নিমন্ত্রণ করেন না, জিজ্ঞাসা করলে বলেন, “আমি নিজে বিশ্বাস করি নে, কিন্তু যাঁদের নিমন্ত্রণ করি তাঁরা পাছে ভয় নান তাই বাধ্য হয়ে এ নিয়ম পালন করতে হয়।” সেদিন এক জন ইঙ্গবঙ্গ তাঁর একটি আত্মীয় বালককে রবিবার দিনে রাস্তায় খেলা করতে যেতে বারণ করছিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, “রাস্তার লোকেরা কী মনে করবে?” কতকগুলি বাঙালি বলেন, এখানকার মতো ঘর ভাড়া দেবার প্রথা তাঁরা আমাদের দেশে প্রচলিত করবেন। তাঁদের সেই একটিমাত্র সাধ। আর-এক জন বাঙালি বাংলা সমাজ সংস্কার করতে চান, বিলেতের সমাজে মেয়ে পুরুষে একত্রে নাচাটাই তাঁর চোখে অত্যন্ত ভালো লেগেছে। কতকগুলি সাধারণ বিষয়ে আমাদের দেশের ও এদেশের মেয়েদের অমিল দেখে তার পরে তিনি কতকগুলি বিশেষ বিশেষ বিষয় নিয়ে ছেলেমানুষের মতো খুঁতখুঁত করতে থাকেন। একজন ইঙ্গবঙ্গ নালিশ করছিলেন যে, আমাদের দেশের মেয়েরা পিয়ানো বাজাতে পারে না, ও এখানকার মতো ভিজিটারদের সঙ্গে দেখা করতে ও ভিজিট প্রত্যর্পণ করতে যায় না। এই রকম ক্রমাগত প্রতি ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে এ-দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করে করে তাঁদের চটাভাব চটনমান যন্ত্রে ব্লাড হীট ছাড়িয়ে ওঠে। একজন ইঙ্গবঙ্গ তাঁর সমবেদক বন্ধুদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে বলছিলেন, যে, যখন তিনি মনে করেন যে, দেশে ফিরে গেলে তাঁকে চারি দিকে ঘিরে মেয়েগুলো প্যান প্যান করে কাঁদতে আরম্ভ করবে, তখন আর তাঁর দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। অর্থাৎ তিনি চান যে, তাঁকে দেখেবামাত্রই ‘ডিয়ার ডার্লিং’ বলে ছুটে এসে তাঁর স্ত্রী তাঁকে আলিঙ্গন ও চুম্বন করে তাঁর কাঁধে মাথা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। ডিনারের টেবিলে কাঁটা ছুরি উল্‌টে ধরতে হবে, কি পাল্‌টে ধরতে হবে তাই জানবার জন্যে তাঁদের গবেষণা দেখলে তাঁদের উপর ভক্তির উদয় হয়। কোটের কোন ছাঁটটা ফ্যাশন-সংগত, আজকাল নোবিলিটি আঁট প্যান্টলুন পরেন কি ঢলকো পরেন, ওয়ালট্‌স্‌ নাচেন কি পোলকা মর্জুকা, মাছের পর মাংস খান কি মাংসের পর মাছ, সে-বিষয়ে তাঁরা অভ্রান্ত খবর রাখেন। ঐরকম ছোটোখাটো বিষয়ে এক জন বাঙালি যত দস্তুরেবেদস্তুর নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, এমন এ-দিশি করে না। তুমি যদি মাছ খাবার সময় ছুরি ব্যবহার কর তবে এক জন ইংরেজ তাতে বড়ো আশ্চর্য হবেন না, কেননা তিনি জানেন তুমি বিদেশী, কিন্তু একজন ইঙ্গবঙ্গ সেখানে উপস্থিত থাকলে তাঁর সেমলিং সল্‌টের আবশ্যক করবে। তুমি যদি শেরি খাবার গ্লাসে শ্যাম্পেন খাও তবে একজন ইঙ্গবঙ্গ তোমার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকবেন, যেন তোমার এই অজ্ঞতার জন্যে সমস্ত পৃথিবীর সুখ শান্তি নষ্ট হবার উপক্রম হয়েছে। সন্ধ্যেবেলায় তুমি যদি মর্নিং কোট পর, তা হলে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট হলে জেলে নির্জনবাসের আজ্ঞা দিতেন। এক জন বিলেত-ফেরতা কাউকে মটন দিয়ে রাই দিয়ে খেতে দেখলে বলতেন, “তবে কেন মাথা দিয়ে চল না?” আর একটি আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখেছি যে, বাঙালিরা ইংরেজদের কাছে স্বদেশের লোকেদের ও আচার-ব্যবহারের যত নিন্দে করেন, এমন এক জন ভারতদ্বেষী অ্যাংগ্লো ইণ্ডিয়ানও করেন না। তিনি নিজে ইচ্ছা করে কথা পাড়েন ও ভারতবর্ষের নানাপ্রকার কুসংস্কার প্রভৃতি নিয়ে প্রাণ খুলে হাস্যপরিহাস করেন। তিনি গল্প করেন যে, আমাদের দেশে বল্লভাচার্যের দল বলে একরকম বৈষ্ণবের দল আছে। তাদের সমস্ত অনুষ্ঠান সবিস্তারে বর্ণনা করতে থাকেন। সভার লোকদের হাসাবার অভিপ্রায়ে নেটিব নচ-গার্লরা কী রকম করে নাচে, অঙ্গভঙ্গী করে তার নকল করেন ও তাই দেখে সকলে হাসলে আনন্দ উপভোগ করেন। তাঁর নিতান্ত ইচ্ছে, তাঁকে কেউ ভারতবর্ষীয় দলের মধ্যে গণ্য না করে। সাহেব-সাজা বাঙালিদের প্রতি পদে ভয়, পাছে তাঁরা বাঙালি বলে ধরা পড়েন। এক জন বাঙালি একবার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর-এক জন ভারতবর্ষীয় এসে তাঁকে হিন্দুস্থানিতে দুই-এক কথা জিজ্ঞাসা করে, তিনি মহা খাপা হয়ে উত্তর না দিয়ে চলে যান। তাঁর ইচ্ছে, তাঁকে দেখে কেউ মনে না করতে পারে যে, তিনি হিন্দুস্থানি বোঝেন। একজন ইঙ্গবঙ্গ একটি ‘জাতীয় সংগীত’ রামপ্রসাদী সুরে রচনা করেছেন; এই গানটার একটু অংহ পূর্ব পত্রে লিখেছি, বাকি আর-একটুকু মনে পড়েছে, এই জন্য আবার তার উল্লেখ করছি। এ গীত যাঁর রচনা, তিনি রামপ্রসাদের মতো শ্যামার উপাসক নন, তিনি গৌরীভক্ত। এই জন্যে গৌরীকে সম্বোধন করে বলছেন – মা, এবার মলে সাহেব হব; রাঙা চুলে হাট বসিয়ে, পোড়া নেটিব নাম ঘোচাব। সাদা হাতে হাত দিয়ে মা, বাগানে বেড়াতে যাব (আবার) কালো বদন দেখলে পরে ‘ডার্কি’ বলে মুখ ফেরাব। আমি পূর্বেই বিলাতে বাড়িওআলী শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেছি। তারা বাড়ির লোকদের আবশ্যকমতো সেবা করে। অনেক ভাড়াটে থাকলে তারা চাকরানী রাখে বা অন্য আত্মীয়েরা তাদের সাহায্য করবার জন্যে থাকে। অনেকে সুন্দরী ল্যাণ্ডলেডি দেখে ঘর ভাড়া করেন। বাড়িতে পদার্পণ করেই ল্যাণ্ডলেডির যুবতী কন্যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে নেন, দু-তিন দিনের মধ্যে তার একটি আদরের নামকরণ করা হয়, সপ্তাহ অতীত হলে তার নামে হয়তো একটা কবিতা রচনা করে তাকে উপহার দেন। সেদিন ল্যাণ্ডলেডির মেয়ে তাঁকে এক পেয়ালা চা এনে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, চায়ে কি চিনি দিতে হবে? তিনি হেসে বললেন, “না নেলি, তুমি যখন ছুঁয়ে দিয়েছ, তখন আর চিনি দেবার দরকার দেখছি নে!” আমি জানি, এক জন ইঙ্গবঙ্গ তাঁর বাড়ির দাসীদের মেজদিদি সেজদিদি বলে ডাকতেন। আমি এক জনকে জানি, তিনি তাঁর মেজদিদি-সেজদিদিবর্গকে এত মান্য করে চলতেন যে, তাঁর ঘরে বা তাঁর পাশের ঘরে যদি এদের মধ্যে কেউ উপস্থিত থাকত, এবং সে অবস্থায় যদি তাঁর কোনো ইঙ্গবঙ্গ বন্ধু গান বা হাস্যপরিহাস করতেন তা হলে তিনি মহা অপ্রতিভ হয়ে বলে উঠতেন, “আরে চুপ করো, চুপ করো, মিস এমিলি কী মনে করবেন?” আমার মনে আছে, দেশে থাকতে একবার এক ব্যক্তি বিলেত থেকে ফিরে গেলে পর, আমরা তাকে খাওয়াই। খাবার সময় তিনি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, “এই আমি প্রথম খাচ্ছি, যেদিন আমার খাবার টেবিলে কোনো লেডি নেই।” এক জন ইঙ্গবঙ্গ একবার তাঁর কতকগুলি বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। খাবার টেবিলে কতকগুলি ল্যাণ্ডলেডি ও দাসী বসে ছিল, তাদের এক জনের ময়লা কাপড় দেখে নিমন্ত্রণকর্তা তাকে কাপড় বদলে আসতে অনুরোধ করেছিলেন, শুনে সে বললে, “যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে ময়লা কাপড়েও ভালোবাসা যায়।” এইবার ইঙ্গবঙ্গদের একটি গুণের কথা তেমাকে বলছি। এখানে যাঁরা আসেন, অনেকেই কবুল করেন না যে তাঁরা বিবাহিত, যেহেতু স্বভাবতই যুবতী কুমারী সমাজে বিবাহিতদের দাম অল্প। অবিবাহিত বলে পরিচয় দিলে এখানকার অবিবাহিতাদের সঙ্গে মিশে অনেক যথেচ্ছাচার করা যায়, কিন্তু বিবাহিত বলে জানলে তোমার অবিবাহিত সঙ্গীরা ও-রকম অনিয়ম করতে দেয় না, সুতরাং অবিবাহিত বলে পরিচয় দিলে অনেক লাভ আছে। অনেক ইঙ্গবঙ্গ দেখতে পাবে তাঁরা আমার এই বর্ণনার বহির্গত। কিন্তু সাধারণত ইঙ্গবঙ্গত্বের লক্ষণগুলি আমি যতদূর জানি তা লিখেছি। ভারতবর্ষে গিয়ে ইঙ্গবঙ্গদের কী রকম অবস্থা হয় সে-বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতাও নেই, বক্তব্যও নেই। কিন্তু কিছু কাল ভারতবর্ষে থেকে তার পরে ইংলণ্ডে এলে কী রকম ভাব হয় তা আমি অনেকের দেখেছি। তাঁদের ইংলণ্ড আর তেমন ভালো লাগে না; অনেক সময়ে তাঁরা ভেবে পান না, ইংলণ্ড বদলেছে, কি তাঁরা বদলেছেন। আগে ইংলণ্ডের অতি সামান্য জিনিস ভালো লাগত; এখন ইংলণ্ডের শীত ইংলণ্ডের বর্ষা তাঁদের ভাল লাগছে না, এখন তাঁরা ভারতবর্ষে ফিরে যেতে হলে দুঃখিত হন না। তাঁরা বলেন, আগে তাঁরা ইংলণ্ডের স্ট্রবেরিই ফল অত্যন্ত ভালবাসতেন। এমনকি তাঁরা যতরকম ফল খেয়েছেন তার মধ্যে স্ট্রবেরিই তাঁদের সকলের চেয়ে স্বাদু মনে হত। কিন্তু এই কয় বৎসরের মধ্যে স্ট্রবেরির স্বাদ বদলে গেল নাকি। এখন দেখছেন তার চেয়ে অনেক দিশি ফল তাঁদের ভালো লাগে। আগে ডেভনশিয়রের ক্রীম তাদের এত ভালো লাগত যে, তার আর কথা নেই, কিন্তু এখন দেখছেন আমাদের দেশের ক্ষীর তার চেয়ে ঢের ভালো। তাঁরা ভারতবর্ষে গিয়ে স্ত্রীপুত্রপরিবার নিয়ে সংসারী হয়ে পড়েন, রোজগার করতে আরম্ভ করেন, ভারতবর্ষের মাটিতে তাদের শিকড় এক রকম বসে যায়। মনটা কেমন শিথিল হয়ে আসে, তখন পায়ের উপর পা দিয়ে টানা পাখার বাতাস খেয়ে কোনোপ্রকার দিন কাটিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত থাকেন। বিলেতে আমোদ বিলাস ভোগ করতে গেলেও অনেক উদ্যমের আবশ্যক করে। এখানে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যেতে হলে গাড়ির চলন নেই, হাত-পা নাড়তে চাড়তে দশটা চাকরের উপর নির্ভর করলে চলে না। গাড়িভাড়া অত্যন্ত বেশি, আর চাকরের মাইনে মাসে সাড়ে তিন টাকা নয়। থিয়েটার দেখতে যাও; সন্ধ্যেবেলা বৃষ্টি পড়ছে, পথে কাদা, একটা ছাতা ঘাড়ে করে মাইল কতক ছুটোছুটি করে তবে ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারবে। যখন রক্তের তেজ থাকে তখন এ-সকল পেরে ওঠা যায়। %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AA-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%B0_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0/%E0%A6%B7%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A0_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 য়ুরোপ-প্রবাসীর ষষ্ঠ পত্র আমাদের ব্রাইটনের বাড়িটি সমুদ্রের কাছে একটি নিরালা জায়গায়। এক সার কুড়ি-পঁচিশটি বাড়ি, বাড়িগুলির নাম মেডিনা ভিলাজ। হঠাৎ মনে হয়েছিল বাগান-বাড়ি। এখানে এসে দেখি, ‘ভিলা’ত্বর মধ্যে আমাদের বাড়ির সামনে দু-চার হাত জমিতে দু-চারটে গাছ পোঁত আছে। বাড়ির দরজায় একটা লোহার কড়া লাগানো সেইটেতে ঠক ঠক করলেম, আমাদের ল্যাণ্ডলেডি এসে দরজা খুলে দিলে। আমাদের দেশের তুলনায় এখানকার ঘরগুলো লম্বা চওড়া ও উঁচুতে ঢের ছোটো। চারিদিকে জানলা বন্ধ, একটু বাতাস আসবার জো নেই, কেবল জানলাগুলো সমস্ত কাঁচের বলে আলো আসে। শীতের পক্ষে এ-রকম ছোটোখাটো ঘরগুলো ভালো, একটু আগুন জ্বলালেই সমস্ত বেশ গরম হয়ে ওঠে, কিন্তু তা হক, যেদিন মেঘে চারদিক অন্ধকার, টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, তিনি-চার দিন ধরে মেঘ-বৃষ্টি-অন্ধকারের এক মুহূর্ত বিরাম নেই সেদিন এই ছোটো অন্ধকার ঘরটার এক কোণে বসে আমার মনটা অত্যন্ত বিগড়ে যায়, কোনোমতে সময় কাটে না। খালি আমি বলে নয়, আমার ইংরেজ আলাপীরা বলেন সে-রকম দিনে তাঁদের অত্যন্ত swear করার প্রবৃত্তি জন্মায় (swear করা রোগটা সম্পূর্ণ য়ুরোপীয়, সুতরাং ওর বংলা কোনো নাম নেই), মনের ভাবটা অধার্মিক হয়ে ওঠে। যা হক এখানকার ঘর-দুয়ারগুলি বেশ পরিষ্কার; বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলে কোথাও ধুলো দেখবার জো নেই, মেজের সর্বাঙ্গ কার্পেট প্রভৃতি মোড়া, সিঁড়িগুলি পরিষ্কার তক তক করছে। চোখে দেখতে খারাপ হলে এরা সইতে পারে না। প্রতি সামান্য বিষয়ে এদের ভালো দেখতে হওয়াটা প্রধান আবশ্যক। শোকবস্ত্রও সুশ্রী দেখতে হওয়া চাই। আমরা যাকে পরিষ্কার বলি সেটা কিন্তু আর একটা জিনিস। এখানকার লোকেরা খাবার পরে আঁচায় না, কেন না আঁচানো জল মুখ থেকে পড়ছে সে অতি কুশ্রী দেখায়। শ্রী হানি হয় বলে পরিষ্কার হওয়া হয় না। এখানে যে-রকম কাসি-সর্দির প্রাদুর্ভাব, তাতে ঘরে একটা পিকদান নিতান্ত অবশ্যক, কিন্তু তার ব্যবহার কুশ্রী বলে ঘরে রাখা হয় না, রুমালে সমস্ত কাজ চলে। আমাদের দেশের যে রকম পরিষ্কার ভাব, তাতে আমরা বরঞ্চ ঘরে একটা পিকদানি রাখতে পারি, কিন্তু জামার পকেটে এ-রকম একটা বীভৎস পদার্থ বহন করতে ঘৃণা হয়। কিন্তু এখানে চোখেরই অধিপত্য। রুমাল কেউ দেখতে পাবে না, তা হলেই হল। চুলটি বেশ পরিষ্কার করে আঁচড়ানো থাকবে, মুখটি ও হাত দুটি সাফ থাকবে, স্নান করবার বিশেষ দরকার নেই। এখানে জামার উপরে অন্যান্য অনেক কাপড় পরে বলে জামার সমস্তটা দেখা যায় না, খালি বুকের ও হাতের কাছে একটু বেরিয়ে থাকে। একরকম জামা আছে, তার যতটুকু বেরিয়ে থাকে ততটুকু জোড়া দেওয়া, সেটুকু খুলে ধোবার বাড়ি দেওয়া যায়; তাতে সুবিধে হচ্ছে যে ময়লা হয়ে গেলে জামা বদলাবার কোনো আবশ্যক করে না, সেই জোড়া টুকরোগুলো বদলালেই হল। এখানকার দাসীদের কোমরে এক আঁচল-বাঁধা থাকে, সেইটি দিয়ে তারা না পোঁছে এমন পদার্থ নেই; খাবার কাঁচের প্লেট যে দেখছ ঝক ঝক্‌ করছে, সেটিও সেই সর্ব-পাবক-আঁচল দিয়ে মোছা হয়েছে, কিন্তু তাতে কী হানি, কিছু খারাপ দেখাচ্ছে না। এখানকার লোকেরা অপরিষ্কার নয়, আমাদের দেশে যাকে ‘নোংরা’ বলে তাই। এখানে পরিষ্কার ভাবের যে অভাব আমরা দেখতে পাই, সে অনেকটা শীতের জন্যে। আমরা যে-কোনো জিনিস হক না কেন, জল দিয়ে পরিষ্কার না হলে পরিষ্কার মনে করি নে। এখানে অত জল নিয়ে নাড়াচাড়া পোষায় না। তাছাড়া শীতের জন্য এখানকার জিনিসপত্র শীঘ্র নোংরা হয়ে ওঠে না। এখানে শীতে ও গায়ের আবরণ থাকাতে শরীর তত অপরিষ্কার হয় না। এখানে জিনিসপত্র পচে ওঠে না। এইরকম পরিষ্কারের পক্ষে নানা বিষয়ে সুবিধে। আমাদের যেমন পরিষ্কার ভাব আছে, তেমনি পরিষ্কার হওয়ার বিষয়ে অনেক ঢিলেমিও আছে। আমাদের দেশের পুষ্করিণীতে কী না ফেলে? অপরিষ্কার জলকুণ্ডের স্নান; তেল মেখে দুটো ডুব দিলেই আমরা শুচিতা কল্পনা করি। আমরা নিজের শরীর ও খাওয়া-দাওয়া সংক্রান্ত জিনিসের বিষয়ে বিশেষ পরিষ্কার থাকি, কিন্তু ঘরদুয়ার যথোচিত পরিষ্কার করি নে। এমন কি অস্বাসথ্যকর করে তুলি। আমাদের দুই-একটি করে আলাপী হতে লাগল। ডাক্তার ম—এক জন আধবুড়ো চিকিৎসাব্যবসায়ী। তিনি এক জন প্রকৃত ইংরেজ, ইংলণ্ডের বহির্ভূত কোনো জিনিস তাঁর পছন্দসই নয়। তাঁর কাছে ক্ষুদ্র ইংলণ্ডই সমস্ত পৃথিবী, তাঁর কল্পনা কখনো ডোভার প্রণালী পার হয় নি। তাঁর কল্পনার এমন অভাব যে, তিনি মনে করতে পারেন না যারা বাইবেলের দশ অনুশাসন মানে না, তাদের মিথ্যে কথা বলতে কী করে সংকোচ হতে পারে। অখ্রীষ্ট লোকদের নীতির বির এই তাঁর প্রধান যুক্তি। যে ইংরেজ নয়, যে খ্রীষ্টান নয়, এমন একটা অপূর্ব সৃষ্টি দেখলে তার মনুষ্যত্ব কী করে থাকতে পার ভেবে পান না। তাঁর মটো হচ্ছে Gladly he would learn and gladly teach, কিন্তু আমি দেখলুম তাঁর লার্ন করবার ঢের আছে, কিন্তু টীচ করবার মতো সম্বল বেশি নেই। তাঁর স্বদেশীয় সাহিত্যের বিষয়ে তিনি আশ্চর্য কম জানেন; কতকগুলি মাসিক পত্রিকা পড়ে তিনি প্রতি মাসে দুই-চারিটি করে ভাসা ভাসা জ্ঞান লাভ করেন। তিনি কল্পনা করতে পারেন না একজন ভারতীয় কী করে এডুকেটেড হতে পারে। এখানকার মেয়েরা শীতকালে হাত গরম রাখবার জন্যে একরকম গোলাকার লোমশ পদার্থের মধ্যে হাত গুঁজে রাখ, তাকে মাফ্‌ বলে। প্রথম বিলেতে এসে সেই অপূর্ব পদার্থ যখন দেখি, তখন ডাক্তার ম—কে সে-দ্রব্যটা কী জিজ্ঞাসা করি। আমার অজ্ঞতায় তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। এখানকার অনেক লোকের রোগ দেখেছি, তাঁরা আশা করেন, আমরা তাঁদের সমাজের প্রত্যেক ছোটোখাটো বিষয় জানব। এক দিন একটা নাচে গিয়েছিলুম, এক জন মেয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলুম, “বধূটিকে (birde) তোমার কী রকম লাগছে? আমি জিজ্ঞাসা করলমু, “বধূটি কে?” অতগুলি মেয়ের মধ্যে এক জন নববধূ কোথায় আছেন তা আমি জানতুম না। শুনে তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন, তিনি বললেন, “তার মাথায় কমলালেবুর ফুল দেখে চিনতে পার নি?” দুই মিস ক—র সঙ্গে আলাপ হল। তাঁরা এখানকার পাদরির মেয়ে। পাড়ার পরিবারদের দেখাশুনো, রবিবাসরিক স্কুলে বন্দোবস্ত করা, শ্রমিকদের জন্যে টেম্পারেন্স সভা স্থাপন ও তাদের আমোদ দেবার জন্যে সেখানে গিয়ে গানবাজনা করা—এই সকল কাজে তাঁরা দিনরাত্রি ব্যস্ত আছেন। বিদেশী বলে আমাদের তাঁরা অত্যন্ত যত্ন করতেন। নগরে কোথাও আমোদ-উৎসব হলে আমাদের খবর দিতেন, আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, অবসর পেলে সকালে কিংবা সন্ধ্যেবেলায় এসে আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন, ছেলেদের নিয়ে গিয়ে মাঝে মাঝে গান শেখাতেন, এক-এক দিন তাঁদের সঙ্গে রাস্তায় বেড়াতে যেতুম। এইরকম আমাদের যথেষ্ট যত্ন ও আদর করতেন। বড়ো মিস ক—অত্যন্ত ভালোমানুষ ও গম্ভীর। একটা কথার উত্তর দিতে কেমন থতমত খেতেন। “হাঁ—না—তা হবে—জানি নে” এইরকম তাঁর উত্তর। এক-এক সময় কী বলবেন ভেবে পেতেন না, এক-এক সময় একটা কথা বলতে বলতে মাঝখানে থেমে পড়তেন, আর কথা জোগাত না, কোনো বিষয়ে মত জিজ্ঞাসা করলে বিব্রত হয়ে পড়তেন, আর কথা জোগাত না, কোনো বিষয়ে মত জিজ্ঞাসা করলে বিব্রত হয়ে পড়তেন। যদি জিজ্ঞাসা করা যেত, “আজ কি বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে” তিনি বলতেন, “কী করে বলব।” তিনি বুঝতেন না যে অভ্রান্ত বেদবাক্য শুনতে চাচ্ছি নে। তিনি আন্দাজ করতে নিতান্ত নারাজ। ছোটো মিস ক—র মতো প্রশান্ত প্রফুল্ল ভাব আর কারো দেখি নি। দেখে মনে হয় কোনো কালে তাঁর মনের কোনোখানে আঁচড় পড়ে নি। খুব ভালোমানুষ, সর্বদাই হাসিখুশি গল্প। কাপড়চোপড়ের আড়ম্বর নেই—কোনোপ্রকার ভান নেই; অত্যন্ত সাদাসিদে। ডাক্তার ম—র বাড়িতে একদিন আমাদের সান্ধ্যনিমন্ত্রণ হল। খাওয়াই এখানকার নেমন্তন্নের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় গানবাজনা আমোদ-প্রমোদের জন্যই দশজনকে ডাকা। আমরা সন্ধ্যের সময় গিয়ে হাজির হলুম। একটি ছোটো ঘরে অনেকগুলি মহিলা ও পুরুষের সমাগম হয়েছে। ঘরে প্রবেশ করে কর্তা গিন্নিকে আমাদের সম্মান জানালুম। সমাগত লোকদের সঙ্গে যথাযোগ্য অভিবাদন সম্ভাষণ ও আলাপ হল। ঘরে জায়গার এত টানাটানি ও লোক এত বেশি যে চৌকির অত্যন্ত অভাব হয়েছিল; অধিকাংশ পুরুষে মিলে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছিলুম। নতুন কোনো অভ্যাগত মহিলা এলে গিন্নি কিংবা কর্তা তাঁর সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন, আলাপ হবামাত্র তাঁর পাশে গিয়ে এক বার বসছি কিংবা দাঁড়াচ্ছি ও দুই-একটা করে কথাবার্তা আরম্ভ করছি। প্রায় আবহাওয়া নিয়ে কথার আরম্ভ; মহিলাটি বলেন “ড্রেডফুল ওয়েদার।” তাঁর সঙ্গে আমার নিসংশয়ে মতের ঐক্য হল। তার পরে তিনি অনুমান করলেন যে আমাদের পক্ষে অর্থাৎ ভারতীয়দের পক্ষে এমন ওয়েদার বিশেষ ট্রায়িং ও আশা করলেন আকাশ শীঘ্র পরিষ্কার হয়ে যাবে ইত্যাদি। তার পরে এই সূত্রে নানা কথা। সভার মধ্যে দুই জন সুন্দরী উপস্থিত ছিলেন। বলা বাহুল্য যে তাঁরা জানতেন তাঁরা সুন্দরী। এখানে সৌন্দর্যের পুজো হয়; এখানে রূপ কোনোমতে আত্মবিস্মৃত থাকতে পারে না, রূপাভিমান সুপ্ত থাকতে পার না; চারদিক থেকে প্রশংসার কোলাহল তাকে জাগিয়ে তোলে। নাচঘরে রূপসীর দর অত্যন্ত চড়া; নাতে তাঁর সাহচর্য-সুখ পাবার জন্যে দরখাস্তের পর দরখাস্ত আসছে; তাঁর তিলমাত্র কাজ করে দেবার জন্যে বহু লোক প্রস্তুত। রূপবান পুরুষদেরও যথোচিত আদর আছে। তারা এখানকার ড্রয়িং রুমের ডার্লিং। আমি দেখছি, এ-কথা শুনে তোমার এাখনে আসতে লোভ হবে। তোমার মতো সুপুরুষ এখানকার মতো রূপমুগ্ধ দেশে এলে চতুর্দিকে উঠবে— “......... ঘন নিশ্বাস প্রলয়বায়ু অশ্রুবারিধারা আসার, জীমূতমন্দ্র হাহাকার রব—” যা হোক নিমন্ত্রণ-সভায় Miss—দ্বয় রূপসীশ্রেষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁর দু জনেই কেবন চুপচাপ গম্ভীর। বড়ো যে মেশামেশি হাসিখুশি তা ছিল না। ছোটো মিস একটা কৌচে গিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন, আর বড়ো মিস দেওয়ালের কাছে এক চৌকি অধিকার করলেন। আমরা দুই এক জনে তাঁদের আমোদে রাখবার জন্যে নিযুক্ত হলুম। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি কথোপকথনশাস্ত্রে বিচক্ষণ নই, এখানে যাকে উজ্জ্বল বলে তা নই। গৃহকর্তা, একজন সংগীতশাস্ত্রজ্ঞতাভিমানিনী প্রৌঢ়া মহিলাকে বাজাতে অনুরোধের জন্যে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। গৃহের মহিলাদের মধ্যে তাঁর বয়স সব চেয়ে বেশি; তিনি সব-চেয়ে বেশি সাজগোজ করে এসেছিলেন, তাঁর দু হাতের দশ আঙুলে যতগুলো ধরে তত আংটি ছিল। আমি যদি নিমন্ত্রণকর্তা হতুম তা হলে তাঁর আংটির বাহুল্য দেখেই বুঝতে পারতুম যে তিনি পিয়ানো বাজাবেন বলে বাড়ি থেকে স্থিরসংকল্প হয়ে এসেছেন। তাঁর বাজনা সাঙ্গ হলে পর গৃহকর্ত্রী আমাকে গান গাবার জন্যে অত্যন্ত পীড়াপীড়ি আরম্ভ করলেন। আমি বড়ো মুশকিলে পড়লুম। আমি জানতুম, আমাদের দেশের গানের উপর যে তাঁদের বড়ে অনুরাগ আছে তা নয়। ভালোমানুষ হবার বিপদ এই যে নিজেকে হাস্যকরতা থেকে বাঁচানো যায় না। তাই মিস্টার টি—গান গাওয়ার ভূমিকা স্বরূপ দুই-একটি আরম্ভসূচক কাসি-ধ্বনি করলেন। সভা শান্ত হল। কোনোপ্রকারে কতর্ব্য পালন করলুম। সভাস্থ মহিলাদের এত হাসি পেয়েছিল যে, ভদ্রতার বাঁধ টলমল করছিল; কেউ কেউ হাসিকে কাসির রূপান্তরে পরিণত করলেন, কেউ কেউ হাত থেকে কী যেন পড়ে গেছে ভান করে ঘাড় নিচু করে হাসি লুকোতে চেষ্টা করলেন, এক জন কোনো উপায় না দেখে তার পার্শ্বস্থ সহচরীর পিঠের পিছনে মুখ লুকোলেন; যাঁরা কতকটা শান্ত থাকতে পেরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে চোখে চোখে টেলিগ্রাফ চলছিল। সেই সংগীতশাস্ত্রবিশারদ প্রৌঢ়াটির মুখে এমন একটু মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি লেগে ছিল যে, সে দেখে শরীরের রক্ত জল হয়ে আসে। গান যখন সাঙ্গ হল তখন আমার মুখ কান লাল হয়ে উঠেছে, চারদিক থেকে একটা প্রশংসার গুঞ্জনধ্বনি উঠল, কিন্তু অত হাসির পর আমি সেটাকে কানে তুললুম না। ছোটো মিস হ—আমাকে গানটা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে অনুরোধ করলেন, আমি অনুবাদ করলেম। গানটা হচ্ছে “প্রেমের কথা আর বলো না।” তিনি অনুবাদটা শুনে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের দেশে প্রেমের স্বাধীনতা আছে নাকি। কতকগুলি রোমের ভগ্নাবশেষের ফটোগ্রাফ ছিল। সেইগুলি নিয়ে গৃহকর্ত্রী কয়েক জন অভ্যাগতকে জড়ো করে দেখাতে লাগলেন। ডাক্তার ম—একটা টেলিফোন কিনে এনেছেন, সেইটে নিয়ে তিনি কতকগুলি লোকের কৌতূহল তৃপ্ত করছেন। পাশের ঘরে টেবিলে খাবার সাজানো। এক-এক বার গৃহকর্তা এসে এক-এক জন পুরুষের কানে কানে বলে যাচ্ছেন, মিস অথবা মিসেস অমূককে নিশিভোজনে নিয়ে যাও; তিনি গিয়ে সেই মহিলার কাছে তাঁকে খাবার ঘরে নিয়ে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করছেন ও তাঁর বাহুগ্রহণ করে তাঁকে পাশের ঘরে আহারস্থলে নিয়ে যাচ্ছেন। এ রকম সভায় সকলে মিলে এক বারে খেতে যায় না, তার কারণ তা হলে আমোদপ্রমোদের স্রোত অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। এই রকম এক সঙ্গে পুরুষ মহিলা সকলে মিলে গানবাজনা গল্প আমোদপ্রমোদ আহারাদিতে একটা সন্ধ্যা কাটানো গেল। এখানে মিলনের উপলক্ষ্য কতপ্রকার আছে, তার সংখ্যা নেই। ডিনার, বল, conversazione, চা-সভা, লন পার্টি, এক্সকার্শন, পিনিক ইত্যাদি। থ্যাকারে বলেন, “English society has this eminent advantage over all others- that is if there be any society has this left in the wretched distracted old European continent- that it is above all others a dinner-giving society.” অবসর পেলে এক সন্ধ্যে বন্ধুবান্ধবদের জড়ো করে আহারাদি করা ও আমোদপ্রমোদ করে কাটানো এখানকার পরিবারের অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে। ডিনার-সভার বর্ণনা করতে বসা বাহুল্য। ডাক্তার ম—র বাড়িতে যে পার্টির কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি, তার সঙ্গে ডিনার পার্টির প্রভেদ কেবল দক্ষিণ হস্তের ব্যাপারে (এ ম্লেচ্ছদের দেশে ভক্ষণটা আবার দক্ষিণ বাম উভয় হস্তের ব্যাপার)। আমি একবার এখানকার একটি বোট-যাত্রা ও পিকনিক পার্টিতে ছিলুম। এখানকার একটি রবিবারিক সভার সভ্যেরা এই বোট-যাত্রার উদ্‌যোগী। এই সভার সভ্য এবং সভ্যরা রবিবার পালনের বিরোধী। তাই তাঁরা রবিবার একত্র হয়ে নির্দোষ আমোদপ্রমোদ করেন। এই রবিবারিক সভার সভ্য আমাদের এক বাঙালি মিত্র ম—মহাশয় আমাদের অনুগ্রহ করে টিকিট দেন। লণ্ডন থেকে রেলোয়ে করে টেমসের ধারে এক গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছলুম। গিয়ে দেখলুম টেমসে একটা প্রকাণ্ড নৌকো বাঁধা, আর প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন রবিবার-বিদ্রোহী মেয়েপুরুষে একত্র হয়েছেন। দিনটা অন্ধকার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, আর যাঁদের আসবার কথা ছিল, তাঁরা সকলে আসেন নি। আমার নিজের এ পার্টিতে যোগ দিবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু ম—মহাশয় নাছোড়বান্দা। আমরা অনেক ভারতবর্ষীয় একত্র হয়েছিলুম, বোধ হয় ম—মহাশয় সকলকেই সুন্দরীর লোভ দেখিয়েছিলেন, কেন না সকলেই প্রায় বাহারে সাজগোজ করে গিয়েছিলেন। অনেকেই গলায় লাল ফাঁসি বেঁধেছিলেন। ম—মহাশয় স্বয়ং তাঁর নেকটাইয়ে একটি তলবারের আকারে পিন গুঁজে এসেছিলেন। আমাদের মধ্যে এক জন তাঁকে ঠাট্টা করে জিজ্ঞাসা করলেন “দেশের সমস্ত টাইয়ে যে তলবারের আঘাত করা হয়েছে, ওটা কি তার বাহ্য লক্ষণ?” তিনি হেসে বললেন, “তা নয় গো, বুকের কাছে একটা কটাক্ষের ছুরি বিঁধেছে, ওটা তারই চিহ্ন।” দেশে থাকতে বিঁধেছিল, কি এখানে, তা কিছু বললেন না। ম—মহাশয়ের হাসিতামাশার বিরাম নেই; সেদিন তিনি স্টীমারে সমস্ত লোকের সঙ্গে সমস্ত দিন ঠাট্টা ও গল্প করে কাটিয়েছিলেন। এক বার তিনি মহিলাদের হাত দেখে গুনতে আরম্ভ করলেন। তখন তিনি বোটসুদ্ধ মেয়েদের এত প্রচুর পরিমাণে হাসিয়েছিলেন যে, সত্যি কথা বলতে কি, তাঁর উপর আমার মনে মনে একুটখানি ঈর্ষার উদ্রেক হয়েছিল। যথাসময়ে বোট ছেড়ে দিল। নদী এত ছোটো যে, আমাদের দেশের খালের কাছাকাছি পৌঁছয়। স্টীমারের মধ্যে আমাদের আলাপ-পরিচয় গল্পসল্প চলতে লাগল। একজন ইংরেজের সঙ্গে আমাদের এক জন দিশি লোকের ধর্মসম্বন্ধীয় তর্ক উঠল। আমাদের সঙ্গে এক জনের আলাপ হল, তিনি তাঁদের ইংরেজি সাহিত্যের কথা তুললেন, তাঁর শেলির কবিতা অত্যন্ত ভালো লাগে; সে-বিষয়ে আমার সঙ্গে তাঁর মতের মিল হল দেখে তিনি ভারি খুশি হলেন; তিনি আমাকে বিশেষ করে তাঁর বাড়ি যেতে অনুরোধ করলেন। ইনি ইংরেজি সাহিত্য ও তাঁর নিজের দেশের রজনীতি ভালোরকম করে চর্চা করেছেন, কিন্তু যেই ভারতবর্ষের কথা উঠল, অমনি তাঁর অজ্ঞতা বেরিয়ে পড়ল। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন্‌ রাজার অধীনে।” আমি অবাক্‌ হয়ে বললুম, “ব্রিটিশ গবর্মেন্টের।” তিনি বললেন, “তা আমি জানি, কিন্তু আমি বলছি, কোন্‌ ভারতবর্ষীয় রাজার অব্যবহিত অধীনে।” কলকাতার বিষয়ে এর জ্ঞান এই রকম। তিনি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আমার অজ্ঞতা মাপ করবেন, ভারতবর্ষের বিষয়ে আমাদের ঢের জানা উচিত ছিল, কিন্তু লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করছি আমি এ-বিষয়ে আমাদের ঢের জানা উচিত ছিল, কিন্তু লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করছি আমি এ-বিষয়ে খুব কব জানি।” এইরকম বোটের ছাতের উপর আমাদের কথাবার্তা চলতে লাগল; আমাদের মাথার উপরে একটা কানাতের আচ্ছাদন। মাঝে মাঝে টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে, কানাতের আচ্ছাদনে সেটা কতকটা নিবারণ করছে। যেদিকে বৃষ্টির ছাঁট পৌঁছচ্ছে না, সেইদিকে মেয়েদের রেখে আর-এক পাশে এসে ছাতা খুলে দাঁড়ালুম। দেখি আমাদের দিশি বন্ধু ক—মশাশয় সেই মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। এই নিয়ে তাঁকে ঠাট্টা করাতে তিনি বার বার করে বললেন যে, বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়া ছাড়া তাঁর অন্য অভিসন্ধি ছিল না। কিন্তু কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। যা হক সেদিন আমরা বৃষ্টিতে তিন-চার বার করে ভিজেছি। এইরকম ভিজতে ভিজতে গম্যস্থানে গিয়ে পৌঁছলেম। তখন বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু আকাশে মেঘ আছে ও জমি ভিজে। মাঠে নেবে আমাদের খাওয়াদাওয়ার কথা ছিল, আকাশের ভাবগতিক দেখে তা আর হল না। আহারের পর আমরা নৌকো থেকে নেবে বেড়াতে বেরোলেম। কোনো কোনো প্রণয়ীযুগল একটি ছোটো পৌকো নিয়ে দাঁড় বেয়ে চললেন, কেউ বা হাতে হাতে ধরে নিরিবিলি কানে কানে কথা কইতে কইতে মাঠে বেড়াতে লাগলেন। আমাদের সঙ্গে একজন ফটোগ্রাফওআলা তার ফোটোগ্রাফের সরঞ্জাম সঙ্গে করে এনেছিল, আমরা সমস্ত দল মাঠে দাঁড়ালেম, আমাদের ছবি নেওয়া হল। সহসা ম—মহাশয়ের খেয়াল গেল যে আমরা যতগুলি কৃষ্ণমূর্তি আছি, একত্রে সকলের ছবি নেওয়া হবে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন, তাঁরা এ প্রস্তাবে ইতস্তত করতে লাগলেন, এরকম একটা ইন্‌ভিডিয়স ডিসটিংসন তাঁদের মনঃপূত নয়; কিন্তু ম—মহাশয় ছাড়বর পাত্রে নন। অবশেষে স্টীমার লণ্ডন অভিমুখে ছাড়া হল। তখন ভগবান মরীচিমালী তাঁহার সহস্র রশ্মি সংযমন পুরঃসর অস্তাচল-চূড়াবলম্বী জলধরপটল-শয়নে বিশ্রান্ত মস্তক বিন্যাসপূর্বক অরুণ-বর্ণ নিদ্রাতুর লোচন মুদ্রিত করলেন; বিহগকূল স্ব স্ব নীড়ে প্রত্যাবর্তন করিল, গাভীবৃন্দ হাম্বারব করিতে করিতে গোপালের অনুবর্তন করিয়া গোষ্ঠাভিমুখে গমন করিতে লাগিল। আমরা লণ্ডনের অভিমুখে যাত্রা করলেম। %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AA-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%B0_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0/%E0%A6%B8%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AE_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 য়ুরোপ-প্রবাসীর সপ্তম পত্র এখানকার ধনী ফ্যাশনেবল মেয়েদের কথা একটু বলে নিই। তাঁদের দোরস্ত করতে হলে দিন-দুই আমাদের দিশি শাশুড়ির ও বিধবা ননদের হাতে রাখতে হয়। তাঁরা হচ্ছেন বড়োমানুষের মেয়ে কিংবা বড়োমানুষের স্ত্রী। তাঁদের চাকর আছে, কাজকর্ম করতে হয় না, একজন হাউস-কীপার আছে, সে বাড়ির সমস্ত ঘরকন্না তদারক করে, একজন নার্স আছে, সে ছেলেদের মানুষ করে, একজন গভর্নেস আছেন, তিনি ছেলেপিলেদের পড়াশুনা দেখেন ও অন্যান্য নানাবিধ বিষয়ে তদারক করেন; তবে আর পরিশ্রম করার কী রইল বলো। কেবল একটা বাকি আছে, সেটা হচ্ছে সাজসজ্জা; কিন্তু তার জন্য তাঁর লেডিজ মেড আছে, সুতরাং সেটাও সমস্তটা নিজের হাতে করতে হয় না। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত দিনটা তাঁর হাতে আস্ত পড়ে থাকে। সকালবেলায় বিছানায় পড়ে, দরজা-জানলা বন্ধ করে সূর্যের আলো আসতে না দিয়ে দিনটাকে কতকটা সংক্ষেপ করেন, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ব্রেকফাস্ট খান ও এগারোটার আগে শয়নগৃহ থেকে বেরোলে যথেষ্ট ভোরে উঠেছেন মনে করেন। তার পরে সাজসজ্জা; সে-বিষয়ে তোমাকে কোনো প্রকার খবর দিতে পারছি নে। শোনা যায় খুব সম্প্রতি বিলেতে স্নানটা ফ্যাশন হয়েছে কিন্তু এখনো এটা খুব কম দূর ব্যাপ্ত। সীমন্তিনীরা হাতের যতটুকু বেরিয়ে থাকে—মুখটি ও গলাটি—দিনের মধ্যে অনেকবার অতি যত্নে ধুয়ে থাকেন; বাকি অঙ্গ পরিষ্কার করবার তাঁরা তত আবশ্যক দেখেন না; কেননা মনোহরণের প্রধান সিঁধ মুখটিতে কোনোপ্রকার মরচে না পড়লেই হল। মাসে দু-বার একটা স্পঞ্জ-বাথ নিলেই তাঁরা যথেষ্ট মনে করেন। আমি কোনো ইংরেজ পরিবারের মধ্যে বাস করতে গিয়েছিলেম, আমি স্নান করি শুনে তাঁরা বিপন্ন হয়েছিলেন। কোনো প্রকার সনানের সরঞ্জাম ছিল না, সেজন্যে অগভীর একটা গোল জলাধার ধার করে আনতে হয়েছিল। বাড়িতে লোক দেখা করতে এলে তাদের সঙ্গে আলাপচারি করা গৃহিণীর কাজ, অনেক লোক একসঙ্গে এলে তাঁর কর্তব্য হচ্ছে তাঁর বাক্য ও হাসির অমৃত সকলকে সমানভাবে বিতরণ করা, বিশেষ কারো সঙ্গে বেশি কথা কওয়া বা বিশেষ কাউকে বেশি যত্ন করাটা উচিত নয়। এ কাজটা অত্যন্ত দুরূহ, বোধ হয় অনেক অভ্যেসে দুরস্ত হয়। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি তাঁরা একজনের মুখের দিকে চেয়ে একটা কথা কন, তার পরে শেষ করেই সকলের দিকে চেয়ে একবার হাসেন, কখনো বা তাঁরা একজনের মুখের দিকে চেয়ে একটা কথা আরম্ভ করেন, তার পর বলতে বলতে এক এক বার করে সকলের মুখের দিকে চেয়ে একবার হাসেন, কখনো বা তাঁরা একজনের মুখের দিকে চেয়ে একটা কথা আরম্ভ করেন, তার পর বলতে বলতে এক এক বার করে সকলের মুখের দিকে চেয়ে নেন, কখনো বা, তাস খেলবার সময় যে-রকম করে চটপট তাস বিতরণ করে, তেমনি তাঁরা আগন্তুকদের একে একে করে একটি একটি কথার টুকরো ছড়িয়ে ছড়িয়ে দেন, এমন তাড়াতাড়ি ও এমন দক্ষতার সঙ্গে যে, তাঁদের হাতে যে অনেক কথার তাস গোছানো রয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। এক জনকে বললেন, “ Lovely morning, isn't it?” তার পরেই তাড়াতাড়ি আর-এক জনের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “কাল রাত্তিরে সংগীতশালায় মাডাম নীল্‌সন গান করেছিলেন, it was exquisite!” যতগুলি মহিলা ভিজিটর বসেছিলেন সকলে ঐ কথায় এক-একটা বিশেষণ যোগ করতে লাগলেন; এক জন বললেন “ charming,” এক জন বললেন “superb,” এক জন বললেন “ something unearthly,” আর-এক জন বাকি ছিলেন, তিনি বললেন “ Isn't it?” আমার বোধ হয়, এ এক-রকম সকালবেলা উঠে কথোপথনের মুগুর ভাঁজা। যা হক এই রকম মাঝে মাঝে ভিজিটর আনাগোনো করছে। মুডীজ লাইব্রেরীতে তিনি চাঁদা দিয়ে থাকেন। সেখান থেকে অনবরত ক্ষণজীবী নভেলগুলো তাঁর ওখানে যাতায়াত করে। সেগুলো অনবরত গলাধঃকরণ করেন। তা ছাড়া আছে ভালোবাসার অভিনয়। মিষ্টি হাসি ও মিষ্টি কথার আদান-প্রদান, অলীক ছুতো নিয়ে একটু অলীক অভিমান, হয়তো পুরুষ-পক্ষ থেকে একটু রসিকতা, অপর পক্ষে উদ্যত ক্ষুদ্র মুষ্টি সহযোগে সুমধুর লাঞ্ছনা, “ Oh you naughty, wicked, provoking man!” তাতে নটি ম্যান-এর পরিপূর্ণ তৃপ্তি। এই রকম ভিজিটর অভ্যর্থনা, ভিজিট প্রত্যর্পণ, নতুন নভেল পড়া, নতুন ফ্যাশন সৃষ্টি ও নতুন ফ্যাশনের অনুবর্তন করা, এবং তার সঙ্গে মধুর রস যোগ করে ফ্লার্ট এবং হয়তো ‘লাভ’ করা তাঁদের দিনকৃত্য। আমাদের দেশে যেমন ছেলেবেলা থেকে মেয়েদের বিয়ের জন্যে প্রস্তুত করে, যথেষ্ট লেখাপড়া শেখায় না, কেননা মেয়েদের আপিসে যেতে হবে না; এখানেও তেমনি মাগ্‌গি দরে বিকোবার জন্যে মেয়েদের ছেলেবেলা থেকে পালিশ করতে থাকে, বিয়ের জন্যে যতটকু লেখাপড়া শেখা দরকার ততটুকু যথেষ্ট। একটু গান গাওয়া, একটু পিয়ানো বাজানো, ভালো করে নাচা, খানিকটা ফরাসি ভাষা বিকৃত উচ্চারণ, একটু বোনা ও সেলাই করা জানলে একটি মেয়েকে বিয়ের দোকানের জানলায় সাজিয়ে রাখবার উপযুক্ত রংচঙে পুতুল গড়ে তোলা যায়। এ-বিষয়ে একটা দিশি পুতুল ও একটা বিলিতি পুতুলের যতটুকু তফাত, আমাদের দেশের ও এদেশের মেয়েদের মধ্যে ততটুকু তফাত, আমাদের দেশের ও এদেশের মেয়েদের মধ্যে ততটুকু তফাত মাত্র। আমাদের দিশি মেয়েদের পিয়ানো ও অন্যান্য টুকিটাকি শেখবার দরকার করে না, বিলিতি মেয়েদেরও অল্পস্বল্প লেখাপড়া শিখতে হয় কিন্তু দুই-ই দোকানে বিক্রি হবার জন্যে তৈরি। এখানেও পুরুষেরাই হর্তাকর্তা, স্ত্রীরা তাদের অনুগতা; স্ত্রীকে আদেশ করা, স্ত্রীর মনে লাগাম লাগিয়ে নিজের ইচ্ছামতো চালিয়ে বেড়ানো স্বামীরা ঈশ্বরনির্দিষ্ট অধিকার করেন। ফ্যাশনী মেয়ে ছাড়া বিলেতে আরো অনেক রকম মেয়ে আছে, নইলে সংসার চলত না। মধ্যবিত্ত গৃহস্থ মেয়েদের অনেকটা মেহনত করতে হয়, বাবুয়ানা করলে চলে না। সকালে উঠে একবার রান্নাঘর তদারক করতে হয়, সে-ঘর পরিষ্কার আছে কি না, জিনিসপত্র যথাপরিমিত আনা হয়েছে কি না, যথাস্থানে রাখা হয়েছে কি না ইত্যাদি দেখাশুনো করা; রান্না ও খাবার জিনিস আনতে হুকুম দেওয়া, পয়সা বাঁচাবার জন্যে নানাপ্রকার গিন্নিপনার চাতুরী খেলা, কালকের মাংসের হাড়গোড় কিছু যদি অবশিষ্ট থাকে তা হলে বন্দোবস্ত করে তার থেকে অজকের সূপ চালিয়ে নেওয়া, পরশু দিনকার বাসি রাঁধা মাংস যদি খাওয়া-দাওয়ার পর খানিকটা বাকি থাকে তা হলে সেটাকে রূপান্তরিত করে আজকের টেবিলে আনবার সুবিধে করে দেওয়া, এইরকম নানাপ্রকার গৃহিণীপনা। তার পর ছেলেদের জন্য মোজা কাপড়-চোপড়, এমন কি নিজেরও অনেক কাপড় নিজে তৈরি করেন। এঁদের সকলের ভাগ্যে নভেল পড়া ঘটে ওঠে না; বড়োজোর খবরের কাগজ পড়েন, তাও সকলে পড়েন না দেখেছি; অনেকের পড়াশুনোর মধ্যে কেবল চিঠি পড়া ও চিঠি লেখা, দোকানদারদের বিল পড়া ও হিসাব লেখা। তাঁরা বলেন, “পলিটিক্‌স এবং অন্যান্য গ্রাম্ভারি বিষয় নিয়ে পুরুষেরা নাড়াচাড়া করুন; আমাদের কর্তব্য কাজ স্বতন্ত্র।” দুর্বলতা মেয়েদের একটা গর্বের বিষয়; সুতরাং অনেক মেয়ে শ্রান্ত না হলেও এলিয়ে পড়েন। বুদ্ধিবিদ্যার বিষয়েও এইরকম; মেয়েরা জাঁক করে বলেন, “আমরা বাপু ও-সব বুঝিসুঝি নে।” বিদ্যার অভাব, বুদ্ধির খর্বতা একটা প্রকাশ্য জাঁকের বিষয় হয়ে ওঠে। এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেয়েরা বিদ্যাচর্চার দিকে ততটা মনোযোগ দেন না, তাঁদের স্বামীরাও তার জন্যে বড়ো দুঃখিত নন, তাঁদের জীবন হচ্ছে কতকগুলি ছোটোখাটো কাজের সমষ্টি। সন্ধ্যেবেলায় স্বামী কর্মক্ষেত্র থেকে এলে একটি আদরের চুম্বন উপার্জন করেন; ( পরিবার-বিশেষে যে তার অন্যথা হয় তা বলাই বাহুল্য) ঘরে তাঁর জন্যে আগুন জ্বালানো, খাবার সাজানো আছে। সন্ধ্যেবেলায় স্ত্রী হয়তো একটা সেলাই নিয়ে বসলেন, স্বামী তাঁকে একটি নভেল চেঁচিয়ে পড়ে শোনাতে লাগলেন, সুমুখে আগুন জ্বলছে, ঘরটি বেশ গরম, বাইরে পড়ছে বৃষ্টি, জানলা-দরজাগুলি বন্ধ। হয়তো স্ত্রী পিয়ানো বাজিয়ে স্বামীকে খানিকটা গান শোনালেন। এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গিন্নিরা সাদাসিদে। যদিও তাঁরা ভালো করে লেখাপড়া শেখেন নি, তবু তাঁরা অনেক বিষয় জানেন, এবং তাঁদের বুদ্ধি যথেষ্ট পরিষ্কার। এদেশে কথায় বাতায় জ্ঞানলাভ করা যায়, তাঁরা অন্তঃপুরে বদ্ধ নন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলাপ শেখেন নি, তবু তাঁরা অনেক বিষয় জানেন, এবং তাঁদের বুদ্ধি যথেষ্ট পরিষ্কার। এদেশে কথায় বার্তায় জ্ঞানলাভ করা যায়, তাঁরা অন্তঃপুরে বদ্ধ নন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলাপ করেন, আত্মীয়-সভায় একটা কোনো উচ্চ বিষয় নিয়ে চর্চা হলে তাঁরা শোনেন ও নিজের বক্তব্য বলতে পারেন, বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা একটা বিষয়ের কত দিক দেখেন ও কী রকম চক্ষে দেখেন তা বুঝতে পারেন। সুতরাং একটা কথা উঠলে কতকগুলো ছেলেমানুষি আকাশ-থেকে-পড়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন না ও তাঁকে হাঁ করে থাকতে হয় না। বন্ধুবান্ধদের সঙ্গে খুব সহজভাবে গল্পসল্প করতে পারেন, নিমন্ত্রণসভায় মুখ ভার করে বা লজ্জায় অবসন্ন হয়ে থাকেন না, পরিচিতদের সঙ্গে অন্যায় ঘেঁষাঘেঁষি নেই, কিংবা তাদের কাছ থেকে নিতান্ত অসামাজিক ভাবে দূরেও থাকেন না। লোকসমাজে মুখটি খুব হাসিখুশি, প্রসন্ন; যদিও নিজে খুব রসিকা নন, কিন্তু হাসিতামাশা বেশ উপভোগ করতে পারেন, একাট কিছু ভালো লাগলে মন খুলে প্রশংসা করেন, একটা কিছু মজার কথা শুনলে প্রাণ খুলে হাস্য করেন। আমি দিনকতক আমার শিক্ষকের পরিবারের মধ্যে বাস করেছিলুম, সে বড়ো অদ্ভুত পরিবার। মিষ্টার ব-মেধ্যবিত্ত লোক। তিনি লাটিন ও গ্রীক খুব ভালো রকম জানেন। তাঁর ছেলেপিলে কেউ নেই; তিনি, তাঁর স্ত্রী, আমি, আর এক জন দাসী, এই চার জন মাত্র একটি বাড়িতে থাকতুম। কর্তা আধবুড়ো লোক, অত্যন্ত অন্ধকার মূর্তি, দিনরাত খুঁতখুঁত খিট খিট করেন, নিচের তলায় রান্নাঘরের পাশে একটি ছোট্টো জানলাওয়ালা দরজা-বদ্ধ অন্ধকার ঘরে থাকেন। একে তো সূর্যকিরণ সে ঘরে সহজেই প্রবেশ করতে পারে না, তাতে জানলার উপরে একটা পর্দা ফেলা, চারদিকে পুরোনো ছেঁড়া ধুলোমাখা নানাপ্রকার আকারের ভীষণদর্শন গ্রীক লাটিন বইয়ে দেয়াল ঢাকা, ঘরে প্রবেশ করলে এক রকম বদ্ধ হাওয়ায় হাঁপিয়ে উঠতে হয়। এই ঘরটা হচ্ছে তাঁর স্টাডি, এইখানে তিনি পড়েন ও পড়ান। তাঁর মুখ সর্বদাই বিরক্ত। আঁট বুটজুতো পরতে বিলম্ব হচ্ছে, বুটজুতোর উপর চটে ওঠেন; যেতে যেতে দেয়ালের পেরেকে তাঁর পকেট আটকে যায়, রেগে ভুরু কুঁকড়ে ঠোঁট নাড়তে থাকেন। তিনি যেমন খুঁতখুঁতে মানুষ, তাঁর পক্ষে তেমনি খুঁতখুঁতের কারণ প্রতি পদে জোটে। আসতে যেতে হুঁচট খান, অনেক টানাটানিতে তাঁর দেরাজ খোলে না, যদি বা খোলে তবু যে-জিনিস খুঁজছিলেন তা পান না। এক-এক দিন সকালে তাঁর স্টাডিতে এসে দেখি, তিনি অকারণে বসে বসে ভ্রূকুটি করে উঁ আঁ করছেন, ঘরে একটি লোক নেই। কিন্তু ব—আসলে ভালোমানুষ; তিনি খুঁতখুঁতে বটে, রাগী নন, খিটখিট করেন কিন্তু ঝগড়া করেন না। নিদেন তিনি মানুষের উপর রাগ প্রকাশ করেন না, টাইনি বলে তাঁর একটি কুকুর আছে তার উপরেই তাঁর আক্রোশ। সে একটু নড়লে চড়লে তাকে ধমকাতে থাকেন, আর দিনরাত তাকে লাথিয়ে লাথিয়ে একাকার করেন। তাঁকে আমি প্রায় হাসতে দেখি নি। তাঁর কাপড়চোপড় ছেঁড়া অপরিষ্কার। মানুষটা এই রকম। তিনি এক-কালে পাদরি ছিলেন; আমি নিশ্চয় বলতে পারি, প্রতি রবিবারে তাঁর বক্তৃতায় তিনি শ্রোতাদের নরকের বিভীষিকা দেখাতেন। তাঁর এত কাজের ভিড়, এত লোককে পড়াতে হত যে, এক-এক দিন তিনি ডিনার খেতে অবকাশ পেতেন না। এক-এক দিন তিনি বিছানা থেকে উঠে অবধি রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এমন অবস্থায় খিটখিটে হয়ে ওঠা কিছু আশ্চর্য নয়। গৃহিণী খুব ভালোমানুষ, রাগী উদ্ধত নন, এককালে বোধ হয় ভালো দেখতে ছিলেন, যত বয়স তার চেয়ে তাঁকে বড়ো দেখায়, চোখে চশমা, সাজগোজের বড়ো আড়ম্বর নেই। নিজে রাঁধেন, বাড়ির কাজকর্ম করেন, ছেলেপিলে নেই, সুতরাং কাজকর্ম বড়ো বেশি নয়। আমাকে খুব যত্ন করতেন। খুব অল্প দিনেতেই বোঝা যায় যে, দম্পতির মধ্যে বড়ো ভালোবাসা নেই, কিন্তু তাই বলে যে দু-জনের মধ্যে খুব বিরোধ ঘটে তাও নয়, অনেকটা নিঃশব্দে সংসার চলে যাচ্ছে। মিসেস ব—কখনো স্বামীর স্টাডিতে যান না; সমস্ত দিনের মধ্যে খাবার সময় ছাড়া দু-জনের দেখাশুনা হয় না, খাবার সময়ে দু-জনে চুপচাপ বসে থাকেন। খেতে খেতে আমার সঙ্গে গল্প করেন, কিন্তু দু-জনে পরস্পর গল্প করেন না। ব—র আলুর দরকার হয়েছে, তিনি চাপা গলায় মিসেসকে বললেন, “ some potatoes “ please কথাটা বললেন না কিংবা শোনা গেল না)। মিসেস ব—বলে উঠলেন “ I wish you were a little more polite “ ব—বললেন “ I did say 'please “; মিসেস ব—বললেন “ I did not here it “; ব—বললেন “ it was no fault of mine”। এইখানেই দুই পক্ষ চুপ করে রইলেন। মাঝে থেকে আমি অত্যন্ত অপ্রস্তুতে পড়ে যেতেম। একদিন আমি ডিনারে যেতে একটু দেরি করেছিলেম, গিয়ে দেখি, মিসেস ব—ব—কে ধমকাচ্ছেন, অপরাধের মধ্যে তিনি মাংসের সঙ্গে একটু বেশি আলু নিয়েছিলেন। আমাকে দেখে মিসেস ক্ষান্ত হলেন, মিস্টার সাহস পেয়ে শোধ তোলবার জন্যে দ্বিগুণ করে আলু নিতে লাগলেন, মিসেস তাঁর দিকে নিরুপায় মর্মভেদী কটাক্ষপাত করলেন। দুই পক্ষই দুই পক্ষকে যথারীতি ডিয়ার ডার্লিং বলে ভুলেও সম্বোধন করেন না, কিংবা কারো ক্রিশ্চান নাম ধরে ডাকেন না, পরস্পর পরস্পরকে মিস্টর ব—ও মিসেস ব—বলে ডাকেন। আমার সঙ্গে মিসেস হয়তো বেশ কথাবার্তা কচ্ছেন, এমন সময় মিস্টার এলেন, অমনি সমস্ত চুপচাপ। দুই পক্ষেই এই রকম। একদিন মিসেস আমাকে পিয়ানো শোনাচ্ছেন, এমন সময় মিস্টার এসে উপস্থিত; বললেন “ When are you going to stop?” মিসেস বললেন “ I thought you had gone out”। পিয়ানো থামল। তার পরে আমি যখন পিয়ানো শুনতে চাইতেম মিসেস বলতেন, “that horrid man যখন বাড়িতে না থাকবেন তখন শোনাব”, আমি ভারি অপ্রস্তুতে পড়ে যেতুম। দু-জনে এই রকম অমিল অথচ সংসার বেশ চলে যাচ্ছে। মিসেস রাঁধছেন বাড়ছেন কাজকর্ম করছেন, মিস্টার রোজগার করে টাকা এনে দিচ্ছেন; দু-জনে কখনো প্রকৃত ঝগড়া হয় না, কেবল কখনো কখনো দুই-এক বার দুই একটা কথা-কাটাকাটি হয়, তা এত মৃদুস্বরে যে পাশের ঘরের লোকের কানে পর্যন্ত পৌঁছয় না। যা হক আমি সেখানে দিনকতক থেকে বিব্রত হয়ে সে অশান্তির মধ্যে থেকে চলে এসে বেঁচেছি। %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AA-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%B0_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0/%E0%A6%A6%E0%A6%B6%E0%A6%AE_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 য়ুরোপ-প্রবাসীর দশম পত্র ক্রিস্‌মাস ফুরোল, আবার দেখতে দেখতে আর-একটা উৎসব এসে পড়ল। আজ নূতন বর্ষের প্রথম দিন। কিন্তু তার জন্যে কিছুই গোলমাল দেখতে পাচ্ছি নে। নূতন বৎসর যে এখানে এমন নিঃশব্দ পদসঞ্চারে আসবে তা জানতেম না। শুনেছি ফ্রান্সে লোকে নতুন বৎসরকে খুব সমাদরের সঙ্গে আবাহন করে। কাল পুরাতন বৎসরের শেষ রাত্রে আমাদের প্রতিবেশীরা বাড়ির জানলা খুলে রেখেছিল। পাছে পুরোনো বৎসর ঘরের মধ্যে আটকা পড়ে থাকে, পাছে নতুন বৎসর এসে জানলার কাছে বৃথা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। টর্কি থেকে বহুদিন হল আমরা আবার লণ্ডনে এসেছি। এখন আমি ক—র পরিবারের মধ্যে বাস করি। তিনি, তাঁর স্ত্রী, তাঁদের চার মেয়ে, দুই ছেলে, তিন দাসী, আমি ও টেবি বলে এক কুকুর নিয়ে এই বাড়ির জনসংখ্যা। মিস্টার ক—একজন ডাক্তার। তাঁর মাথার চুল ও দাড়ি প্রায় সমস্ত পাকা। বেশ বলিষ্ঠ ও সুশ্রী দেখতে। অমায়িক স্বভাব, অমায়িক মুখশ্রী। মিসেস ক—আমাকে আন্তরিক যত্ন করেন। শীতের সময় আমি বিশেষ গরম কাপড় না পারলে তাঁর কাছে ভর্ৎসনা খাই। খাবার সময় যদি তাঁর মনে হয়, আমি কম করে খেয়েছি, তা হলে যতক্ষণ না তাঁর মনের মতো খাই, ততক্ষণ পীড়াপীড়ি করেন। বিলেতে লোকে কাশিকে ভয় করে; যদি দৈবাৎ আমি দিনের মধ্যে দু-বার কেশেছি তা হলেই তিনি জোর করে আমার স্নান বন্ধ করান, আমাকে দশ রকম ওষুধ গেলান, শুতে যাবার আগে আমার পায়ে খানিকটা গরম জল ঢালবার বন্দোবস্ত করেন, তবে ছাড়েন। বাড়ির মধ্যে সকলের আগে বড়ো মিস ক—ওঠেন। তিনি নিচে এসে ব্রেকফাস্ট তৈরি হয়েছে কি না তদারক করেন; অগ্নি-কুণ্ডে দু-চার হাতা কয়লা দিয়ে ঘরটি বেশ উজ্জ্বল করে রাখেন। খানিক বাদ সিঁড়িতে একটা দুদ্দাড় পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। বুড়ো ক—শীতে হি হি করতে করতে খাবার ঘরে এসে উপস্থিত। তাড়াতাড়ি আগুনে হাত-পা পিঠ-বুক তাতিয়ে খবরের কাগজ হাতে খাবার টেবিলে এসে বসেন। তাঁর বড়ো মেয়েকে চুম্বন করেন, আমার সঙ্গে সুপ্রভাত অভিবাদন হয়। লোকটা প্রফুল্ল। আমার সঙ্গে খানিকটা হাসিতামাশা হয়, খবরের কাগজ থেকে এটা-ওটা পড়ে শোনান। তাঁর এক পেয়ালা কফি শেষ হয়ে গেছে, এমন সময়ে তাঁর আর দুটি মেয়ে এসে তাঁকে চুম্বন করলেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁর বন্দোবস্ত ছিল যে, তাঁরা যেদিন মিস্টার ক—র আগে উঠবেন, সেদিন মিস্টার ক—তাঁদের পাঁচ সিকে পুরস্কার দিবেন, আর যেদিন মিস্টার ক—তাঁদের আগে উঠবেন, সেদিন তাঁদের চার আনা দণ্ড দিতে হবে। যদিও এত অল্প দিতে হয়, তবু তাদের কাছে প্রায় দু-তিন পাউণ্ড পাওনা হয়েছে। রোজ সকালে পাওনাদার পাওনার দাবি করেন। কিন্তু দেনদাররা হেসেই উড়িয়ে দেন। ক—বলেন, “এ ভারি অন্যায়।” আমাকে মাঝে মাঝে মধ্যস্থ মেনে বলেন, “আচ্ছা মিস্টার টি—তুমিই বলো, এ-রকম ডেট অফ অনর ফাঁকি দেওয়া কি ভদ্রতা?” যা হোক পরিশোধের অভাবে পাওনা বেড়েই চলেছে। তার পরে মিসেস ক—এলেন। আমাদের ব্রেকফাস্ট প্রায় সাড়ে ন-টার মধ্যে শেষ হয়। বাড়ির বড়ো ছেলে আগেই খাওয়া সেরে কাজে গিয়েছেন, আর মিস্টার ক—র ছোটো ছেলেটি ও ছোটো মেয়েটি অনেকক্ষণ হল খাওয়া শেষ করেছে। একজনের কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। টেবি কুকুরটি অনেকক্ষণ হল এসে আগুনের কাছে বসে আছে। ছোট্টো কুকুরটি। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া রোঁয়া। রোঁয়াতে চোখমুখ ঢাকা। বুড়ো হয়েছে, আর তার একটা চোখ কানা হয়ে গেছে। আদর পেয়ে পেয়ে এই ব্যক্তির অভ্যাস হয়েছে নবাবি চাল। ড্রয়িংরূম ছাড়া অন্য কোনো ঘরে তার মন বসে না। ঘরের সকলের চেয়ে আলো কেদারাটিতে অম্লানবদনে লাফিয়ে উঠে বসে, এক পাশে যদি আর কেউ এসে বসল, অমনি সে সদর্পে পাশের কৌচটির উপরে গিয়ে বসে পড়ে। সকালবেলায় ব্রেকফাস্টের সময় তার তিনটি বিস্কুট বরাদ্দ। সে বিস্কুটগুলি নিয়ে খাবার ঘরে বসে থাকে, যতক্ষণ না আমি গিয়ে সেই বিস্কুটগুলি নিয়ে তার সঙ্গে খানিকটা খেলা করি, একবার তার মুখ থেকে কেড়ে নিই একবার গড়িয়ে দিই। আগে আগে যখন আমার উঠতে দেরি হত, সে তার বরাদ্দ বিস্কুট নিয়ে আমার শোবার ঘরের কাছে বসে ঘেউ ঘেউ করত। কিন্তু গোল করলে বিরক্ত হতুম দেখে সে এখন আর ঘেউ ঘেউ করে না। আস্তে আস্তে পা দিয়ে দরজা ঠেলে, যতক্ষণ না দরজা খুলে দিই চুপ করে বাইরে বসে থাকে। দরজা খুলে ঘর থেকে বেরোলেই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে লেজ নেড়ে উৎসাহ প্রকাশ করে; তার পরে একবার বিস্কুটের দিকে চায় একবার আমার মুখের দিকে। যা হোক সাড়ে ন-টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট শেষ হয়। তার পরে হাতে দস্তানা পরা গৃহিণী দাসীদের নিয়ে তাঁর চৌতলা থেকে একতলা পর্যন্ত, জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরদ্বার পরিষ্কার ও গৃহকার্য তদারক করে ওঠা-নাবায় প্রবৃত্ত। একবার রান্নাঘরে যান, সেখানে শাকওআলা, রুটিওআলা, মাংসওআলার বিল দেখেন, দেনা চুকিয়ে দেন। মাঝে মাঝে উপরে এসে কর্তার সঙ্গে গৃহকার্যের পরামর্শ হয়। রান্নাঘরের উপকরণ পরিষ্কার আছে কি না ও যথাস্থানে তাদের রাখা হয়েছে কি না দেখেন, ভালো মাংস এনেছে কি না, ওজনে কম পড়েছে কি না তদন্ত করেন। রাঁধুনীর সঙ্গে মাঝে মাঝে যোগ দেন। এইরকম ব্রেকফাস্টের পর থেকে প্রায় বেলা একটা-দেড়টা পর্যন্ত তাঁকে নানাবিধ কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে তাঁর বড়ো মেয়ে যোগ দেন। মেজো মেয়ে প্রত্যহ একটি ঝাড়ন নিয়ে ড্রয়িংরুম সাফ করেন। দাসীরা ঘর ঝাঁট দিয়ে যায়, আর জিনিসপত্রে যা কিছু ধুলো লাগে তা তিনি নিজের হাতে ঝেড়ে-ঝুড়ে সাফ করেন। তৃতীয় মেয়ে বালিশের আচ্ছাদন আসন মোজা কাপড় প্রভৃতি নানাবিধ সেলাইয়ে নিযুক্ত হন, চিঠিপত্র লেখেন, এক-এক দিন বাজনা ও গান অভ্যাস করেন। বাড়ির মধ্যে তিনিই গাইয়ে বাজিয়ে। আজকাল স্কুল বন্ধ, ছোটো ছেলেটি ও মেয়েটি ভারি খেলায় মগ্ন। দেড়টার সময় আমাদের লাঞ্চ খাওয়া সমাপন হলে আবার যিনি যাঁর কাজে নিযুক্ত হন। এই সময়ে ঝিটিরদের আসবার সময়। হয়তো মিসেস ক—তাঁর স্বামীর এক জোড়া ছেঁড়া মোজা দিয়ে চশমা পরে ড্রয়িংরূমে বসে সেলাই করছেন। ছোটো মেয়ে একটি পশমের জামা তাঁর ভাইপোর জন্যে তৈরি করে দিচ্ছেন। মোজো মেয়েটি একটু অবসর পেয়ে আগুনের কাছে বসে হয়তো গ্রীনের লিখিত ইংরেজ জাতির ইতিহাস পড়তে নিযুক্ত। বড়ো মিস ক—হয়তো তাঁর কোনো আলাপীর বাড়িতে ভিজিট করতে গিয়েছেন। তিনটের সময় হয়তো একজন ভিজিটর এলেন। দাসী ড্রয়িংরূমে এসে নাম উচ্চারণ করলে “মিস্টার ও মিসেস এ—” বলতে বলতে ঘরের মধ্যে তাঁরা দু-জনে উপস্থিত। মোজা জামা রেখে বই মুড়ে গৃহিণী ও তাঁর কন্যারা আগন্তুকদের অভ্যর্থনা করলেন। আবহাওয়া সম্বন্ধে পরস্পরের মতামতের ঐক্য নিয়ে আলাপ শুরু হল। মিসেস এ—বললেন, “মিস্টার এক্‌স—এর তেতাল্লিশ বৎসর বয়সে হাম হয়। হাম হয়েছিল বলে তিন চারদিন আপিসে যেতে পারেন নি। কাল আপিসে গিয়েছিলেন। তাঁর হামের প্রসঙ্গে আপিসের লোকেরা তাঁকে নির্দয়রপে ঠাট্টা করতে আরম্ভ করেছে।” অন্যেরা লোকটি সম্বন্ধে দরদ প্রকাশ করলে। এই কথা থেকে ক্রমে হামরোগের বিষয়ে যত কথা উঠতে পারে উঠল। মিস ক—খবর দিলেন মিস্টার জ—এর যে এক পিতৃব্য বোন মিস ই—অস্ট্রেলিয়ায় আছেন, তাঁর কাপ্তেন ব—এর সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেছে। এই রকম খানিকক্ষণ কথোপকথন হলে পর তাঁরা চলে গেলেন। বিকেলে হয়তো আমরা সবাই মিলে একটু বেড়াতে গেলুম। বেড়িয়ে এসে সাড়ে ছ-টার সময় আমাদের ডিনার। ডিনার খেয়ে সাতটার সময় আমরা সবাই মিলে ড্রয়িংরূমে গিয়ে বসি। আগুন জ্বলছে। ঘরটি বেশ গরম হয়ে উঠেছে। আমরা আগুনের চারদিকে ঘিরে বসলুম। এক-এক দিন আমাদের গান-বাজনা হয়। আমি ইতিমধ্যে অনেক ইংরেজি গান শিখেছি। আমি গান করি। মিস ক—আমাকে অনেকগুলি গান শিখিয়েছেন। কিন্তু প্রায় সন্ধ্যেবেলায় আমাদের একটু আধটু পড়াশুনো হয়। আমরা পালা করে ছ-দিনে ছ-রকমের বই পড়ি। বই পড়তে পড়তে এক-এক দিন প্রায় সাড়ে এগারোটা বারোটা হয়ে যায়। ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেছে। তারা আমাকে আর্থার বুড়ো বলে। এথেল ছোটো মেয়েটির ইচ্ছে যে আমি কেবল একলা তারই আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থার হই। তার ভাই টম যদি আমাকে দাবি করে তবেই তার দুঃখ। একদিন টম তার ছোটো বোনকে রাগাবার জন্যে একটু বিশেষ জোর দিয়ে বলেছিল, আমারই আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থার। তখনই এথেল আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁট দুটি ফুলিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে। টম একটু অস্থির, কিন্তু ভারি ভালোমানুষ। খুব মোটাসোটা। মাথাটা খুব প্রকাণ্ড। মুখটা খুব ভারি ভারি। সে এক-এক সময়ে আমাকে এক-একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, “আচ্ছা, আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থার, ইঁদুররা কী করে?” আঙ্ক্‌ল্‌ বললেন, “তারা রান্নাঘর থেকে চুরি করে খায়।” সে একটু ভেবে বললে, “চুরি করে? আচ্ছা, চুরি করে কেন?” আঙ্ক্‌ল্‌ বললেন, “তাদের খিদে পায় বলে।” শুনে টমের বড়ো ভালো লাগল না। সে বারবার শুনে আসছে যে, জিজ্ঞাসা না করে পরের জিনিস নেওয়া অন্যায়। আর-একটি কথা না বলে সে চলে গেল। যদি তার বোন কখনো কাঁদে, সে তাড়াতাড়ি এসে সান্ত্বনার স্বরে বলে, “Oh poor Ethel, don’t you cry! Poor Ethel! “ এথেলের মনে মনে জ্ঞান আছে যে, সে একজন লেডি। সে কেমন গম্ভীরভাবে কেদারায় ঠেস দিয়ে বসে। টমকে এক-এক সময়ে ভর্ৎসনা করে বলে, “আমাকে বিরক্ত করো না।” একদিন টম পড়ে গিয়ে কাঁদছিল। আমি তাকে বললেন, “ছি, কাঁদতে আছে!” অমনি এথেল আমার কাছে ছুটে এসে জাঁক করে বললে, “আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থার, আমি একবার ছেলেবেলায় রান্নাঘরে পড়ে গিয়েছিলেম, কিন্তু কাঁদি নি।” ছেলেবেলায়! মিস্টার ন—, ডাক্তারের আর এক ছেলে, বাড়িতে থাকেন কিন্তু তাঁকে দেখতে পাই নে। তিনি সমস্ত দিন আপিসে। আপিস থেকে এলেও তাঁর বড়ো একটা দেখা পাওয়া যায় না। তার কারণ মিস্‌ ই—র সঙ্গে তাঁর বিয়ের সম্বন্ধ। তাঁদের দু-জনে কোর্টশিপ চলছে। রবিবার দু-বেলা প্রেয়সীকে নিয়ে তাঁর চার্চে যেতে হয়। যখন বিকেলে একটু অবসর পান, প্রণয়িনীর বাড়িতে গিয়ে এক পেয়ালা চা খেয়ে আসেন। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা তাঁদের বাড়িতে তাঁর নেমন্তন্ন। এই রকমে তাঁর সময় ভারি অল্প। উভয়ে পরস্পরকে নিয়ে এমন সুখী আছেন যে, অবসরকাল কাটাবার জন্যে অন্য কোনো জীবের সঙ্গ তাঁদের আবশ্যক করে না। শুক্রবার সন্ধ্যেবেলায় যদি আকাশ ভেঙে পড়ে তবু মিস্টার ন—পরিষ্কার করে চুলটি ফিরিয়ে, পমেটম মেখে, কোট ব্রাস করে ফিটফাট হয়ে ছাতা হাতে বাড়ি থেকে বেরোবেনই। একবার খুব শীত পড়েছিল, আর তাঁর ভারি কাশি হয়েছিল; মনে করলেম, আজ বুঝি বেচারির আর যাওয়া হয় না। সাতটা বাজতে না বাজতেই দেখি তিনি ফিটফাট হয়ে নেবে এসেছেন। যা হোক, আমার এই পরিবারের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সেদিন মেজো মেয়ে আমাকে বলছিলেন যে, প্রথম যখন তাঁরা শুনলেন যে, একজন ভারতবর্ষীয় ভদ্রলোক তাঁদের মধ্যে বাস করতে আসছে, তাঁদের ভারি ভয় হয়েছিল। যেদিন আমার আসবার কথা সেই দিন মেজো ও ছোটো মেয়ে, তাঁদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় এক হপ্তা বাড়িতে আসেন নি। তার পর হয়তো যখন তাঁরা শুনলেন যে, মুখে ও সর্বাঙ্গে উল্কি নেই, ঠোঁট বিঁধিয়ে অলংকার পরে নি, তখন তাঁরা বাড়িতে ফিরে এলেন। ওঁরা বলেন যে প্রথম প্রথম এসে যদিও আমার সঙ্গে কথাবার্তা কয়েছিলেন তবুও দু-দিন পর্যন্ত আমার মুখ দেখেন নি। হয়তো ভয় হয়েছিল যে কী অপূর্ব ছাঁচে ঢালাই মুখই না জানি দেখবেন। তার পর যখন মুখ দেখলেন—তখন? যা হোক, এই পরিবারে সুখে আছি। সন্ধ্যেবেলা আমোদে কেটে যায়—গান-বাজনা, বই পড়া। আর এথেল তার আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থারকে মুহূর্ত ছেড়ে থাকতে চায় না। %%%% https://bn.wikisource.org/wiki/%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%AA-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%B0_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0/%E0%A6%85%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%AE_%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0 %%%% cs671:"ashish@cse.iitk.ac.in" 150805 য়ুরোপ-প্রবাসীর অষ্টম পত্র আমারা এখন লণ্ডন ত্যাগ করে এসেছি। লণ্ডনের জনসমুদ্রে জোয়ারভাঁটা খেলে তা জান? বসন্তের আরম্ভ থেকে গরমির কিছুদিন পর্যন্ত লণ্ডনের জোয়ার-ঋতু। এই সময়ে লণ্ডন উৎসবে পূর্ণ থাকে—থিয়েটার নাচগান, প্রকাশ্য ও পারিবারিক ‘বল’, আমোদপ্রমোদে ঘেঁষাঘেঁষি ঠেসাঠেসি। ধনী লোকদের বিলাসিনী মেয়েরা রাতকে দিন করে তোলে। আজ তাদের নাচে নেমন্তন্ন, কাল ডিনারে, পরশু থিয়েটার,তরশু রাত্তিরে ম্যাডাম প্যাটির গান, দিনের চেয়ে রাত্তিরের ব্যস্ততা বেশি। সুকুমারী মহিলা, যাঁদের তিলমাত্র শ্রম লাঘবের জন্যে শত শত ভক্ত সেবকের দল দিনরাত্রি প্রাণপণ করছেন—চৌকিটা সরিয়ে দেওয়া, প্লেটটা এগিয়ে দেওয়া, দরজাটা খুলে দেওয়া, মাংসটা কেটে দেওয়া, পাখাটা কুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি—তাঁরা রাত্তিরের পর রাত্তির ন-টা থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত গ্যাসের ও মানুষের নিশ্বাসে গরম ঘরের মধ্যে অবিশ্রান্ত নৃত্যে রত; সে আবার আমাদের দশের অলস নড়েচড়ে বেড়ানো বাইনাচের মতো নয়, অনবরত ঘুরপাক। ললিতা রমণীরা কী করে টিকে থাকেন, আমি তাই ভাবি। এই তো গেল আমোদপ্রমোদ, তা ছাড়া এই সময়ে পার্লামেন্টের অধিবশেন। ব্যাণ্ডের একতান স্বর, নাচের পদশব্দ, ডিনার-টেবিলের হাস্যালাপধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র একটা পোলিটিকাল উত্তেজনা। স্থিতিশীল ও গতিশীল দলভুক্তরা প্রতি রাত্রের পার্লামেন্টের রাজনৈতিক মল্লযুদ্ধের বিবরণ কী আগ্রহের সঙ্গে আলোচনা করতে থাকে। সীজ্‌নের সময় লণ্ডনে এই রকম আলোড়ন। তার পরে আবার ভাঁটা পড়তে আরম্ভ হয়, লণ্ডনের কৃষ্ণপক্ষ আসে। তখন আমোদ-কোলাহল বন্ধ হয়ে যায়, বাকি থাকে অল্পস্বল্প লোক, যাদের শক্তি নেই, বা দরকার আছে বা বাইরে যাবার ইচ্ছে নেই। সেই সময়ে লণ্ডন থেকে চলে যাওয়া একটা ফ্যাশন। আমি একটা বইয়ে (“Sketches and Travels in London” : Thackeray) পড়েছিলুম, এই সময়টাতে অনেকে যারা নগরে থাকে তারা বাড়ির সম্মুখে দরজা জানলা সব বন্ধ করে বাড়ির পিছনদিকের ঘরে লুকিয়ে-চুরিয়ে বাস করে। দেখাতে চায় তারা লণ্ডন ছেড়ে চলে গেছে। সাউথ কেনসিংটন বাগানে যাও; ফিতে, টুপি, পালক, রেশম, পশম ও গাল-রং-করা মুখের সমষ্টি চোখ ঝলসে প্রজাপতির ঝাঁকের মতো বাগান আলো করে বেড়াচ্ছে না; বাগান তেমনি সবুজ আছে, সেখানে তেমনি ফুল ফুটেছে, কিন্তু তার সজীব শ্রী নেই। গাড়ি ঘোড়া লোকজনের হিজিবিজি ঘুচে গিয়ে লণ্ডনটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সম্প্রতি লণ্ডনের সীজ্‌ন অতীত, আমরাও লণ্ডন ছেড়ে টন্‌ব্রিজ ওয়েল্‌স বলে একাট আধা-পাড়াগেঁয়ে জায়গায় এসেছি। অনেক দিনের পর হালকা বাতাস খেয়ে বাঁচা গেল। হাজার হাজার চিমনি থেকে অবিশ্রান্ত পাথুরে কয়লার ধোঁয়া ও কয়লার গুঁড়ো উড়ে উড়ে লণ্ডনের হাড়ে হাড়ে প্রবেশ করেছে। রাস্তায় বেরিয়ে এসে হাত ধুলে সে হাত-ধোয়া জলে বোধ করি কালির কাজ করা যায়। নিশ্বাসের সঙ্গে অবিশ্রান্ত কয়লার গুঁড়ো টেনে মগজটা বোধ হয় অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ হয়ে দাঁড়ায়। টন্‌ব্রিজ ওয়েল্‌স অনেক দিন থেকে তার লৌহপদার্থমিশ্রিত উৎসের জন্যে বিখ্যাত। এই উৎসের জল খাবার জন্যে এখানে অনেক যাত্রীর সমাগম হয়। উৎস শুনেই আমরা কল্পনা করলেম—না জানি কী সুন্দর দৃশ্য হবে; চারিদিকে পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, সারসমরাকুল-কূজিত, কলমকুমুদকহলার-বিকশিত সরোবর, কোকিল-কূজন, মলয়-বীজন, ভ্রমর-গুঞ্জন ও অবশেষে এই মনোরম স্থানে পঞ্চশরের প্রহার ও এক ঘটি জল খেয়ে বাড়ি ফিরে আসা। গিয়ে দেখি, একটা হাটের মধ্যে একটা ছোটো গর্ত পাথর দিয়ে বাঁধানো, সেখানে একটু একটু করে জল উঠছে, একটা বুড়ি কাঁচের গেলাস হাতে দাঁড়িয়ে। এক এক পেনি নিয়ে এক-এক গেলাস জল বিতরণ করছে ও অবসরমতো একটা খবরের কাগজে গতরাত্রের পার্লামেন্টের সংবাদ পড়ছে। চারদিকে দোকানবাজার; গাছপালার কোনো সম্পর্ক নেই; সম্মুখেই একটা কসাইয়ের দোকান, সেখানে নানা চতুস্পদের ও “হংসমরালকুল” এর ডানা ছাড়ানো মৃতদেহ দড়িতে ঝুলছে; এই সব দেখে আমার মন এমন চটে উঠল যে, কোনোমতে বিশ্বাস হল না যে, এ জলে কোনোপ্রকার রোগ নিবারণ বা শরীরের উন্নতি হতে পারে। টন্‌ব্রিজ ওয়েল্‌স শহরটা খুব ছোটো, দু-পা বেরোলেই গাছপালা মাঠ দেখতে পাওয়া যায়। বাড়িগুলো লণ্ডনের মতো থামবারান্দাশূন্য, ঢালু ছাত-ওআলা সারি সারি একঘেয়ে ভাবে দাঁড়িয়ে; অত্যন্ত শ্রীহীন দেখতে। দোকানগুলো তেমনি সুসজ্জিত, পরিপাটি, কাঁচের জানলা দেওয়া। কাঁচের ভিতর থেকে সাজানো পণ্যদ্রব্য দেখা যাচ্ছে; কসাইয়ের দোকানে কোনোপ্রকার কাঁচের আবরণ নেই, চতুষ্পদের আস্ত আস্ত পা ঝুলছে-ভেড়া, গোরু, শুওর, বাছুরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নানাপ্রকার ভাবে চোখের সামনে টাঙিয়ে রাখা, হাঁস প্রভৃতি নানাপ্রকার মরা পাখি লম্বা লম্বা গলাগুলো নিচের দিকে ঝুলিয়ে আছে, আর খুব একটা জোয়ান পেটমোটা ব্যক্তি হাতে একটা প্রকাণ্ড ছুরি নিয়ে কোমরে একটা আঁচলা ঝুলিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। বিলেতের ভেড়াগোরুগুলো তাদের মোটাসোটা মাংসচর্বিওআলা শরীরের ও সুস্বাদের জন্যে বিখ্যাত, যদি কোনো মানুষ-খেগো সভ্যজাত থাকত, তা হলে বোধ হয় বিলেতের কসাইগুলো তাদের হাটে অত্যন্ত মাগ্‌গি দামে বিকোত। একজন মেমসাহেব বলেন যে, কসাইয়ের দোকান দেখলে তাঁর অত্যন্ত তৃপ্তি হয়; মনে আশ্বাস হয়, দেশে আহারের অপ্রতুল নেই, দেশের পেট ভরবার মতো খাবার প্রচুর আছে, দুর্ভিক্ষের কোনো সম্ভাবনা পেই। ইংরেজদের খাবার টেবিলে যে রকম আকারে মাংস এনে দেওয়া হয়, সেটা আমার কাছে দুঃখজনক। কেটে-কুটে মসলা দিয়ে মাংস তৈরি করে আনলে একরকম ভুলে যাওয়া যায় যে একটা সত্যিকার জন্তু খেতে বসেছি; কিন্তু মুখ-পা বিশিষ্ট আস্ত প্রাণীকে অবিকৃত আকারে টেবিলে এনে দিলে একটা মৃতদেহ খেতে বসেছি বলে গা কেমন করতে থাকে। নাপিতের দোকানের জানলায় নানাপ্রকার কাঠের মাথায় নানাপ্রকার কোঁকড়ানো পরচুলো বসানো রয়েছে, দাড়িগোঁফ ঝুলছে, মার্কামারা শিশিতে টাক-নাশক চুল-উঠে-যাওয়া-নিবারক অব্যর্থ ওষুধ রয়েছে; দীর্ঘকেশী মহিলারা এই দোকানে গেলে সেবকরা (সেবিকা নয়) তাঁদের মাথা ধুয়ে দেবে, চুল বেঁধে দেবে, চুল কুঁকড়ে দেবে। এখানে মদের দোকানগুলোই সব-চেয়ে জমকালো, সন্ধ্যের সময় সেগুলো আলোয় আকীর্ণ হয়ে যায়, বাড়িগুলো প্রায় প্রকাণ্ড হয়, ভিতরটা খুব বড়ো ও সাজানো, খদ্দেরের ঝাঁক দোকানের বাইরে ও ভিতরে সর্বদাই, বিশেষত সন্ধ্যেবেলায় লেগে থাকে। দরজির দোকানও মন্দ নয়। নানা ফ্যাশনের সাজসজ্জা কাঁচের জানলার ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে, বড়ো বড়ো কাঠের মূর্তিকে কাপড় পরিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে; মেয়েদের কাপড়চোপড় এক দিকে ঝোলানো; এইখানে কত লুব্ধ নেত্র দিনরাত্রি তাকিয়ে আছে তার সংখ্যা নেই, এখানকার বিলাসিনীরা, যাদের নতুন ফ্যাশনের দামি কাপড় কেনবার টাকা নেই, তারা দোকানে এসে কাপড়গুলো ভালো করে দেখে যায়, তার পরে বাড়িতে গিয়ে সস্তায় নিজের হাতে তৈরি করে। আমাদের বাড়ির কাছে একটা খোলা পাহাড়ে জায়গা আছে; সেটা কমন অর্থাৎ সরকারি জায়গা; চারিদিক খোলা, বড়ো গাছ খুব অল্প; ছোটো ছোটো গুলেমর ঝোপ ও ঘাসে পূর্ণ, চারিদিক সবুজ, বিচিত্র গাছপালা নেই বলে কেমন ধূ ধূ করছে, কেমন বিধবার মতো চেহারা। উঁচুনিচু জমি, কাঁটাগাছের ঝোপঝাপ, জায়গাটা আমার খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে এইরকম কাঁটা-খোঁচা এবড়ো-খেবড়োর মধ্যে এক-এক জায়গায় ব্লুবেল্‌স নামক ছোটো ছোটো ফুল ঘেঁষাঘেঁষি ফুটে সবুজের মধ্যে স্তূপাকার নীল রং ছড়িয়ে রেখেছে, কোথাও বা ঘাসের মধ্যে রাশ রাশ সাদা ডেজি ও হল্‌দে বাটার-কাপ অজস্র সৌন্দর্যে প্রকাশিত। ঝোপঝাপের মাঝে মাঝে এবং গাছের তলায় এক-একটা বেঞ্চি পাতা। এইটে সাধারণের বেড়াবার জায়গা। এখানে মানুষ এত অল্প ও জায়গা এত বেশি যে ঘেঁষঘেঁষি নেই। লণ্ডনের বড়ো বড়ো বেড়াবার বাগানের মতো চারদিকেই ছাতা-হস্তক, টুপি-মস্তক, চোখ-ধাঁধক ভিড়ের আনাগোনা নেই; দূরদূর বেঞ্চির মধ্যে নিরালা যুগলমূর্তি রোদ্দুরে এক ছাতার ছায়ায় আসীন; কিংবা তারা হাতধরাধরি করে নিরিবিলি বেড়াচ্ছে। সবসুদ্ধ জড়িয়ে জায়গাটা উপভোগ্য। এখনো গরমিকাল শেষ হয় নি। এখানে গরমিকালে সকাল ও সন্ধ্যে অত্যন্ত সুন্দর। গরমির পূর্ণযৌবনের সময় রাত দুটো-তিনটের পরে আলো দেখা দিতে আরম্ভ করে, চারটের সময় রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে ও রাত্রি ন-টা দশটার আগে দিনের আলো নেবে না। আমি একদিন পাঁচটার সময় উঠে কমন-এ বেড়াতে গিয়েছিলুম। পাহাড়ের উপর একটা গাছের তলায় গিয়ে বসলুম, দূরে ছবির মতো ঘুমন্ত শহর, একটুও কুয়শা নেই। নির্জন রাস্তাগুলি, গির্জের উন্নত চূড়া, রৌদ্ররঞ্জিত বাড়িগুলি নীল আকাশের পটে যেন একটি কাঠে খোদাই করা ছবির মতো আঁকা। আসলে এই শহরটা কিছুই ভালো দেখতে নয়; এখানকার বাড়িগুলোতে জানলা-কাটা-কাটা চারটে দেয়াল, একটা ঢালু ছাদ ও তার উপরে ধোঁয়া বেরোবার কতকগুলি কুশ্রী নল। ক্রমে ক্রমে যতই বেলা হতে লাগল শত শত চিমনি থেকে অমনি ধোঁয়া বেরোতে লাগল, ধোঁয়াতে ক্রমে শহরটা অস্পষ্ট হয়ে এল, রাস্তায় ক্রমে মানুষ দেখা দিল, গাড়িঘোড়া ছুটতে আরম্ভ হল, হাতগাড়ি কিংবা ঘোড়ার গাড়িতে করে দোকানিরা মাংস রুটি তরকারি বাড়ি বাড়ি বিতরণ করে বেড়াতে লাগল (এখানে দোকানিরা বাড়িতে বাড়িতে জিনিসপত্র দিয়ে আসে), ক্রমে কমন-এ লোক জমতে শুরু হল, আমি বাড়ি ফিরে এলেম। এখানে আমার একটি শখের বেড়াবার জায়গা আছে। গাড়ির চাকার দাগে এবড়ো-খেবড়ো উঁচুনিচু পাহাড়ে রাস্তা, দুধারে ব্ল্যাকবেরী ও ঘন লতা-গুলেমর বেড়া, বড়ো বড়ো গাছে ছায়া করে আছে, রাস্তার আশেপাশে ঘাস ও ঘাসের মধ্যে ডেজি প্রভৃতি বুনো ফুল। শ্রমজীবীরা ধুলোকাদা-মাখানো ময়লা কোট-প্যান্টলুন ও ময়লা মুখ নিয়ে আনাগোনা করছে, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে লাল লাল ফুলো ফুলো মুখে বাড়ির দরজার বাইরে কিংবা রাস্তায় খেলা করছে—এমন মোটাসোটা গোলগাল ছেলে কোনো দেশে দেখি নি। এক-একটা বাড়ির কাছে ছোটো ছোটো পুকুরের মতো, সেখানে পোষা হাঁসগুলো ভাসছে। মাঠগুলো যদিও পাহাড়ে, উঁচুনিচু, কিন্তু চষা জমি সমতল ও পরিষ্কার। ঘাসগুলো অত্যন্ত সবুজ ও তাজা, এখানে রৌদ্র তীব্র নয় বলে ঘাসের রং আমাদের দেশের মতন জ্বলে যায় না, তাই এখানকার মাঠের দিকে চেয়ে থাকতে অত্যন্ত ভালো লাগে, অজস্র স্নিগ্ধ সমুজ রঙে চোখ যেন ডুবে যায়। মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো গাছ ও সাদা সাদা বাড়িগুলো দূর থেকে ছোটো ছোটো দেখাচ্ছে। এই রকম শূন্য মাঠ ছাড়িয়ে অনেক দূরে এসে এক-একটা প্রকাণ্ড পাইন গাছের অরণ্য পাওয়া যায়, ঘেঁষাঘেঁষি গাছে অনেক দূর জুড়ে অন্ধকার, খুব গম্ভীর, খুব নিস্তব্ধ।